মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হজের শপথ বাস্তবায়ন হোক

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হজের শপথ বাস্তবায়ন হোক

হে কাবা! জীবনে আর কি দেখা হবে তোমার সঙ্গে? এক জীবনে আর কি দাঁড়াতে পারব হে নবী আপনার রওজার সামনে? এমন প্রশ্ন নিয়েই দেশে ফিরছেন বেশির ভাগ হাজী। হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেননা, এত ব্যয়সাধ্য একটি ইবাদত বার বার করা যায় না। তাই তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জীবন সফরের শেষ প্রান্তে চলে এলেন, তখন তিনি ভাবলেন, সব উম্মতের মুখোমুখি একবার দাঁড়ানো দরকার। তিনি ঘোষণা করলেন, এ বছর আমি আমার উম্মতের সঙ্গে হজ করব। লাখো উম্মত নিয়ে তিনি হজ করলেন। হজের দিন আরাফার প্রান্তরে দাঁড়িয়ে উম্মতের উদ্দেশে ঐতিহাসিক একটি ভাষণ দিলেন। ইতিহাসে যা ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত। এ ভাষণের আরেকটি নাম হলো মানবতার ঐতিহাসিক সনদ। এ সংক্ষিপ্ত ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের পুরো রূপটিকে সংক্ষেপে হƒদয়গ্রাহী ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। বিদায় হজের ভাষণে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘হে আমার উম্মত! তোমরা যারা উপস্থিত আছো, অবশ্যই আমার কথাগুলো মেনে চলবে। আর যারা উপস্থিত হতে পারেনি, তাদের কাছে আমার কথাগুলো পৌঁছে দেবে।’ আফসোস! সেই ভাষণের পর দেড় হাজার বছর চলে গেল, প্রতি বছরই হজ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নবীহারা এতিম উম্মতের জন্য আজকের দুনিয়ায় দরদি কোনো ইমাম পাওয়া যায়নি। বিশ্ব মুসলিম আজ অভিভাবকহারা। তারা যখন হজের ময়দানে এক হয়, তখন কিন্তু আরাফাতের ওই ভাষণকেই অভিভাবক মনে করে। আজকের আরাফাতের ময়দান থেকে যদি একবার ঘোষণা করা হতো, যে করেই হোক ইসলামের হারানো গৌরব আমরা ফিরিয়ে আনবই। আর এজন্য অন্য কেউ নয়, আরাফাতের ময়দানের এ বিশাল-সংখ্যক হাজীই যথেষ্ট, আল্লাহর কসম! নিষ্পাপ হাজীদের মাধ্যমেই বিশ্বে আবার ইসলামের বিজয় ফিরে আসতে বাধ্য হতো।

হায়! হজ আসে হজ যায়। কিন্তু সেখানে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ নিয়ে কোনো সার্বিক কর্মসূচি ঘোষিত হয় না। কর্মসূচি তো দূরের কথা, হজের ভাষণই তো বুঝতে পারে না বিশালসংখ্যক হাজী। অথচ প্রযুক্তি দুনিয়ার আজ এর চেয়ে সহজ কাজ বোধহয় আর নেই বললেই চলে। যখন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সগুলো হয়, সেখানে এমন সফটওয়্যার থাকে, কথক যে ভাষায় কথা বলুক, শ্রোতা তার নিজের ভাষায় শুনতে পারে। বুঝতে পারে। হজ ব্যবস্থাপকরা চাইলেই কিন্তু খুব সহজে মানুষের কানে ও মনে হজের শিক্ষা তুলে ধরতে পারে। আফসোস! হজ এবং হাজীরা এখনো বেখেয়াল দিন কাটাচ্ছেন। কাবা ঘুরলাম আর হাজী হয়ে গেলাম। বিশ্বের এমন কোনো কনফারেন্স নেই, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা এমন শূন্য হাতে ফেরে। বিশ্বের এমন কোনো ধর্মীয় সম্মেলন হয় না যেখানে প্রেমিকরা এত প্রতারিত হয়ে ফেরে।

হে নবী! মদিনার ওই সবুজ গম্বুজে শুয়ে শুয়ে আপনি তো সবই দেখছেন। আপনার এতিম উম্মতদের সঙ্গে কী আচরণ করা হচ্ছে? কীভাবে তাদের বার বার ঠকানো হচ্ছে। বিদায় হজের ভাষণে আপনার দেয়া দিকনির্দেশনাগুলোর একটিও যদি প্রতি বছর মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়া যেত, তবে আপনার উম্মত আজ দুনিয়াবাসীর কাছে এভাবে পরে পরে মার খেত না।

হে বাংলাদেশের হাজী ভাই! কেউ হয়তো এবারই প্রথম হজ করেছেন, কেউ হয়তো অনেকবার। আপনাদের সবার কাছে একটি কথাই জিজ্ঞাসা করতে চাই, হজের আগের জীবন আর হজের পরের জীবনের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে, তবে হজের বিশেষত্ব কোথায় বলুন? হজ মানে কি বছর বছর দুর্নীতি, অন্যায়ের সমুদ্রে ডুবে থেকে মক্কা নামক নদীর পানিতে ডুব দিয়ে এলাম আর সব গুনাহ মাফ হয়ে গেল? যদি তাই হতো তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন আরাফার ময়দানে লাখো উম্মত থেকে পাপ না করার ওয়াদা নিয়েছিলেন? কেন তিনি সুদ, দুর্নীতি, মানবতার অপমানের মতো অন্যায়গুলোর ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন? তিনি তো বলতে পারতেন, তোমরা হজ করে ফেলেছ, এখন আর তোমাদের কোনো গুনাহ নেই। যেমন খুশি জীবনযাপন করো। না, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এতদিন পর্যন্ত যে যা অন্যায় করেছ, সব মাফ। এখন থেকে সাচ্চা মানুষ হয়ে যাও। খাঁটি মুমিন হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা কর। তবেই তোমাদের জন্য আল্লাহর জান্নাত অপেক্ষা করবে।

প্রিয় হাজী ভাইয়েরা! আবার আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই, হজ মানে হলো ইচ্ছা করা। শপথ করা। দীর্ঘ এক মাসের ট্রেনিংয়ে আপনি ভালো হবেন শুধু এই শপথ করে এসেছেন। এখন আপনার চলাফেরার ওপর নির্ভর করবে, আপনি আরাফার ময়দানে ভালো মানুষ হওয়ার যে ইচ্ছা করেছেন, তা সঠিক ছিল নাকি লৌকিকতা আর কপটতায় পূর্ণ ছিল। আমরা বিশ্বাস করি, আপনি আন্তরিকভাবেই খাঁটি মানুষ হওয়ার শপথ নিয়েই মক্কার অলিগলি ঘুরে নবিজির রওজা থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে হজের শপথ বাস্তবায়নের তাওফিক দিন। খাঁটি মানুষ হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার তাওফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি

               www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর