শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মানবতার জননীর বাহাত্তরের সাতকাহন

গোলাম মাওলা রনি

মানবতার জননীর বাহাত্তরের সাতকাহন

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে কোনো কিছু লেখা যে কোনো লেখকের জন্য রীতিমতো ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর লেখক যদি আমার মতো হাভাতে রাজনীতিবিদ কাম অকালকুষ্মা- প্রকৃতির বিদ্যা-বুদ্ধি সংবলিত মাকাল ফল হন তাহলে তো কথাই নেই হাজারো বিপদ-বিপত্তি, দুর্ভোগ-দুর্দশা ও শত মুখের ভর্ৎসনায় তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। অতীতকালে বহুবার আমি তাঁকে নিয়ে অনেক নিবন্ধ লিখেছি। সরকারবিরোধীরা নানা কুটবাক্যে আমাকে জর্জরিত করেছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর শুভার্থীদের একজনও উৎসাহমূলক কিছু করেননি বরং কিছু সাধারণ নেতা-কর্মী টিপ্পনী কেটে বলেছেন, ওরে হতভাগা! যতই তেল মারিস! কাজ হবে না; তুই আর কোনো দিন নমিনেশন পাবি না। তুই জামায়াতে যা, নইলে বিএনপিতে যোগ দে। আর না হলে গলায় দড়ি দিয়ে মর! মরার পরে কাদের মোল্লার সঙ্গে উস্তাভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে নিস কিন্তু।

আমি মাঝেমধ্যে আশ্চর্য হয়ে ভাবী কেন বঙ্গবন্ধুকন্যা সম্পর্কে নিখাদ প্রশংসাসূচক নিবন্ধ লিখলে লোকজনের অন্তর্জ্বালা হয়। তাঁর প্রতিপক্ষ কিংবা বিরোধীরা হয়তো তাঁকে ঈর্ষা করেন, কিন্তু তাঁর নিজের দলের কেউ যদি তাঁর প্রশংসা করেন তবে অন্যরা কেন শত মুখে টিটকারি আরম্ভ করে দেন! কেন তাঁর তথাকথিত শুভার্থীরা লোক হাসানো এবং অন্যের বিরক্তি উৎপাদনকারী স্থূল প্রশংসাবাদ দিয়ে তাঁর জীবন ও কর্মের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করে গ্রহণযোগ্য কিছু করতে উদ্যোগী হচ্ছেন না। তাঁর কর্মময় জীবনে অর্জিত বহু উপাধি, অনেক রকম ডিগ্রি ও কাজের স্বীকৃতিসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও প্রণিধানযোগ্য বিষয়গুলো নিয়ে সুখপাঠ্য কোনো পুস্তিকা পৃথকভাবে অথবা সমন্বিতভাবে আজও কেউ রচনা করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁকে জননেত্রী ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা রূপে প্রায়ই অভিহিত করে নানা বক্তৃতায় মঞ্চ কাঁপান অথবা স্লো গানে রাজপথ মুখরিত করে তোলেন। সেই আশির দশক থেকে আমরা উপাধি দুটি শুনে আসছি এবং রাজনীতির গত চার দশকের পথ-পরিক্রমায় ওই দুটি উপাধি সর্বজনীনভাবে জনমানসে স্থান করে নিয়েছে। ফলে ওগুলো উচ্চারিত হলেই মানুষ শেখ হাসিনাকেই বুঝে থাকে।

সাধারণ মানুষ যদি আওয়ামী লীগের লোকজনকে জননেত্রী ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা উপাধির ইতিহাস এবং উপাধির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করে তবে কতজন তা প্রাণবন্তভাবে গ্রহণযোগ্য আকারে প্রশ্নকর্তার সামনে ব্যাখ্যা করতে পারবেন তা আমার জানা নেই। তবে আমার সন্দেহ বেশির ভাগ নেতা-কর্মী লা জবাব হয়ে যাবেন। কারণ দলীয়ভাবে এযাবৎকালে প্রধানমন্ত্রীর সুনাম, সুখ্যাতি ও স্বীকৃতির প্রচার, প্রসার এবং সংরক্ষণের জন্য প্রামাণ্য কিছু করা হয়নি। পৃথিবীর নামকরা বহু বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিদেশি রাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং ভুবনবিখ্যাত বহু প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বিভিন্ন ডিগ্রি, উপাধি, স্বীকৃতি ও সনদ লাভ করেছেন, যা সমসাময়িক বিশ্বের অন্য কোনো সরকারপ্রধান কিংবা রাজনৈতিক দলপ্রধানের নসিবে জোটেনি। প্রধানমন্ত্রীবিরোধীরা সময়-সুযোগ পেলেই ওসব ডিগ্রি, সনদ ও স্বীকৃতি নিয়ে টিপ্পনী কাটার সুযোগ পান। কারণ আমরা ওগুলোর গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার যেমন চেষ্টা করিনি তেমন ওগুলো যে ব্যক্তি শেখ হাসিনার পাশাপাশি দেশ-জাতি, সমকালীন সময় ও আমাদের রাজনীতিকে সম্মানিত করেছে তাও যথাযথ আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা নিয়ে জনগণের মাঝে প্রচার করতে পারিনি।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একশ্রেণির কর্মী-সমর্থক ও নেতা রয়েছেন যারা কেবল ক্ষমতাপ্রাপ্তি, স্বার্থসিদ্ধি, ব্যক্তিগত লাভ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মানসম্মান অর্জনের উপলক্ষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ব্যবহার করেন। আরেক শ্রেণির নেতা-কর্মী আছেন যারা সব সময় শরীর-মন, চিন্তা ও চেতনায় মহাদুর্ভিক্ষের বিভীষিকা ধারণ করে সারাক্ষণ খিস্তিখেউর করে বলতে থাকেন এটা পেলাম না, ওটা পেলাম না! ও কেন পেল? আমাকে কেন দেওয়া হলো না? অথবা গতকাল দিল, আজ তো দিল না ইত্যাদি। এ দুটি শ্রেণি ছাড়াও নেতিবাচক চিন্তা-চেতনাধারী, অতি আঁতেল, অতি সৎ, অতি যোগ্যতাসম্পন্ন আত্মস্বীকৃত বিশেষজ্ঞ, বেইমান, মোনাফেক, প্রতারক, ধোঁকাবাজ, ফাঁকিবাজ, বাচাল, বিশ্বাসঘাতক প্রভৃতি শ্রেণির লোকজন দলের কোটি কোটি সাধারণ ভক্ত, অনুরক্ত, কর্মী ও নেতাদের হররোজ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার জন্য দেদার কাজ করে যাচ্ছে। ফলে আওয়ামী লীগের ভিতরে ও বাইরে সহসাই একটি উত্তপ্ত জটিল রসায়ন কাজ করে অনেকটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। কাজেই এ দলটির প্রধান কর্তাব্যক্তির চেয়ারটি ততটাই উত্তপ্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে যতটা উত্তপ্ত ও ঝুঁকপূর্ণ হবে যদি আপনি মাউন্ট ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখে চেয়ার পেতে আরাম ফরমাতে চান।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতিরূপে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি। সে হিসেবে সভাপতির উত্তপ্ত চেয়ারে বসার সময়কাল হলো প্রায় ৩৮ বছর। এ সুদীর্ঘ সময়ের বহু ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, দুর্ভোগ-দুর্দশা, সম্মান-স্বীকৃতি, অপমান-লাঞ্ছনা, মানুষের বিশ্বাস-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, ব্যক্তিবিশেষ ও শ্রেণিবিশেষের শত্র“তা, আক্রমণ এবং অপমান, রোগ-শোক, সুখ-শান্তি, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও মানবিক বিষয় দ্বারা তিনি পরিপক্ব হয়েছেন এবং মানুষ হিসেবে ধীরে ধীরে সফলতা, সার্থকতা ও পূর্ণতার পথে বিকশিত হয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে গত ৩৮ বছরে বহু কিছুর উত্থান যেমন হয়েছে, তেমন তাঁকে শেষ করতে গিয়ে অনেকের এবং অনেক কিছুর যবনিকাপাত ঘটেছে। তাঁর জীবন রক্ষার জন্য অনেকে যেমন নিজের প্রাণটি বিসর্জন দিয়েছেন, তেমন তাঁর জীবননাশ করতে এসে অনেকেই আজরাইলের মোলাকাত লাভ করে কবরবাসী হয়েছেন। গত ৩৮ বছরে তিনি বহু ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, অনেক ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন এবং অনেক ঘটনার বিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বহু সংগ্রাম-লড়াইয়ের জম্ম  দিয়েছেন, আবার বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। তিনি অনেকের মনে বেঁচে থাকার বাসনা জাগ্রত করেছেন এবং বহু শত দুর্বৃত্তের জীবনে এমন বিভীষিকা এনে দিয়েছেন যাদের কাছে সমাজ-সংসার ও বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যার জম্ম , বেড়ে ওঠা, বিদ্যার্জন, সংসার জীবন এবং রাজনীতি ইতিহাসের তিনটি কালকে স্পর্শ করেছে। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি যখন জম্মেম ছিলেন তখন এ দেশে ব্রিটিশ রাজ কায়েম ছিল। ’৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরা পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিলেও তা হাতে-কলমে কার্যকর করতে পরবর্তী কয়েক মাস কেটে যায়। এই হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর জম্ম  তারিখে এ বাংলায় ব্রিটিশ প্রশাসন কার্যকর ছিল যদিও কাগজ-কলমে তা ছিল স্বাধীন পাকিস্তান। পরবর্তীকালের পাকিস্তান জমানার উত্তাল গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ, ’৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকা-, সুদীর্ঘকালের প্রবাসজীবন এবং জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে ফিরে আসার ঘটনার মধ্যে তাঁর জন্য যে নির্মম অভিজ্ঞতা, বাস্তব শিক্ষা, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্দয় ও অমানবিক প্রহসনের বীজ পুঁতে রাখা হয়েছিল তা কালের বিবর্তনে যে বৃক্ষে পরিণত হয় সেই বৃক্ষ থেকে সুমিষ্ট মানবতার ফল ফলানো যে কতটা অসাধ্য এবং কষ্টকর তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারেন।

বহুমুখী বাস্তব অভিজ্ঞতা, নির্মম প্রেক্ষাপট, সময়ের নিষ্ঠুর পদাঘাত, আপনজনদের বেইমানি ও বিশ্বাসঘাতকতা, প্রিয়জনের তাচ্ছিল্য এবং অপমানের কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যার চোখ পরিণত হয়েছে সেই রূপকথার মহারাজার মতো যিনি দেবতার আশীর্বাদে এমন এক দিব্যদৃষ্টির অধিকারী হয়েছিলেন যার সাহায্যে তিনি তাঁর আশপাশের লোকজন, বিশ্বস্ত সহচর ও আপনজনদের দিকে তাকিয়ে অনায়াসে তাদের মনের কথাগুলো বলে দিতে পারতেন। রাজার মৃত্যু কামনাকারীরা যখন তাঁর সামনে এসে প্রশংসা করত তখন রাজা আপন মনে হাসতেন এবং ইঙ্গিতপূর্ণ কবিতা রচনা করতেন, যা শোনামাত্র সম্ভাব্য আততায়ীর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠত। তারা রাজদরবার থেকে পালিয়ে যেতেন, নতুবা রাজার সামনে আসতে ভয় পেতেন। রাজা তার দিব্যদৃষ্টির কারণে অনায়াসে দেখতে পেতেন, তার শত্র“দের অন্তর তার পরাজয় কামনা করে কিন্তু তার আত্মীয়স্বজন ও সুবিধাভোগীদের অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ ও কলহ-বিবাদে টইটম্বুর হয়ে তার মৃত্যু কামনায় উথাল-পাথাল করে। ফলে রাজা একসময় ক্লান্ত হয়ে দেবতার কাছে তার দিব্যদৃষ্টির ক্ষমতা ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু দেবতা সাধারণত কোনো দান ফেরত নেন না বলে তিনি রাজার প্রজাদের মনের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ফলে তারা রাজাকে বুঝতে আরম্ভ করল এবং নিজেদের কুৎসিত চিন্তা বাদ দিয়ে রাজাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে অভ্যস্ত হয়ে গেল।

আমি জানি না আমাদের দেশের কতজন মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সুখ, মান-অভিমান, কষ্ট-বেদনা এবং তাঁর সত্যিকার মন-মানসিকতা, চাওয়া-পাওয়া ও ইচ্ছাশক্তিকে মূল্যায়ন করতে পারেন। তাঁর হাসির পেছনে যে কত কান্নার পাহাড় রয়েছে অথবা তাঁর মানবিক কর্মের পেছনে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতম অমানবিক ঘটনার পুঞ্জীভূত মেঘমালা রয়েছে তা নিয়ে আমরা সাধারণত চিন্তা-ভাবনা করি না। পিতা-মাতা, ভাই, ভ্রাতৃবধূ, চাচা, ফুফা প্রমুখ আপনজনের খুনিরা যখন তাঁর সামনে দম্ভ করে অথবা ওইসব খুনির মানসপুত্র-কন্যারা যখন তাঁর জন্য বিশ্বাসঘাতকতাময় ভালোবাসার মালা গেঁথে কুম্ভীরাশ্র“ বর্ষণ করে তাঁর সামনে সমব্যথী হওয়ার ভান করে তখন তাঁর মনের মধ্যে কী অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে আমরা সাধারণত চিন্তা-ভাবনা করি না। আমরা তাঁর বয়স, সীমাবদ্ধতা, অপারগতা ইত্যাদি নিয়েও মাথা ঘামাই না। আমরা কেবল আমাদের সব অভাব, অভিযোগ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, ঘৃণা-বিদ্বেষ, না পাওয়া অথবা না পারার ব্যর্থতা তাঁর ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাঁর সমালোচনা করি অথবা তাঁর অমঙ্গল কামনায় বিভোর হয়ে উঠি। তিনি আমাদের এতসব জঞ্জাল পরিষ্কার করে অথবা সেগুলোকে পা মাড়িয়েই গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে একাত্তর বছর অতিক্রম শেষে বাহাত্তরে পা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর শুভার্থীরা যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের পছন্দ, মেজাজ-মর্জি ও স্বার্থের দিকে নজর রেখে তাঁর বাহাত্তরতম জম্ম  দিনটি পালন করেছেন। দলীয়ভাবে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন। অনেকে আবার বিজ্ঞাপন, ব্যানার, পোস্টারে নিজের ছবি সেঁটে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জম্ম  দিনকে প্রচার করেছেন। সরকার সমর্থক টেলিভিশনগুলোয় বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রভাবশালী ও চতুর মন্ত্রী-এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ধর্মালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করেছেন, যা বিগত দিনের তুলনায় ব্যাপক আকারে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ও নিরেট ভক্তরা রোজা রেখে আল্লাহর দরবারে বিশেষ প্রার্থনার মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এবারের জম্ম  দিনটি নানা কারণে তাৎপর্যময় ও অর্থবহ হয়ে উঠেছিল যার মাধ্যমে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নিজ দলে তিনি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য, জনপ্রিয় এবং ভালোবাসার পাত্রীতে রূপান্তরিত হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী চক্র ও তাঁর ব্যক্তিগত শত্র“দের ঈর্ষার অনলে ঘি ঢেলে দিয়েছেন।

আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা শিরোনাম নিয়ে কিছু বলে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সুদীর্ঘ একাত্তর বছরের জীবনে বহু উপাধি, ডিগ্রি ও সনদ লাভ করেছেন, যার যথার্থতা ও উপযোগিতা নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি উপাধির রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ। তাঁর উপাধিগুলো অর্জনের পেছনে তিনি ব্যয় করেছেন তাঁর মেধা, ঘাম এবং শ্রম। তাঁর বিচক্ষণতা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, ঝুঁকি নেওয়ার প্রচ- ক্ষমতা, চারপাশের সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার বিচক্ষণতা এবং সাহসও নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। সর্বোপরি অনুপম নেতৃত্বগুণ, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সময় ও সুযোগের সমন্বয় করে তা কাজে লাগানোর দক্ষতার কারণে তিনি অনায়াসে তাঁর সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে গেছেন, সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন এবং সফলতার স্বর্ণমুকুট মাথায় পরে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, রুখে দাঁড়ানোর ব্যতিক্রমী পদ্ধতি, আক্রমণ ঠেকানোর শক্তিমত্তা, সাধারণ মেধা-মস্তিষ্কের কল্পনাতীত বিচার-বুদ্ধি এবং পরিকল্পনার কারণে অনেক বিজয়মাল্য তাঁর গলায় উড়ে এসেছে। তাই তাঁকে হিংসা করা, তাঁকে অভিসম্পাত করা বা সমালোচনা করা যত সহজ তার চেয়েও বেশি কঠিন প্রশংসা করা। কারণ নিখাদ প্রশংসা করার জন্য সবার আগে শেখ হাসিনাকে বোঝার মতো মানসিক সক্ষমতার পাশাপাশি ইচ্ছা-অনিচ্ছা-মেধা সমন্বিত একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর অনেক উপাধির মধ্যে মানবতার জননী উপাধিটি সাম্প্রতিককালে তাঁর বিজয় মুকুটে সন্নিবেশিত হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এই একটি উপাধিই তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রাখবে এবং তা মহান আল্লাহর অপার করুণা ও দয়ালাভের উপলক্ষ হতে পারে। তাঁর সারা জীবনের দুঃখ-কষ্ট, আঘাত এবং বিরল অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে নিজের মন ও ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানবিক কিছু করা সত্যিকার অর্থেই জিহাদের শামিল। চারপাশে পিতার খুনিদের প্রেতাত্মা, নিজের আততায়ীদের আনাগোনার গুনগুনানি, মানুষরূপী শয়তানদের জাহান্নামি তা-ব এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অন্তরালের ভয় ধরানো নানান ষড়যন্ত্র, গুজব ও ভয়ভীতিকে কবর দিয়ে সেই কবরের ওপর মানবতার ফলবান বৃক্ষ রোপণ করে তাতে ফুল, মুকুল ও ফলের সমাহার ঘটানোর জন্য বিনিদ্র পরিশ্রম মহাকালের খুব অল্পসংখ্যক মানব-মানবীই করতে পারেন। রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে টানা ১০ বছর থেকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যাসংকুল, অধিক জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া দেশের রাজনীতির প্রধান কর্তা হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে মানবতার জননী উপাধি লাভ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। আমরা কারা তাঁর এ উপাধিকে ধারণ করতে পারব এবং কারা ধারণ করতে পারব না বা করব না তা একান্তই আমাদের রুচি, শিক্ষা, মন-মানসিকতা, পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিক চরিত্র ও জম্ম  বৃত্তান্তের ওপর নির্ভর করে। প্রায় ১১ লাখ নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং মানবেতরভাবে বিতাড়িত উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বের স্বনামধন্য সংবাদপত্রসহ অন্যান্য গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতার জননী বলে অভিহিত করেছেন। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এই অধম লেখকও রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। কারণ একটি সুদূরপ্রসারী আন্তর্জাতিক চক্রের ভয়াবহ আঞ্চলিক রাজনীতির চক্রান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে; যা সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের জন্য সব দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকন্তু টেকনাফ, কক্সবাজার ও উখিয়া অঞ্চলে পূর্ব থেকে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের ওপর জামায়াত-শিবিরের একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল। তা ছাড়া ইয়াবা চোরাচালান, সীমান্ত সন্ত্রাস ও স্থানীয় শান্তি বিনাশের বহু শত অভিযোগ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ছিল। এত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কেবল মানবিকতার কারণে মানবতার সুমহান বাণীগুলোকে জমিনে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে এবং বিশ্বের একটি নিপীড়িত মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সর্বোচ্চ সাহস, শক্তি, ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শন করে নিজের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর শত্র“রা যা-ই বলুন না কেন, মানবতার জননী হিসেবেই বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মন-মস্তিষ্ক, শান্তিকামী দরদি মানুষের হৃদয়, জ্ঞানী ব্যক্তিদের জবানি ও কলমে তিনি অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর