শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

দীনি শিক্ষার গুরুত্ব ও মর্যাদা

মাওলান মুফতি মিজানুর রহমান
সিনিয়র পেশ ইমাম

সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষকেই আল্লাহতায়ালা জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দান করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ যেমন তার পার্থিব প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা আবিষ্কার করতে পারে তেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সফলতা-ব্যর্থতার জ্ঞানও ধারণ করতে পারে। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর এ যোগ্যতা নেই। তাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ তাদের সঙ্গেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা দান করে। শিক্ষার মাধ্যমে অজানাকে জানার ও জানা বিষয়কে কাজে লাগিয়ে অজানার সন্ধান করার যোগ্যতা একমাত্র মানুষেরই আছে। তাই পৃথিবীর শাসন ও নিয়ন্ত্রণের ভার তাদের ওপর অর্পিত।

দীনি শিক্ষার গুরুত্ব : ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। হেরা গুহায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম যে ওহি নাজিল হয় তা হচ্ছে, ‘পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপি- থেকে।’ সূরা আলাক, আয়াত ১-২। আল্লাহতায়ালার আদেশে মানুষ যেমন লাভ করেছে জীবনের আলো, তেমন আল্লাহর কাছ থেকে সে লাভ করেছে ইলমের নূর (জ্ঞানের আলো)। ইলমের মাধ্যমে মানুষ নবজীবন লাভ করে। আল্লাহর মারিফাত যখন মানুষের মধ্যে আসে তখনই সে প্রকৃত মানুষ হয়। দুনিয়ার নিজাম ও ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য যেমন জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমন দীনের হেফাজতের জন্য এবং দুনিয়ার সব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক হওয়ার জন্য দীনি শিক্ষার প্রয়োজন। মুসলিম সমাজের সব শ্রেণির মানুষ যেন দীন মোতাবেক চলতে পারে এবং হারাম থেকে বেঁচে হালালভাবে জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য কোরআন-সুন্নাহয় পারদর্শী একটি দল বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেন বের হয় না প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একটি দল, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান (তাফাক্কুহ) অর্জন করে এবং ভীতি প্রদর্শন করে তাদের জাতিকে যখন তারা ফিরে আসে তাদের কাছে। সম্ভবত তারা আল্লাহভীতি অর্জন করবে।’ সূরা তাওবা, আয়াত ১২২। এমনিভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইলমে দীন অর্জন করাকে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর বাধ্যতামূলক করে বলেছেন, দীনি ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। এজন্য প্রত্যেক জনপদে দীনের ইলমে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান থাকা ফরজে কিফায়া। আর এ উদ্দেশ্যে দীনের জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখা সমাজের অপরিহার্য কর্তব্য। কোরআন-সুন্নাহর চর্চা ও অনুসরণের অভাব হলে সমাজের সব অঙ্গনে দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক, ইমান ও আল্লাহভীতি না থাকলে তা মানুষের ক্ষতি ও অকল্যাণে ব্যবহার হবে। মানুষের সব আবিষ্কারকে অর্থপূর্ণ ও কল্যাণমুখী করার জন্যই অপরিহার্য প্রয়োজন ইলমে ওহির চর্চা। তদ্রুপ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবিকলভাবে সংরক্ষণের জন্য কোরআন-সুন্নাহর বিশেষজ্ঞ তৈরি করা অপরিহার্য। ইসলামের অপব্যাখ্যা ও বিভিন্ন বাতিল মতবাদের স্বরূপ উম্মোাচন করে সঠিক ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী চিন্তাধারা পরবর্তী প্রজম্মে র কাছে পৌঁছে দেওয়াও আলিমদের কর্তব্য। এ বিষয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক প্রজম্মে র ন্যায়নিষ্ঠ লোকেরা দীনের এ ইলমকে ধারণ করবে। তারা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি, বাতিল-পন্থিদের মিথ্যাচার ও মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে একে রক্ষা করবে।’ বায়হাকি।

দীনি শিক্ষার মর্যাদা : এ শিক্ষার বিষয়বস্তু যেহেতু সরাসরি দীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই এর মর্যাদাও অন্যান্য শিক্ষার তুলনায় বেশি। নিচে এ-সংক্রান্ত কিছু আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা হলো : ১. আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন বহুগুণ।’ সূরা মুজাদালা, আয়াত ১১। ২. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে কোরআন শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়।’ বুখারি। ৩. আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষার জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তার জান্নাতের পথ আসান করে দেন।’ মুসলিম। ৪. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করে দিন, যে আমার কোনো হাদিস শুনেছে। অতঃপর অন্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।’ আবু দাউদ। ৫. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান তাকে দীনের প্রজ্ঞা দান করেন।’ বুখারি। ৬. অন্য হাদিসে আছে, ‘আলিমরা নবীদের ওয়ারিশ।’ তিরমিজি। ৭. আরেক হাদিসে এসেছে, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ইলম অনুসন্ধানে বের হয় সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় থাকে।’ তিরমিজি। তবে দীনি ইলমের উপরোক্ত ফজিলত লাভের জন্য শর্ত হলো ইখলাস। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ ইলম অর্জন করতে হবে। পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে তা অর্জন করা যাবে না। পার্থিব সুনাম-সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে দীনি ইলম অর্জন করা হলে তার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদিসে এসেছে, ‘জাহান্নামে সর্বপ্রথম নিক্ষিপ্ত তিন ব্যক্তির একজন হবে ওই আলিম, যে লোকের কাছে আলিম হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জন্য ইলম চর্চা করেছে।’ অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন ইলম শিখল, যা শুধু আল্লাহর জন্যই শেখা হয় সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।’ আবু দাউদ।

সর্বশেষ খবর