বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শিক্ষকরা শিক্ষাব্যবস্থার মূল নিয়ামক

অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

শিক্ষার কথা বললে প্রথমেই যে কথাটি আসে তা হলো শিক্ষক। কারণ শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষাব্যবস্থার মূল নিয়ামক। শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উৎকর্ষ নির্ভর করে শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার ওপর। জাতি গঠনে ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম শিক্ষা। আর শিক্ষকই হলেন শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সে কারণেই ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে প্রণীত হয় শিক্ষকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা এবং পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ১৪৬ ধারা ও উপধারা বিশিষ্ট সনদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার ঘোষণা থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং ইউনেস্কো-আইএলওর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই অর্জিত হয়েছে এই ঐতিহাসিক দলিল।

জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে দলিলটির যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তৎকালীন বিশ্বের ১৪৭টি দেশের ২১০টি শিক্ষক সংগঠনের প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারীর প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’-এর ক্রমাগত অনুরোধ ও আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর থেকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হচ্ছে। সেই হিসেবে এ বছর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে ২৪তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ঞযব ৎরমযঃ ঃড় বফঁপধঃরড়হ সবধহং ঃযব ৎরমযঃ ঃড় ধ য়ঁধষরভরবফ ঃবধপযবৎ’ শিক্ষার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের গুরুত্ব সর্বাধিক। সম্প্রতি আমাদের দেশে খুব সীমিত আকারে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সত্য কিন্তু আজও পরিপূর্ণ মর্যাদায় দিনটি পালিত হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে, এ বিষয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগই নেই।

শিক্ষকতাকে নিছক চাকরি মনে করলে ভুল করা হবে। কেবল মেধা ও শিক্ষগত যোগ্যতাই আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার মহতী চেতনা ও উপলব্ধি তাকে শিক্ষাদানের পবিত্র দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষকের চাওয়া-পাওয়া সীমিত। একজন আদর্শ শিক্ষক সহজ, সরল, নিরহংকার, কর্তব্যনিষ্ঠ, নিস্বার্থ, নির্ভীক ও গতিশীল মনের অধিকারী পন্ডিত ব্যক্তি। নিজের অর্জিত জ্ঞানভা-ারকে তিনি সমৃদ্ধতর করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা বিতরণ করেন। তার কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস পরিশ্রম, কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস। কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে তিনি কখনই কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করেন না বা নিজের ব্যর্থতার জন্য কোনোরূপ অজুহাত সৃষ্টি করেন না। তার পার্থিব চাহিদা সীমিত, কিন্তু তার স্বপ্ন সীমাহীন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসুরূপে গড়ে তোলাই হবে শিক্ষকদের দায়িত্ব। শিক্ষক আন্তরিকতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, অনুশীলন প্রস্তুত, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন এবং সহপাঠক্রম কাজ পরিচালনা করবেন। শিক্ষক এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবে, যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষকের (প্রাইভেট টিউটর) প্রয়োজন না হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা শিক্ষকগণ কতটুকু সচেতন? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটুকু যত্নবান?

পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদের পেশাগত অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শিক্ষানীতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। লজ্জাজনক হলেও সত্য, স্বাধীন বাংলাদেশে আজও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাজমান।

শিক্ষকতাকে যখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি উপযুুক্ত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার তখন অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলেই শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের সব ধরনের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকের নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে না হয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির কোনো সুযোগই নেই। সৌভাগ্যবান কেউ কোনো মতে এক ধাপ এগোলেও পরবর্তী সব ধাপ বন্ধ। বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের স্বাদ বেসরকারি শিক্ষকগণ আজও পায়নি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। আর গবেষণা করার সুযোগের কথা কল্পনাও করতে পারে না বেসরকারি শিক্ষকগণ। বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি গঠনে অসঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে রাজনৈতিক প্রভাবে যেমন বেসরকারি শিক্ষকের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই, তেমন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘিত হয়। বেসরকারি শিক্ষকদের নেই কোনো আবাসিক ব্যবস্থা বা প্রয়োজনীয় আবাসন ভাতা। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দর মানসম্পন্ন পরিবেশে বসবাস করার বিষয়টি আজও তাদের কাছে স্বপ্নবিলাস হয়ে রয়ে গেছে। চিত্তবিনোদনের বিষয়টি শিক্ষকরা কল্পনায়ই আনতে পারেন না। বেসরকারি শিক্ষক পান না কোনো সম্মানজনক উৎসব ভাতা ও ভ্রমণ ভাতা। সামগ্রিক ব্যবস্থা বিশ্লেøষণ করলে এ কথাই বলতে হয় যে শিক্ষা ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় বিচার না থাকায় শিক্ষকদের সামনে চলার জন্য অনুপ্রেরণার মতো কিছু নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে অবিলম্বে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা হোক এবং বৈষম্যহীন এক ও অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার করা হোক বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে এই প্রত্যাশা করি।

লেখক : প্রাক্তন ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর