রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মিকচার খাওয়ার সেই দিনগুলো

মাকিদ হায়দার

মিকচার খাওয়ার সেই দিনগুলো

ঈশ্বরের একদিন ইচ্ছে হলো, তিনি তারই সৃষ্টি ঝাঁপির ভিতরে কী কী রেখেছিলেন খুলে দেখতে। ঝাঁপি খুলতেই প্রথমে বেরিয়ে এলো আগুন, সাপ, বাঘ, বন্য জন্তু-জানোয়ার। তাদের পেছনে এলো হাজার রকমের  অসুখ-বিসুখ। সুখ না এসে, এলো দুঃখ এবং নিয়তি। ঈশ্বর জানতে চাইলেন, সুখ কোথায় গেল, ঝাঁপির ভিতর থেকে সুখ জানিয়ে দিল আমি বের হব কী হব না, সেটি ভেবে দেখি, কাজের ভিতরে দেখছি তোমার সৃষ্টি মানুষকে সুখী করা, তাই একটু সময় দিতে হবে আমাকে। ঈশ্বর হাসলেন ঠিক সে মুহূর্তেই তিনি লক্ষ্য করলেন, সাপ, বাঘ, বন্যপ্রাণীরা অদৃশ্য হয়ে গেলেও অদৃশ্য হলো না জ্বরা এবং দুঃখ, ঈশ্বরকে তখন একটু ভাবতে হলো, কাকে কী বলবেন, ভাবনা শেষে দুঃখকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কার অপেক্ষায় আছ? দুঃখ তখন ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানাল, সুখ আর আমি দীর্ঘকাল তোমার ওই ঝাঁপির ভিতরে পাশাপাখি ছিলাম, সুখ যদি ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে না আসে, তাহলে আমাকে অনুমতি দাও আমি ঝাঁপিতে গিয়ে সেই আগের মতো পাশাপাশি বসবাস করি। ঈশ্বর এবার বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর থাকার পরে সুখকে অনেক অনুনয়ের পরে ঝাঁপি থেকে বেরিয়েই জানতে চাইল আমাকে ঝাঁপি থেকে কেন ডেকে আনলেন, আমি তো ভালোই ছিলাম ঝাঁপির ভিতরে। ঠিক তখনই একজন দেবদূত এসে ঈশ্বরের কানে কানে কী যেন বলায় ঈশ্বর ঝাঁপির মুখ বন্ধ করে দিলেন। তখন আর কী করা। সুখ-দুঃখ দুজনাই নেমে এলো স্বর্গ থেকে মর্তে। দূরে বসে হাসছিল আগুন। জ্বরা। অসুখের বা জ্বরার হাসি দেখে দেবদূত জানতে চাইল তোমার যদি কিছু বলার থাকে নির্ভয়ে বলে ফেল। নির্ভয়ে বলার অভয় পেয়েই আগুন তখনই জানিয়ে দিল ঈশ্বরের পৃথিবী যতদিন থাকবে আমি ততদিন দ্বিপদ চতুষ্পদ প্রাণিকুলের দেহে বসবাস করতে চাই। দেবদূত হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল তাকে বলতে না দিয়ে ঈশ্বর কিছুটা সময় পরেই বললেন, ঠিক আছে তোমার ইচ্ছাই পূরণ হোক। জ্বরা দেরি না করে স্বর্গ থেকে দ্রুত পায়ে মর্তে নেমেই দেখতে পেল হাজার কোটি দ্বিপদ, চতুষ্পদ ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক।

এমন সময় দেবদূত দেখল ঝাঁপির পেছনে লুকিয়ে আছে ‘শান্তি’। শান্তিকে ডেকে ঈশ্বর জানতে চাইল তুমি লুকিয়ে ছিলে কেন? মৃদু হেসে শান্তি জানিয়ে দিল তোমার সুখ ঝাঁপি থেকে বেরোনোর সময় আমাকে জানিয়েছিল, তুই গিয়ে লুকিয়ে থাক। তোকে যেন কেউ দেখতে না পায়। আমি সুখের কথানুসারে লুকিয়ে ছিলাম ঝাঁপির পেছনে। ঈশ্বর নিশ্চুপ থাকলেন। তখন দেবদূত জানাল তোমাকেও মর্তে যেতে হবে। আমি যেতে পারি, আবার নাও যেতে পারি, সেটি আমার ইচ্ছে। দেবদূত উচ্চকণ্ঠে কিছু বলতেই ঈশ্বর তাকে থামিয়ে দিয়ে শান্তিকে জানিয়ে দিল তোমার ঝাঁপি আমি ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছি। স্বর্গে আর তোমার থাকবার কোনো সুযোগ নেই। হয়তো দেখেছ আগুন, সাপ, বাঘ, সুখ, নিয়তি এবং অসুখকে যেভাবে নামিয়ে দিয়েছি, তোমাকে’ কথা অসম্পূর্ণ রেখে তাকালেন দেবদূতের দিকে। দেবদূত বিনাবাক্য ব্যয়ে শান্তিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল স্বর্গ থেকে মর্তে।

গ্রিক উপখ্যানের আখ্যানগুলোতে বর্ণনাটা ওইভাবে দেওয়া আছে এবং বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকা মহাদেশে রোগ মহামারী এবং অন্য যেগুলোকে ঈশ্বর এবং দেবদূত নামিয়ে দিয়েছিল মর্তে, তার ভিতরে অসুখ-বিসুখের বিষয়ে বলা হয়েছে। রোগ হলে, তার প্রতিকারও পাওয়া যাবে মধ্যপ্রাচ্যে বা আফ্রিকার যে কোনো দেশ থেকে। সেদিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় আফ্রিকার বা মধ্যপ্রাচ্যের বিজ্ঞানীরাই যাবতীয় রোগ-শোকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, মানুষ জাতিকে অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষার জন্য। কিন্তু তাদের অনেক আগেই ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন গ্রিকের মি. হিটটোক্রাটাস এবং মি. ডেমোক্রিটাস। ডেমোক্রিটাস ছিলেন হিটটোক্রাটাসের গুরু। গুরুকে পেছনে ফেলে ছাত্র আবিষ্কার করেছিলেন একাধিক রোগের ওষুধ।

হাজার হাজার বছর পরে যখন চিকিৎসাবিদ্যা পৃথিবীতে এলো, তখনই চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রছাত্রীরা জানতে পারলেন, ৪৬০ থেকে ৩৭০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আবিষ্কৃত হয়েছিল ওষুধ শিল্পের অগ্রযাত্রা এবং দুই আবিষ্কারকের নাম।

আমি বিভিন্ন বইয়ে এবং ইংরেজি জার্নালে একাধিকবার উৎসাহী হয়ে ভেষজের গুণাগুণ জানতে পড়েছি ভেষজের কথা। ভেষজ সম্পর্কে উৎসাহী জেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান অনুষদের একটি পুস্তক কবি বিমল গুহ আমাকে দিয়েছিলেন। সেই পুস্তকের নির্দেশানুসারে ভেষজের উপকারিতা নিজে এখনো পেয়ে থাকি। বিশেষত নিম পাতার গুণাগুণ এবং রসুনের কার্যকারিতা ওই দুটি নিয়মিত খেলে শরীরের অনেক অসুখ-বিসুখ থেকে নিরাময় থাকা যায়।

গত শতকের কয়েকজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের ভিতরে পাবনা শহরের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিলেন শিশির ভৌমিক। পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকেই আমাদের অনুজ দাউদ হায়দারের ‘পার্নিসাস ম্যালেরিয়া’ হয়েছিল। শহরের একমাত্র এমবি ডাক্তার ছিলেন জনাব আবু ইসহাক। তিনি কার্যোপলক্ষে শহরের বাইরে থাকায় বা অন্যত্র রোগী দেখতে যাওয়ায়  তাকে না পেয়ে পিতা নিয়ে এসেছিলেন গোপালপুর মহল্লার শিশির কাকাকে। দাউদের বয়স তখন বছর পুরো হয়নি। পার্নিসাস ম্যালেরিয়া হলে সেকালে কেউই বাঁচাত না বলে কমবেশি সব পিতা মাতারই ধারণা ছিল। তার ব্যতিক্রম ছিলেন না আমাদের মা রহিমা খাতুন। শহরের জিলপাড়া মহল্ল­ার আমাদের যত আত্মীয়কুল এমনকি (কৃষ্ণপুর) কেষ্টপুর থেকে আমাদের মাতামহী কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলেন জিলপাড়ার বাড়িটির দোতলায়। অপরদিকে পিতামহী এবং দুই কাকা, কাকিমা সবাই এসেছিলেন। সবাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন খোকন আর বাঁচবে না। খোকনের ভালো নামই দাউদ হায়দার।

পিতা শিশির কাকাকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। আগেই পিতা জানিয়েছিলেন ডাক্তার কাকাকে খোকনের অসুখের কথা। ডাক্তার এবং পিতা দোতলার ঘরে যখন পা রাখলেন মা শুধু জানতে চেয়েছিলেন, খোকন বাঁচবে কি-না। সেই প্রশ্নের উত্তর ডাক্তার কাকা না দিয়ে নিজের ওষুধের ব্যাগ থেকে একটি খোদ জার্মানির প্রস্তুতকৃত জলীয় ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন নিজ হাতে এবং আমার মাকে বলেছিলেন, বৌদি ভগবানকে ডাকতে থাকুন। উপরন্তু ৪৮ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাবে না। পিতামহী-মাতামহীসহ কাকিরা এবং প্রতিবেশীদের পিতা অনুরোধ জানিয়েছিলেন এই ৪৮ ঘণ্টাই কোরআন শরিফ পড়তে এবং পাবনা শহরের বড় মসজিদের বড় মাওলানা সাহেবকে ডেকে এনে তাকেও অনুরোধ করেছিলেন তার অধীনস্থদের দিয়ে কোরআন পাঠ করাতে। ৪৮ ঘণ্টা পর খোকন চোখ মেলার পর পিতা-মাতা এবং আমাদের স্বজনরা সবাই বিশ্বাস করেছিলেন কোরআন তেলাওয়াতে খোকন চোখ মেলেছে এবং শিশির কাকার ওষুধেই কাজ হয়েছে। শিশির কাকার বড় ছেলে ভানুদা আর আমাদের মেজোভাই রশীদ হায়দার (দুলাল) ছাত্র ছিলেন পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের। ১৯৬৪ সালে পাবনা শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক হিন্দু তরুণ এবং বয়সীরা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন। তখনকার জেলা প্রশাসক বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করেন। শোনা যায়, আইউব এবং মোনেমের ইচ্ছায় ওই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল ঢাকা শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়। অনেক হিন্দু লেখক, বুদ্ধিজীবী এমনকি পুরান ঢাকার বিখ্যাত ডাক্তার নন্দীসহ অনেক হিন্দু সম্ভ্রান্ত পরিবার জম্ম ভূমি ফেলে কেউ গিয়েছিলেন জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি। তারপরেও যারা ছিলেন তারাও একদিন চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পরে। সেই ধারাবাহিকতায় ডা. শিশির পরিবারও পাড়ি দিলেন মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্ল­ার সুন্দর একতলা বাড়িটির বিনিময়ে তারা পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার আগে ডাক্তার কাকা এবং ভানুদা, দুজনাই এসেছিলেন পিতার সঙ্গে দেখা করতে। ভানুদা কেঁদেছিলেন রশীদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে। অনুরূপ একজন বয়স্ক লোককে আমি কাঁদতে দেখে আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। পিতার চোখেও দেখলাম পানিভেজা কণ্ঠস্বর।

শিশির কাকা মাতৃভূমি ত্যাগের আগে, সজল চোখে আমার পিতাকে বললেন, বৌদিকে একবার ডাকুন। মা এলেন, কাকা শুধু জানতে চাইলেন খোকন কোথায়। কণ্ঠস্বর মায়ের রুদ্ধ হওয়ার ফলশ্র“তিতে পিতা জানালেন ও বাড়িতে নেই। যতদূর আমার মনে আছে, ডাক্তার কাকা শুধু যাওয়ার আগে বলেছিলেন আর কোনো দিন দেখা হবে না। ভুল-ভ্রান্তি যদি কিছু করে থাকি তিনিও বাক্য শেষ করতে পারেননি সেদিন। ভিজেছিল চোখ দুটি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্রের হাত যশের কথা পিতা একদিন আমাদের শুনিয়েছিলেন। যদিও তিনি হোমিওপ্যাথ বা জার্মানির হোমিওপ্যাথির জনক মি. হ্যানিমেনের অনুসারী। হয়তো প্রকাশ্যে না থাকলেও তার দেওয়া হোমিওপ্যাথি খেয়ে আরোগ্য লাভ করেছিলেন অনেকেই। আমাদের দোহারপাড়ার যদুনাথ সাহার অসুখ নাকি যখন কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না, অসুখটা ছিল সেকালের বিখ্যাত ম্যালিরিয়া। তখন তাকে একবার যেতে হয়েছিল ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে। তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হননি। দেশ তখন ছিল ব্রিটিশ শাসনে।

যদুনাথ সাহার স্বজনরা ডাক্তার বিধান চন্দ্রকে বলেছিলেন, ডাক্তার বাবু আমরা পাবনা থেকে এসেছি। যদুনাথের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানতে পেরেছিলেন তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। কিছুটা সময় পরে ডাক্তার বিধান যুদনাথকে নাকি বলেছিলেন, তোমার বাড়ি থেকে একটি জলাশয়/ডোবার দূরত্ব কতখানি দূরে। আকস্মিক এই প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যদুনাথ জানিয়েছিলেন, বাড়ির পেছনেই আছে একটি ছোট জলাশয়। পরে আর বেশি জানতে না চেয়ে শুধু বলেছিলেন তোমার জালাশয়ের আশপাশে নিশিন্দা এবং নিমগাছ আছে কিনা? সাহা হ্যাঁ বলায় ডাক্তার রায় কোনো প্রকার হোমিও কিংবা অ্যালোপ্যাথ কিছু না দিয়েই বলেছিলেন এখন পৌষ মাস। পাবনায় গিয়ে সূর্যোদয়ের আগে প্রতিদিন তোমাকে ওই জলাশয়ে স্নান করতে হবে। জ্বর তোমার গায়ে/শরীরে যতই থাকুক না কেন স্নানের পরে সূর্য ওঠার বেশ কিছুক্ষণ পরে সূর্যের দিকে পিঠ রেখে এক সপ্তাহ পান্তা খাবে তার পরেও যদি ম্যালেরিয়া না ছাড়ে পুনরায় আসবে আমার কাছে। আমাদের পিতা শেষে বলেছিলেন ডাক্তার বিধান রায়ের যশ-খ্যাতি আরও বেড়ে গিয়েছিল দোহার পাড়াসহ পাবনা শহরের আশপাশে।

হাত যশের কথা এবার বলা যেতে পারে। আমার স্কুল জীবনের শেষ দিকে পাবনা শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন সীতামনি সাহা, এলএমএফ। তিনি শেলের টুপি মাথায় দিয়ে গ্রামগঞ্জে গিয়ে রোগীদের প্রায় বিনামূল্যে সেবা এবং ওষুধ দুটোই দিয়ে আসতেন। রোগীরা ভালো হলে রোগীদের বাড়ির আম, কাঁঠাল এবং মুরগি দিয়ে যেতেন ডাক্তার সীতামনির পাবনা শহরের নারিকেল বাগানের পূর্ব দিকের দোতলা বাড়িটিতে। সেই তিনিও ৬৪ এবং ৬৫ পরেও মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি। শেষঅবধি বোধ হয় গিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। স্বাধীনতার সামান্য কিছু আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে একজন মুসলিম এমবিবিএস বাড়ি বিনিময় করে শহরের বেলতলা মহল্ল­ার আরেক হোমিওপ্যাথ শিশির বাবুর বাড়িতে এসে উঠলেও পসারে খুব সুবিধে করতে পারেনি। কেননা এমবিবিএস ভদ্রলোকের ভিজিট ছিল চার টাকা আর এলএমএফ পরিতোষ সাহা, এলএমএফ আবুল হোসেন ও সিবরামপুরের ডাক্তার হারুন রশীদের ফি ছিল মাত্র দুই টাকা। স্বভাবতই সবাই যেতেন এলএমএফ দ্বয়ের কাছে। শহরের সোনাপট্টিতে ছিল ওই তিন এলএমএফের ঔষধালয়। তবে নিরিবিলি এই শহরের বাইরে গেলে এলএমএফ ডাক্তারেরা নিজের ফি নিতেন চার টাকা রিকশা ভাড়া দূরত্ব অনুসারে এক থেকে দুই টাকার ভিতরে।

আমাদের অনুজ জাহিদ দায়দার স্বপন একবার কাচারি ঘরের আড়া থেকে পড়ে গিয়ে মৃতপ্রায়। মাথায় প্রচ- আঘাত লেগে মাথা ফুলে বিশাল এক ফুটবলের আকার ধারণ করেছিল। সেই সময়ে দিলালপুরের ব্যবসায়ী মুরু মিয়ার এক আত্মীয় লন্ডন থেকে এফআরসিএস শেষ করে পাবনায় তারা ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে এলে সংবাদটা জানাজানি হয়ে যায় লন্ডন থেকে ডাক্তার আবদুল হাই এসেছেন। পাবনায় প্র্যাকটিস করবেন, কথাটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। ডা. আবু ইসহাক এমবি (ক্যাল)-এর ভিজিট ছিল শহরের বাইরে গেলে আট টাকা এফআরসিএস আবদুল হাইকে পিতা নিয়ে এলেন জাহিদকে দেখানোর জন্য। ডাক্তার হাই জানালেন মাথায় গরম পানি ঢালতে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের এক নানাভাই হোমিওপ্যাথ কাজী হাবীবুল ইসলাম চুন্নু ডাক্তার (হোমিওক্যাল) পিতাকে নিষেধ করলেন গরম পানি ঢালতে। বরং তিনি জানালেন ডাক্তার আবুল হোসেনকে নিয়ে এসো। ডাক্তার হোসেন জাহিদ হায়দার স্বপনকে দেখে ৭৪ ঘণ্টা ক্রমাগত কূপের ঠান্ডা পানি মাথায় ঢালার কথা জানিয়ে যাওয়ার সময় ফি এবং রিকশা ভাড়া বাবদ নিলেন পাঁচ টাকা। অথচ এফআরসিএস নিয়েছিল ১২ টাকা। ক্রমাগত ৭৪ ঘণ্টা ঠান্ডা পানি মাথায় ঢালার পরে ক্রমান্বয়ে মাথা ফোলা কমে গিয়েছিল। ওই তিন রাত চার দিন ক্রমাগত পানি ঢেলেছিল আমাদের সম্পর্কিত দুই ফুফু মল্লিকা আর মলতি। বয়েনউদ্দিন মোল্ল­ার দুই মেয়ে। স্বপনের ভালো হওয়ার খবর পেয়ে সে দিন নিজেই ছুটে এসেছিলেন আবুল ডাক্তার তার রোগীকে দেখতে বিনা পারিশ্রমিকে। যাওয়ার সময় কটাক্ষ করে বললেন এফআরসিএস গিরি পাবনায় চলবে না। পরে ডাক্তার হাইকে আর দেখা না গেলে জাহিদকে প্রায়শই নিয়ে যেতেন পিতা ওই আবুল ডাক্তারের চেম্বারে।

তখনকার দিনে একটি শিশির গায়ে (ছয়টি কাটা দিয়ে) একটি সাদা কাগজের খাঁজে খাঁজে লাল রঙের এক ধরনের তিতা ওষুধ হাতে বানিয়ে দিতেন কম্পাউন্ডারেরা এবং নিয়ম করে ছয় ঘণ্টা পর পর ওই বিখ্যাত তিতে ওষুধ এবং কুইনাইন খেতে হতো। এক সপ্তাহের বা দুই সপ্তাহের ভিতরেই লাল রঙের তিতা ওষুধ খেয়ে রোগী ভালো হয়ে যেত। আমার একবার হয়েছিল টাইফয়েড। ডা. আবুল হোসেন ওই বিশ্রী ওষুধ খাওয়ানোর পরে ভালো হয়ে গিয়েছিল অমার অসুখ।

আজকাল গ্রামগঞ্জে এলএমএফ ডাক্তার আছেন কিনা জানিনে। তবে জানি সেই লাল রঙের মিকচার (পাবনায় আঞ্চলিক ভাষায় মিক্সারকে মিকচার বলে) উধাও হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। তার পরিবর্তে ভেজাল দেওয়া ওষুধে দেশ পরিপূর্ণ। এখনো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে যদি লাল রঙের মিকচার খেতাম তাহলে বোধহয় শরীরের অসুখ-বিসুখ পালিয়ে যেত। কিন্তু সেই মিকচার এবং কম্পাউন্ডার কেউই নেই। কবি রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার এবং স্বদেশে ব্যবহারের জন্য ১৮৯৭ সালে খুলেছিলেন শাড়ি কাপড়ের দোকান। দোকানটির নাম ছিল ‘স্বদেশি ভান্ডার’। তিনিও বোধকরি লাল মিকচার খেয়েছিলেন। লাল মিকচার খেয়েই পেয়েছিলেন দীর্ঘ জীবন। আমাদের বয়সীরা যারা এখনো বেঁচে-বর্তে আছেন নিশ্চয়ই তাদের মনে আছে কাচের বোতলের গায়ে খাঁজ কাটা লাল মিকচারের কথা। এ প্রজম্মে র ছেলেমেয়েরা কোনো দিন জানবে না লাল মিকচারের গুণাগুণ। সে কথা জেনেই রবিঠাকুর লিখেছিলেন তরুণ ও প্রবীণ সম্পর্কে। ‘তারুণ্য তো ঘোড়া, আর প্রবীণতাই সারথি।’ (আত্মপরিচয়)।

লেখক : কবি।

সর্বশেষ খবর