মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

চিকিৎসকদের চিরায়ত ইমেজ নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে

ড. ফরিদ আহমেদ/সোচনা শোভা

চিকিৎসকদের চিরায়ত ইমেজ নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে

বাংলাদেশে চিকিৎসকদের চিরায়ত ইমেজ নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। পত্রপত্রিকার পাতায় বর্ণিত চিকিৎসকদের নানাবিধ অনৈতিক কর্মকা- সবাইকে শিহরিত করে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, রোগীর দুরবস্থাকে পুঁজি করে রোগীকে নিঃস্ব করা, রোগীর সর্বনাশ করা, রোগীর সঙ্গে অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া, রোগীর গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া, মিথ্যা ও তথ্য বিকৃত সনদ প্রদান করা, ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে যুক্ত থাকা প্রভৃতি বিষয় বহুল আলোচিত। এতে চিকিৎসা-ব্যবস্থার প্রতি যে আস্থার জায়গা ছিল তা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা হয়েছে। আজ মানুষ সামান্য কিছু টাকা জোগাড় করতে পারলে বিদেশ চলে যায়। যারা বিদেশ চলে যায় তাদের বর্ণনায় জানা যায়, বিদেশি ডাক্তারদের আচরণ এতই মধুর যে রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। যারা এ পেশায় ভালো করছেন তারাও চিন্তিত এ পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমাদের কল্পনা রাজ্যের চিকিৎসককে খুঁজতে আজ বিদেশ যেতে হয়। অথচ একসময় আমাদের দেশে পড়াশোনা করতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসত। বিদেশে আজ প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে; যা আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য মোটেও শুভ হতে পারে না।

দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশে নানাভাবে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। এর প্রতিরোধে সরকার সম্প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কারিকুলামে নীতি শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। আমরা বিভিন্ন গবেষণা জার্নাল পাঠ করে জানতে পারি চিকিৎসকদের নীতি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উন্নত বিশ্বে বিশেষভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে অন্তত ৩৫ বছর। এবং এটি একটি আবশ্যিক বিষয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। এতে প্রতীয়মান হয়, অনানুষ্ঠানিক ও সমাজ থেকে শেখা নৈতিক শিক্ষা পেশাগত ঊৎকর্ষতার জন্য যথেষ্ট নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়ন নীতিবিদ্যা পাঠের গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে। স্টিম সেল গবেষণা, ক্লোনিং, গর্ভপাত, কৃপামৃত্যু, অপ্রতুল ওষুধ ও উচ্চমূল্যের চিকিৎসাসামগ্রী এবং টেকনোলজিক্যাল গবেষণায় ব্যাপক উন্নতি পাশ্চাত্য দেশগুলোয় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেসব দেশে নীতিবিদ্যা পাঠের বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর। এমনি অসংখ্য গবেষণা জার্নাল চিকিৎসা নীতিবিদ্যা নিয়ে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যেও ২৮টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ২৬টিতে চিকিৎসা নীতিবিদ্যা কোর্স চালু আছে। অন্যদিকে এশিয়ার ২০৬টি মেডিকেল কলেজে ইতিমধ্যে চিকিৎসা নীতিবিদ্যা কোর্স চালু হয়েছে। অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ এশিয়ার দেশগুলো যথা চীন, হংকং, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া  ও মঙ্গোলিয়ায় আলাদাভাবে চিকিৎসা নীতিবিদ্যার কোর্স চালু আছে। তবে বাংলাদেশের চিকিৎসাবিদ্যায় নীতিবিদ্যা সংযোজন নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা আজও হয়নি। ২০০৫ সালে ১৯০টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ইউনেস্কোর একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে যে, নৈতিক শিক্ষা পেশাগত বিদ্যার সঙ্গে সমন্বিত করে পাঠদানের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আজও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

উন্নত নৈতিক চরিত্রের একজন চিকিৎসক তৈরিতে কেবল নীতিবিদ্যা পাঠ যথেষ্ট হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষক, নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রোগী ও রোগীর পরিবার একটি অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। তারা শিক্ষার্থীকে এর গুরুত্ব বুঝতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন এবং বাস্তব জীবনে কতটুকু প্রয়োগে সফল হলো তা মূল্যায়নের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করবেন। এ ক্ষেত্রে তারা কী কী বিষয় নিয়ে কথা বলবেন তার একটি তালিকা আমরা অতীত গবেষণাকর্ম, উন্নত বিশ্বে বিদ্যমান পাঠক্রম ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ব্যবহার করে প্রস্তাব করতে পারি। আমরা এমনসব বিষয় বিবেচনা করতে পারি যা একটি গ্রহণযোগ্য মনোভাব ও পেশাগত দিক থেকে উন্নতমানের আচরণ প্রদর্শন গঠনে সহায়ক হবে। একজন শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যসেবায় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাকে নিশ্চিত করবে।

একজন শিক্ষার্থী যিনি আগামীতে একজন চিকিৎসক হবেন, তিনি যেন মানব মর্যাদা ও পেশার মর্যাদা রক্ষার মানবীয় মূল্যবোধগুলো কী কী তা অনুধাবন করতে পারেন। কারণ, তিনি চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে গিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নেবেন তা হতে হবে যথোপযুক্ত ও মানবীয় মূল্যবোধপুষ্ট। আমরা জানি, চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত নার্স, হাসপাতাল কর্মী ও কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি সমাজের অন্য পেশার মানুষকে প্রভাবিত করে। সুতরাং তাকে ওই নীতি অনুসরণ করতে হবে। এ পেশায় নিয়োজিত সবার জন্য প্রযোজ্য হয় যেমনটি নীতি-দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট পরামর্শ দিয়েছেন।

চিকিৎসাসেবা প্রদানে চিকিৎসককে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের ফলে অধিকতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় এবং এগুলো নিবিড়ভাবে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিক প্রযুক্তি অপূর্ণাঙ্গ শিশু ও বয়স্কদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করলেও এ সুযোগ বিভিন্ন সময় নানা জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে যা প্রকৃতি-গতভাবে নৈতিক। কখন একজন রোগীর জীবন রক্ষাকারী সাপোর্ট দিতে হবে এবং কখন তা বন্ধ করতে হবে বিষয়টি নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে প্রজনন কৌশল ও জেনেটিক মেডিসিনের উন্নতি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ তেমনি সন্তানটি পুরুষ না কন্যা জানার সুযোগও নৈতিক সমস্যা তৈরি করে। আগামীতে মানব-জীবনের তথ্য বিস্তারিত জানা যাবে। তখন চিকিৎসাসেবা প্রদান নতুন ধরনের নৈতিক সমস্যায় ফেলে দেবে। এমনি এক চ্যালেঞ্জনির্ভর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যারা চিকিৎসা দেবেন তাদের সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে হবে। সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে, দেশের জনগণকে অবিচার ও অন্যায় থেকে রক্ষা করতে এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠক্রমে চিকিৎসা নীতিবিদ্যা পাঠ সময়ের দাবি।

ড. ফরিদ আহমেদ : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সোচনা শোভা : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর