রবিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

এই বিতর্কের প্রয়োজন ছিল না

মনজুরুল আহসান বুলবুল

এই বিতর্কের প্রয়োজন ছিল না

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক সুশোভন সরকারকে জীবন সায়াহ্নে প্রশ্ন করা হয়েছিল : সারাজীবন আপনার হাত ধরে কতজন পিএইচডি করল কিন্তু আপনি পিএইচডিটা করলেন না কেন? প্রবীণ জ্ঞান বুড়ো; মোটা চশমার ফ্রেমের ফাঁক গলিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন : পিএইচডি করলে কি মাথায় শিং গজায়? কথাটি মনে পড়ল, আমাদের খুবই পরিচিত লোকজনের মন্ত্রী হওয়ার পরের আচরণ দেখে, আর তাদের কথাবার্তা শুনে। অধ্যাপক সুশোভন সরকারের মতোই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে : মন্ত্রী হলে কি মাথায় শিং গজায়?

দেশে বিদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা; তখন সত্য, অর্ধসত্য মিলিয়ে মন্ত্রী বাহাদুররা এমন সব কথাবার্তা বলছেন চুপচাপ বসে থাকাই কষ্টকর। মন্ত্রী বলছেন, সাংবাদিকরা যা বলেছেন তা নাকি লাইন বাই লাইন মেনে নেওয়া হয়েছে। শিং যে গজিয়েছে তা বোঝা গেল তার এই কথা শুনে যে : সংসদীয় কমিটিতে যা বলেছে, সাংবাদিকরা নাকি তা ভুলেই গেছে!! এক তরুণ গবেষক ‘কথা ও কর্ম’ নামে গবেষণা করছেন; বললেন, এই মন্ত্রী মন্ত্রী হওয়ার আগে তার প্রিয় প্রসঙ্গ ‘ডিজিটাল স্পেস’ নিয়ে যত কথা বলেছেন, এবং ডিজিটাল স্পেস নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ সফল হবে না বলে যত মন্তব্য করেছেন তার একটি তালিকা তৈরি করছেন তিনি। এর সঙ্গে এই আইন প্রণয়ন করার পর তার বক্তব্যের তুলনামূলক চার্ট দেখে তিনি বারবার বিস্মিত হচ্ছেন। তালিকাটা হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু তাতে তার কিছুই আসবে যাবে না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এই মন্ত্রী একদা এমন একটি কাগজে এমন ধারার সাংবাদিকতা করেছেন, তখন তথ্যপ্রযুক্তি আইন বা তার প্রণীত আজকের ডিজিটাল আইন থাকলে এমন সুন্দর স্বাস্থ্য নিয়ে আজ পর্যন্ত জীপনযাপন করতে হতো না। মন্ত্রীর সৌভাগ্য যে; তখন এরকম একটি আইন ছিল না, আর আমাদের দুর্ভাগ্য যে ওই ‘পচা সাংবাদিকতার’ ধারক বাহকদের সঙ্গে আজ আমাদের সাংবাদিকতা, স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে, তাদের কথাও শুনতে হচ্ছে।

আসলে এ বিতর্কের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। সরকার এবং দেশের অপরাপর নাগরিকদের মতো সাংবাদিক সমাজও চায়, দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য একটি শক্ত আইন হোক, সেই আইনে দুর্বৃত্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। আমি যে টেলিভিশনে কাজ করি সেই টেলিভিশনের নামে প্রায় তিন ডজন ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে এমন সব বিষয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার নিজের নামে দুটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। কোনো এক জঙ্গি গোষ্ঠী আমার নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে; সেই পরোয়ানা আমার গলায় ফাঁসি ঝুলানো ছবিসহ অনলাইনে ঘুরছে মাসের পর মাস। এসব নিয়ে থানায় জিডিই করা হয়েছে, বিটিআরসিকে জানানো হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে কিন্তু ফলাফল অশ্বডিম্ব। কাজেই এমন একটি আইন হবে যা হয়রানি থেকে মানুষকে মুক্তি দেবে, দুর্বৃত্তদের কঠোর সাজা হবে, এমন আইন এবং সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগই তো আমরা চাই।

২০০৬ সালে যখন তথ্যপ্রযুক্তি আইন হলো তখনো এর ৫৭ ধারা নিয়ে উদ্বেগ জানালে বলা হলো ‘এই আইন তো সাংবাদিকদের জন্য না, কাজেই সাংবাদিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই’। বিশেষায়িত আইন ছাড়া সব আইন যে সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য; সেটি বোঝার জন্য মন্ত্রী হওয়ার দরকার পড়ে না। সে সময় সাংবাদিক সমাজ বলল : ৫৭ ধারায় এমন কিছু বিষয় আছে যার অপপ্রয়োগ হলে সাংবাদিকরা বিপদগ্রস্ত হবেন। আশ্বাস দেওয়া হলো; এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে না। আমরা আশ্বস্ত হয়ে ঘুমাতে গেলাম। আমাদের সেই ঘুম ভাঙল শিংওয়ালা মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ আর ৫৭ ধারার লাগামহীন অপপ্রয়োগের গুঁতায়। এই গুঁতা এতই আতঙ্ক ছড়াল যে; শেষ পর্যন্ত খোদ আইনমন্ত্রী বললেন ৫৭ ধারার আসলেই অপপ্রয়োগ হচ্ছে, এটা বন্ধ করা উচিত। নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলে এই ৫৭ ধারার মৃত্যু ঘটবে, আর আশঙ্কার কিছু থাকবে না। আমরা আবার আশ্বস্ত হলাম।

কিন্তু নতুন ডিজিটাল আইনের খসড়া বের হলে তো আমরা আকাশ থেকে পড়লাম! দেখলাম : ২০০৬ সালের আইনের ৫৭ ধারাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন আইনের নানা ধারায়। শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বিস্ময়কর মাত্রায়। প্রায় ১৪টি ধারায় জামিন অযোগ্য বিধান করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ৪৩ ধারায় এক সাব ইন্সপেক্টর পর্যায়ের পুলিশ অফিসারকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, তল্ল­াশি, আটক, জব্দ করার বেসামাল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিষফোঁড়ার মতো ৩২ ধারায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে গুপ্তচরবৃত্তির আপরাধের কঠোর সাজা। আমরা আমাদের উদ্বেগ নিয়ে আইনমন্ত্রীর কাছে গেলাম, স্পিকার মহোদয়ের কাছে গেলাম। তারা পরামর্শ দিলেন, সংসদীয় কমিটিকে তারা বলবেন। চূড়ান্ত করার আগে কমিটির সম্মানিত সদস্যরা আমাদের সঙ্গে বসবেন।

সংসদীয় কমিটির সম্মানিত চেয়ারম্যান আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা আশ্বস্ত হলাম, আমরা সম্মানিত বোধ করলাম। সম্পাদক পরিষদ, টেলিভিশন মালিক এবং সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ ভবনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রথম বৈঠকে অংশ নিলাম। কমিটির মাননীয় সদস্যরা সংসদে উপস্থাপিত আইনের খসড়াটি সম্পর্কে বললেন, আমরাও আমাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলাম। এর মধ্যে সম্পাদক পরিষদ ও বিএফইউজে থেকে লিখিতভাবে পর্যবেক্ষণ জমা দেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠান এ খসড়াটি নানাভাবে বিশ্লেøষণ করেছে, সেটিও কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হলো। কমিটির সদস্যরা এমন কথাও বললেন : এখানে আসলে কোনো প্রতিপক্ষ নেই, আমরা সবাই মিলে একটি ভালো আইন করব। সেদিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে মন্ত্রী বাহাদুরদের পাশাপাশি আমাদের আকর্ণ বিস্তৃত হাসিটি দেখা যাবে। আমরা সবাই একমত হলাম; আমরা দ্বিতীয় দফায় বসব। দ্বিতীয় বৈঠকটি হলো দ্রুতই। কমিটির পক্ষ থেকে ১১টি ধারায় কিছু সংযোজন, বিয়োজন, ভাষাগত সংশোধন, কয়েকটি ধারায় শাস্তি কমানোর প্রস্তাবনাসহ বহুল উদ্বেগের ৪৩ ধারার ১ উপধারায় পুলিশের অবাধ ক্ষমতা কমিয়ে মহাপরিচালকের অনুমোদনের বিষয়টি সংযুক্ত করার কথা বলা হলো। ৩২ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টি বদলে ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এর পুনঃস্থাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হলো। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট পুনঃস্থাপনের বিরোধিতা করে জানাই; এটি হবে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইনের সরাসরি পরিপন্থী। আমরা বরং নতুন আইনে তথ্য অধিকার আইনকে সংযোজনের দাবি জানাই। এ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় : কমিটির সঙ্গে তৃতীয় একটি বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তবে তার আগে গণমাধ্যমের তিন প্রতিনিধি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বসে সব বিষয় পর্যালোচনা করবেন, যাতে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত করতে কম সময় লাগে। যথারীতি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি হয়। তিনি আমাদের সব আলোচনার নোট নেন, কতক বিষয়ে একমত হন এবং আশা করেন তৃতীয় বৈঠকেই সমঝোতার ভিত্তিতে সব চূড়ান্ত করেই সংসদে উপস্থাপন করা হবে। আমরা এতে আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু এই আশ্বস্ত শেষ পর্যন্ত স্বস্তি তো আনলই না বরং অস্বস্তি আরও বাড়াল।

১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুর বললেন ‘এই আইন নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সমালোচনা করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অভিমতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের কথা অনুসারে যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার, তার সবই করা হয়েছে।’

মন্ত্রী বাহাদুর যা বললেন তা কি পুরোপুরি সত্যি? নিজেই বলুন। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তৃতীয় বৈঠক না করেই একতরফাভাবে যে রিপোর্টটি সংসদে পেশ করা হলো এটাই কি সত্যি নয়?

মোস্তাফা জব্বার তার বক্তব্যে বলেন, সংসদে উত্থাপিত বিল ও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করলে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিলটি লাইন বাই লাইন সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেছি। তাদের কথা অনুসারে যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার, তার সবই করেছি।

গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে তো আমরা চারটি রিপোর্ট নিয়েই বসতে চাই : সংসদে উপস্থাপিত খসড়া + সম্পাদক পরিষদ ও বিএফইউজের লিখিত দুটি প্রতিবেদন + সংসদীয় কমিটির আলোচনার রেকর্ড + সংসদে উপস্থাপিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন। সব নিয়ে বসলেই তো বোঝা যাবে কী প্রস্তাব করা হয়েছে, কতটা গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি দুই মন্ত্রী যে তাদের দেওয়া প্রস্তাব থেকেও সরে এসেছেন সে বিষয়টিও প্রমাণিত হবে আশা করি। মন্ত্রী বাহাদুর বলেছেন : সংবাদপত্র দমনের জন্য এ আইন নয়, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্যও এ আইন নয়। কাগজের পত্রিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট। সম্প্রচার মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য হবে সম্ভাব্য সম্প্রচার কমিশন আইন। এ আইন কেবল ডিজিটাল অপরাধ দমন করার জন্য। তার এই ব্যাখ্যা যে আমরা বুঝি না এমন নয়। সংবাদপত্রের ছাপানো রিপোর্টটি যখন অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হবে তখন যে এ খড়গটি মাথায় আঘাত হানবে এটি তো তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার প্রয়োগ থেকেই আমরা জানি। আর সম্প্রচার কমিশন আইনের কথা তো আমরাই কমিটিতে তুলে বলেছিলাম; সম্প্রচার কমিশন আইনে যে কোনো তথ্য ব্লক, আপসারণের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সেই প্রস্তাবনা আমলে না নিয়ে এ ক্ষমতা দেওয়া হলো ডিজিটাল আইনের মহাপরিচালক আর বিটিআরসিকে। মন্ত্রী বাহাদুরের বিবৃতি, অভিমত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা যেন না থাকে, সেজন্য তথ্য অধিকার আইনের অধিকার সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষণ করেছি।

ধন্যবাদ আমাদের এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য। আমরা বারবারই এ কথা বলার চেষ্টা করেছি; ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিøষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইনের মাধ্যমে তথ্যকে অবারিত করার ক্ষেত্রে এ সরকারের ইতিবাচক অর্জনটি যেন এ দুই আইনের চেতনাবিরোধী কোনো কর্ম দিয়ে নস্যাৎ করা না হয়। কিন্তু বাস্তবে তাই করা হলো। আরও মজাদার যে, সাংবাদিকরা ৩২ ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন উল্লেখ করে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘সেখানে তারা গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলেছিলেন। সংসদীয় কমিটি সেটাকে সংশোধন করে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের কথা বলেছে। এ অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অপপ্রয়োগের নজির এখনো নেই।’

জবাবে বলি : মন্ত্রী বাহাদুর; ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অপপ্রয়োগ দরকার নেই, এর সঠিক প্রয়োগই তথ্যপ্রবাহে বড় বাধা। ২০০৯ সালে যে তথ্য অধিকার আইনটি হয়; খসড়া থেকে চূড়ান্ত পর্যন্ত এ নিবন্ধকার জড়িত ছিলেন। ১৯২৩ সালের এ অ্যাক্টটি সাংবাদিকদের তথ্যপ্রবাহে বাধা দেয় বলেই বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ‘এক্সেস টু ইনফরমেশন’ আইনের দাবি তুলেছিল। তারই ধারাবাহিকতাতে শেষ পর্যন্ত তথ্য অধিকার আইন অর্জিত হয়। প্রতিটি আইন প্রণয়নের বেলায় একটি পটভূমি থাকে, সেটি জানা না থাকলে বিতর্কে না আসাই ভালো। তথ্য অধিকার আইনে স্পষ্টই বলা আছে : ‘অন্য আইনে যাহাই থাকুক না কেন তথ্য অবারিত করার ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন প্রাধান্য পাইবে।’ এর ফলে ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের দাঁতটি ভোঁতা করে দেওয়া হয়, তথ্য গোপন করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, কোনো কিছু আইনিভাবে সিক্রেট করা যাবে না বলে দুর্নীতির সুযোগ কমে আসবে এমনটিই নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু নতুন আইনে সেই মৃতপ্রায় এবং গোপনীয়তার সংস্কৃতির রক্ষক অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টটিকে আবার প্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। মন্ত্রীর ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, এই অ্যাক্টটি ৩২ ধারায় প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দিলে সংসদীয় কমিটিতেই আমি এটিকে একটি চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। চিত্রটি কল্পনা করুন : আইনের ৩ ধারায় তথ্য অধিকার আইন সংযোজন করে তথ্যপ্রবাহের অধিকার নিশ্চিত করা হলো, সেই একই আইনে আবার ৩২ ধারায় তথ্য আটকে দেওয়ার জন্য অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে সংযোজন করা হলো। এটি কি সাংঘর্ষিক বা হাস্যকর নয়?

সংসদে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেন, ‘সম্পাদক পরিষদের নেতারা সংসদীয় কমিটি ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যে কথাগুলো বলেছেন, সম্ভবত তা ভুলে গেছেন।

জবাবে বলি : মন্ত্রী হতে গেলে ১৯৭২ সালের সদ্য স্বাধীন দেশটিকে অস্থিতিশীল করার গণকণ্ঠীয় সাংবাদিকতা ২০১৮ সালে ভুলে যেতে হয় কিন্তু পেশাদার সাংবাদিকদের পেশার কারণেই সব মাথায় রাখতে হয়। কাজেই সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা ও উপস্থাপনার প্রামাণিক দলিলই বলবে; গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা কিছুই ভুলে যাননি। বরং মন্ত্রী বাহাদুরদের ভুলে যাওয়ার একটি নমুনা তুলে ধরি। সংসদীয় কমিটির সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠকে কমিটির পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সংশোধনীর যে লিখিত বিবরণটি দেওয়া হয় : সেখানে ৯ নম্বর তালিকায় ৪৩ ধারাতে সংসদীয় কমিটির নিজেদের প্রস্তাবেই বলা হয় যে, পুলিশ কর্মকর্তা প্রস্তাবিত ডিজিটাল এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন নিয়ে তার দায়িত্ব পালন করবেন। এটি আমাদের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুরেরই প্রস্তাব। সংসদে উপস্থাপনের জন্য ছাপানো রিপোর্টেও তা সন্নিবেশিত ছিল, কিন্তু চূড়ান্ত উপস্থাপনের সময় মন্ত্রী বাহাদুর তাদেরই প্রস্তাব ভুলে গেলেন, পুলিশের হাতে তুলে দিলেন সর্বময় ক্ষমতা।

এ নিয়ে বিতর্ক আরও বাড়ানো যায়। দেশের সংবাদ মাধ্যম কর্মীরা বিতর্ক সৃষ্টির জন্য নয়, একটি ভালো আইন প্রণয়নের জন্যই এর সহযোগী হতে চেয়েছিল। কিন্তু হতাশা, উদ্বেগ বা আতঙ্ক কিছুই কমেনি।

কেন হতাশা। সংসদীয় কমিটির আচরণে? তৃতীয় বা চূড়ান্ত বৈঠকটি হলে হয়তো অনেক বিতর্ক এড়ানো যেত। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি রাখলেন না। সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করে কোনো ফল পাওয়া যায়? জবাব হলো : পাওয়া যায়, নজির আছে। তথ্য অধিকার আইনের যে খসড়াটি ২০০৯ সালে সংসদে উপস্থাপন করা হয়, সেখানে ৩২ ধারায় বলা হয়েছিল; কতিপয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না। তলিকা দিয়ে বলা হলো : পুলিশ-র‌্যাব-এনবিআর গোয়েন্দা সেলসহ ৮টি সংস্থা [প্রধানত গোয়েন্দা সংস্থা] এই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে, অর্থাৎ তারা কোনো তথ্য দেবে না। সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে আমরা বললাম যে; এ ৮টি সংস্থার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া না গেলে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্বই পালন করতে পারবে না। দীর্ঘ আলোচনার পর কমিটির সম্মানিত সদস্যরাই একটি বিধি যুক্ত করে বললেন এই সংস্থাগুলোর কোনো তথ্য যদি দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তারা আইনি সুরক্ষা পাবে না অর্থাৎ তাদের তথ্য দিতে হবে। এ কারণেই কিন্তু নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের সময় র‌্যাবকে সব তথ্য দিতে হলো। ছোট একটি সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির সদস্যরা যে জটিলতা নিরসন করলেন, আমাদের সম্মানিত করলেন সে জন্য আজও আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমাদের উদ্বেগ কেন? কারণ এ আইনটিকে শুধু একটি কারিগরি আইন হিসেবেই দেখা হচ্ছে এবং তা নিষ্পত্তির জন্য পুলিশের অবাধ ক্ষমতার প্রতিই আস্থা রাখা হচ্ছে। এ আইনের যে একটি মানবিক ও যৌক্তিক চেহারা আছে সেটিকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এ আইনটির সঙ্গে দেশে ভাবমূর্তির একটি বিশাল বিষয়ও জড়িত, সেটিকে একবারেই ভুলে যাওয়া হয়েছে। ফলে দেশে-বিদেশে নানা আলোচনা চলতেই থাকবে। গণমাধ্যমের বিশ্বসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও নিচে নেমে যাবে। একটি হাই কোর্ট দেখানো হলো, যে এই আইন নাকি অনেক বিদেশি সরকারও মন্ত্রীর কাছে চাইছে। তিনি সিঙ্গাপুরের নামটিও উল্লে­খ করেছেন। নানা জাতের বিনোদনের জন্য সিঙ্গাপুর খুব ভালো দেশ হতে পারে, কিন্তু বিশ্বগণমাধ্যম বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সূচকে সিঙ্গাপুর খুব মর্যাদাকর জায়গায় নেই। 

আমরা আতঙ্কিত, কেন? এ আইনের আপপ্রয়োগ নিয়ে। এ আতঙ্কের ভিত্তি হচ্ছে ২০০৬ সালের তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের বেসুমার অপপ্রয়োগ নিয়ে। ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়েও আমরা আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম। এখনকার মতো তখনো বলা হয়েছিল এ ধারার কোনো অপপ্রয়োগ হবে না। সংসদে অনেক মন্ত্রীর ৫৭ ধারার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ বাণী এখনো আমাদের কানে বাজে। শেষ পর্যন্ত ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের কথা সব মহলই স্বীকার করেছেন। নতুন আইনে সেই ৫৭ ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই আইনের মতোই ভাগ্যবিধাতা করা হয়েছে সাব ইন্সপেক্টর মানের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। আর আমাদের দাবি অনুযায়ী সাংবাদিকদের জন্য কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসবই আমাদের আতঙ্কের কারণ।

তাহলে দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা কী চায়? সংবাদমাধ্যমকর্মীরা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা দমনের জন্য কঠোর আইন চায়। তবে সেই আইনের কোনো ধারা যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি চোখ রাঙিয়ে ভীতি না ছড়ায় তার নিশ্চয়তা চায়। সুনির্দিষ্টভাবে সংবাদকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষা চায়। কীভাবে সেই সুনিশ্চিত করা যায়? সাংবাদিকদের প্রস্তাব : এ আইনের কোনো ধারা সংবাদকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের বেলায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে সম্পৃক্ত করা যায়। কেন প্রেস কাউন্সিল? কারণ সেখানে মাননীয় সংসদ সদস্য আছেন, সম্পাদক, সংবাদিক ও মালিক প্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা এবং বুদ্ধিজীবীরাও আছেন। তারা শুধু দেখবেন; যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো সেটি সাংবাদিকতা সংক্রান্ত বিষয় নাকি ব্যক্তিগত অপরাধ। একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় সাংবাদিকরা অবশ্যই নেবে না। এ প্রস্তাবটি আমরা লিখিতভাবেই সংসদীয় কমিটিতে দিয়েছিলাম।

প্রশ্ন উঠেছে, এ ধরনের একটি সাধারণ আইন কি বিশেষ পেশাজীবী হিসেবে সাংবাদিকদের বিশেষ ব্যবস্থায় সুরক্ষা দিতে পারে? জবাব হচ্ছে, পারে, নজির আছে। তিনটি উদাহরণ দিই। প্রথমত ফৌজদারি দ-বিধির ৫০১ ও ৫০২ ধারা নিয়ে। এ ধারায় কোনো মামলা হলে অন্য সবার মতো সাংবাদিকদেরও তাদের অফিস বা বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার বিধান ছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তার জনশক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আতাউদ্দিন খানের এক মামলায় দৈনিক সংবাদে একটি কলামের কারণে প্রবীণ সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীকে মধ্যরাতে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জনকণ্ঠের সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানসহ আরও কয়েকজনকে এ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এ অভিজ্ঞতা থেকে সাংবাদিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই বিধান চালু হয়েছে; কোনো সাংবাদিক ৫০১/৫০২ ধারায় অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে সমন জারি করা হবে এবং তিনি কোর্টে হাজিরা দিয়ে আইনি লড়াই করবেন। ফলে কোনো খবর বা লেখা প্রচার বা প্রকাশের জন্য কোনো সাংবাদিকের নামে ৫০১/৫০২ ধারায় মামলা হলেও সাংবাদিকরা গ্রেফতারের ভয়ে অফিস বা বাড়ি ছাড়া হন না, আইনিভাবে সব মোকাবিলা করেন। দ্বিতীয় উদাহরণ : ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ নিয়ে সাংবাদিকরা যখন অতিষ্ঠ; তখন তারা আজকের প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান আসে। নির্দেশনা জারি হয়, সংবাদকর্মী বা গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে ৫৭ ধারা প্রয়োগের বেলায় পুলিশ সদর দফতরের অনুমোদন নিতে হবে। এতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তৃতীয় উদাহরণ : অতি সম্প্রতি দুর্নীতি দমন আইন সংশোধন করে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে, দুর্নীতির জন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হবে।

এখন যে প্রশ্নটি সবাই করছেন, আইন তো হয়েই গেছে, সমাধান কী? সমাধান নানাভাবেই হতে পারে। হতে পারে রাষ্ট্রপতি আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইনটি সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন। বিধিমালা প্রণয়নের বেলায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠার জায়গাগুলো বিবেচনায় নিয়ে সেগুলোর যুক্তিগ্রাহ্য নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করে ৫০১/৫০২ বা ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ এবং দুর্নীতি দমন আইন সংশোধনের মতো এখানেও সংশোধনী এনে সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন।

তবে একটি বিনীত প্রশ্ন, যার কোনো জবাব মিলছে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে এ আইনটি প্রণয়নের জন্য এত তাড়াহুড়া কেন করা হলো? এ আইনের প্রায়োগিক কোনো সুবিধাই আর বর্তমান সরকার এ মেয়াদে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রয়োজনীয় সব কিছু নিষ্পন্ন করে আইনের প্রয়োগ করতে যে সময় লাগবে সেই সময় এ মেয়াদে এ সরকারের হাতে নেই। নতুন সরকারের জন্য এটি রেখে দেওয়া যেতে পারত। আরেকটি পর্যবেক্ষণ; যে প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইনের মতো প্রগতিশীল আইন হলো, যে আইনগুলো দৃশ্যত : দেশে বিদেশে তথ্যপ্রবাহ অবারিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভিন্ন মর্যাদায় নিয়ে গেছে, সেখানে তাড়াহুড়া করে এ প্রশ্নবিদ্ধ আইনটি কেন করা হলো? সরকারকে বিব্রত করা বা বিরোধীপক্ষের হাতে সমালোচনার ইস্যু তুলে দেওয়ার কোনো চক্রান্ত? বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু স্কুল ছাত্রদের আন্দোলনের সময় খোদ সচিবালয়ে বসে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর একান্ত কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে এখনো যেভাবে বহাল তবিয়তে আছেন, তাতে একেবারে অবিশ্বাসও করতে পারি না যে কোনো চক্রান্ত নেই।

এতক্ষণ ধরে যা বলা হলো সবই পুরনো কথা। এসবই লিখিতভাবে যথাস্থানে যথাসময়ই দেওয়া হয়েছিল, মৌখিকভাবে তো বলা হয়েছিলই। সেখানে গ্রহণযোগ্য বা যুক্তিসঙ্গত নিষ্পত্তি হলে এ বিতর্কের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কথার পিঠে কথা আসে বলেই এত কথা, আর আশাবাদী থাকা!!!।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর