থাকার মধ্যে আছে স্বামীর রেখে যাওয়া দুটো ঘরের টিনের চালওয়ালা বাড়ি আর তার পেছনে একটুকরো জমি। সেই জমিতে আলু, মুলো আর ফুলকপি-বাঁধাকপির চাষ হতো। নিজেই করত গোপালের মা। এখন তার বয়স হয়েছে। নিচু হয়ে কাজ করতে গেলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। কোনোরকমে সারা বছরের আলুটা ওই জমি থেকে জোগাড় করে নিতে পারে। তারপর হাত পাতা। চারটে ঘর আছে পাশের পাড়ায়। গিয়ে দাঁড়ালেই চাল ডাল নুন তেল আর বাতাসা দিয়ে দেয়। এক-একদিন এক-এক ঘরে। না গেলে কথা শুনতে হয়, ‘ও গোপালের মা, ক’দিন নেই কেন? আমাদের ত্যাগ করেছ নাকি?’ বড় ভালো ওরা। ওদের শাশুড়িমাও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার জ্বর হলে দুই দিন শুয়ে থাকলে ঠিক খবর পেয়ে যায় ছেলেদের কাছে। তার গোপালের বন্ধু ওরা। খবর পেয়ে কেউ-না-কেউ আসবেই। অসুখ দেখে ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসে দিয়ে যাবে। ছেলেদের ধমকাবে, ‘এখন তোরা জ্বালাতে আসবি না। ওর শরীর খারাপ’।
‘না, না। অমন কথা বোলো না’। বিছানায় শুয়ে প্রতিবাদ করে গোপালের মা’।
‘আর আশকারা দিও না। আসে তো সব বাতাসার লোভে’।‘আহা, আমার গোপাল খেলে ওরা কেন খাবে না? আমার শরীর খারাপ বলে গোপালকে না খাইয়ে রাখি নাকি!’
‘হ্যাঁ, ওরা তিনজন আসে। বড় জোর পাঁচ কি ছয়। তিন-তিনটে মিষ্টিমুখ, ঠিক যেন বাল গোপাল হামা দেওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দুটো করে বাতাসা হাতে পেলে ওদের মুখে হাসি ধরে না’। সেই হাসি দেখে মনে বড় সুখ আসে।
শহরটা যেখানে শেষ হয়েছে তার মিনিট তিনেক তফাতে গোপালের মায়ের ওই বাড়ি। আরও খানিকটা গেলে ধরধরা নদী। বর্ষায় নদীর জল বাড়ে, শহরের নিচু অঞ্চল ডুবে যায়। কিন্তু গোপালের মায়ের বাড়ি অনেকটা উঁচু জমিতে বলে জল ঢোকে না। তার সকাল শুরু হয় অন্ধকার থাকতে থাকতে। স্নান সেরে গোপালের পরিচর্যায় অনেকটা সময় দিতে হয়। গোপালকে কোলে বসিয়ে কত কথা বেরিয়ে আসে বুকের ভিতর থেকে। চোখ বন্ধ করে সে গোপালের জবাব শোনে। আজ গোপাল আবদার করল, ‘তোর হাতের নাড়ু খাব’। চোখ খুলল গোপালের মা। সর্বনাশ। নাড়ু কোথায় পাব? পেছনের জমির প্রান্তে একটা নারকোল গাছ আছে বটে কিন্তু সেখান থেকে নারকোল পেড়ে আনার ক্ষমতা তার নেই। পুজো শেষ করে ফুল দিয়ে গোপালকে সাজিয়ে বসিয়ে এলো গোপালের মা। বাড়ির পেছনে গিয়ে নারকোল গাছটাকে দেখল একবার। আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একদম ডগার নিচে ঝুলছে এক কাঁদি নারকোল। কোনো বাঁশ লাগাম পাবে না ওদের, উঠতে হবে ওখানে। কে উঠবে?
গোপালের মায়ের অস্বস্তি বাড়ল। মুখ ফুটে খেতে চেয়েছে গোপাল। সে বাখারির বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকাল। হনহনিয়ে একটা মেছো যাচ্ছে জাল কাঁধে নিয়ে নদীর দিকে। তাকে ডাকল গোপালের মা। ‘ও বাবা। আমার একটা কথা শোনার সময় হবে?’
‘ঝটপট বলো। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে’। লোকটা দুলতে লাগল।
‘ওই গাছ থেকে একটা নারকোল পেড়ে দেবে?’
লোকটা তাকাল, ‘অসম্ভব। আমি গাছে উঠতেই পারি না’। বলেই পা চালিয়ে সামনে থেকে চলে গেল।
কী করবে বুঝতে পারছিল না গোপালের মা। যারা দান দেয় তাদের কাছে গিয়ে কী বলা যায়, আমার গোপাল নাড়ু খেতে চেয়েছে, একটা নারকোল দাও। কারও বাড়ি থেকে নাড়ু নিয়ে এলে হবে না, তাকেই নাড়ু বানিয়ে ওকে খাওয়াতে হবে।
দূরে একটা লোককে দেখতে পেল গোপালের মা। মাঝে মাঝেই রাস্তার দুই পাশে নেমে গিয়ে কিছু খুঁজছে। খুঁজে না পেয়ে আবার হাঁটছে। আর একটু কাছে আসতেই দেখতে পাওয়া গেল, লোকটার হাতে একটা লম্বা সরু লাঠি, গলায় কড়িতে ঝোলানো বোতল ঝুলছে। আবার পাশের ধানখেতে নেমে গেল লোকটা। কোমর বেঁকিয়ে ঝুঁকে কিছু খুঁজল। না পেয়ে আবার রাস্তায় উঠে এলো।
এবার লোকটাকে স্পষ্ট দেখল গোপালের মা। কখনো দ্যাখেনি আগে। না, এলাকার মানুষই নয়। হাতে যেটাকে লাঠি ভেবেছিল ওটা সরু লোহার তৈরি। ডগায় দুটো মুখ আছে।
কাছে আসতেই গোপালের মা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী খুঁজছ গো?’
লোকটা বয়সে যুবক। মুখ ভরতি দাড়ি, বাবরি চুল ফেট্টিতে বাঁধা। বলল, ‘পরশপাথর’, যা পেলে দুটো ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হবে’।
‘বুঝলাম না’।
‘আমরা কতটুকু বুঝতে পারি মাসি। বিন্দুমাত্র না। এটা তোমার বাড়ি’।
‘আমার না, গোপালের বাড়ি’।
‘অ। গোপালবাবু তোমার কে হয়? স্বামী না ছেলে?’
‘অত কথার কী দরকার তোমার? একটা কাজ করে দাও তো!’
‘কী কাজ? কাজটা করে দিলে কী পাব?’
‘ওই যে নারকোল গাছটা দেখছ, ওখান থেকে একটা নারকোল আমাকে পেড়ে দাও, তুমি না হয় আর একটা নিও’। হাত তুলে গাছ দেখাল গোপালের মা।
লোকটা মুখ তুলে গাছ দেখল। তারপর বলল, ‘ভেতরে ঢুকছি, ভালো করে দেখতে হবে। বহুত লম্বা গাছ’।
বাখারির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল লোকটা। গোপালের মায়ের পেছন পেছন বাগানে এসে চারপাশে তাকিয়ে নাক টানল, ‘আছে, নিশ্চয়ই আছে’।
‘কে আছে?’ গোপালের মা অবাক।
‘আমার পরশপাথর। রাত-বিরেতে চেঁচিয়ে বলো, আস্তিক আস্তিক’।
‘আমি তোমাকে নারকোলের জন্যে ডেকেছি’।
লোকটা মুখ তুলে নারকোল দেখল। তারপর উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এসে বার তিনেক, ‘ওই যে আছে, ওই তো’।
গোপালের মা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। লোকটা বলল, ‘একাধিক। নারকোলের কোলে ঝুলছে। যে নারকোল পাড়তে ওপরে উঠবে সে নীল হয়ে যাবে’।
‘কী বলছ তুমি? কী আছে ওখানে?’
‘অন্তত হাজার খানেক টাকা। আঃ, কী কপাল করে আজ এদিকে এসেছি’।
‘তোমার কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারছি না’।
‘দ্যাখো মাসি, এটা দ্যাখো। খপ করে ওদের মাথার পেছনে চেপে ধরলেই সব জারিজুরি শেষ হয়ে যাবে। তখন মাথাটা মুঠোয় ধরে মুখটাকে খুলিয়ে এই বোতলের মুখে চেপে ধরলেই টপটপ করে তরল সোনা জমবে ভেতরে। মনে হচ্ছে গোটা পাঁচেক আছে ওখানে। তা ধরে বোতলের এতখানি ভরে যাবে ওদের দয়ায়। ব্যস। বিক্রি করলেই হাজার টাকা। এখান থেকে মনে হচ্ছে যে-সে নয়, একেবারে জাত সাপ’।
‘এ্যাঁ? ওখানে সাপ আছে?’
‘বয়স হয়েছে তাই চোখের মাথা খেয়েছ মাসি। তোমার দোষ নেই’।
গোপালের মা কটমট করে তাকাল, ‘তাহলে তুমি সাপুড়ে?’
‘একদম নয়’।
‘মিথ্যে কথা বলবে না। ওরা গোপালের আশ্রিত। ওদের মারা চলবে না’।
‘আমি তো একবারও বলিনি ওদের মারব। আর আমি সাপুড়ে নই’।
‘তাহলে তুমি কী?’
‘ওদের দাঁতের গোড়ায় যে বিষ আছে তা একটুও যন্ত্রণা না দিয়ে মুখ থেকে বের করে বোতলে ভরে নেব। এতে দুটো উপকার হবে। এক, বিক্রি করে আমি পেটের ভাত জোগাড় করতে পারব। দুই, বিষ বের করে নেওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে ওরা যদি কাউকে কামড়ায় তাহলে সে মারা যাবে না। এটা ভালো ব্যাপার না? তুমি বলছ ওরা গোপালের জীব। কিন্তু ওদের কামড়ে যখন কেউ মারা যায় তখন তোমার গোপাল কি তাকে বাঁচিয়ে দেয়?’ লোকটা হাসল।
গোপালের মা ঠিক করতে পারছিল না কী করবে। লোকটা বলছে সাপ হত্যা করবে না। কিন্তু সাপের মুখ থেকে বিষ বের করে নেওয়া কি অন্যায় নয়?’
লোকটা বলল, ‘সাপগুলোকে নির্বিষ করে দিলে নারকোল পাড়তে আর কোনো সমস্যা হবে না। যতগুলো চাও, পেড়ে দেব। ভেবে দ্যাখো তোমার কথায় অন্য কেউ যদি ওখানে উঠে নারকোল পাড়তে যেত তাহলে কী হতো? তার মৃত্যুর জন্যে তো তুমিই দায়ী হয়ে যেতে মাসি’।
ঠিক। কথাটা ঠিক। মনে মনে বলল গোপালের মা।
‘তাহলে কাজ শুরু করি?’ লোকটা জিজ্ঞাসা করল।
‘কীভাবে করবে?’
‘একটু দূরে সরে গিয়ে চেয়ে দ্যাখো’। বলে লোকটা কতগুলো ছোট পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিল। তারপর চিৎকার করল, ‘জয় মা মনসা, জয় বাবা আস্তিক। তোমাদের আশীর্বাদ নিয়ে কাজ শুরু করছি’।
গোপালের মা দেখল লোকটা নারকোল লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ল। প্রথম বার লক্ষ্যচ্যুত হলো। দ্বিতীয়বার নারকোলের গায়ে লাগতেই ফর করে একটা কালো সাপ ফণা তুলে চারপাশে তাকাতে লাগল। তৃতীয়বার পাথর ছুড়তেই সেই সাপটা হিসহিস শব্দ করে নারকোল গাছ বেয়ে নিচে নামতে লাগল। লোকটা তার অস্ত্র বাগিয়ে অপেক্ষা করছিল। সাপটা যখন প্রায় নিচে নেমে এসেছে তখন দ্রুত অস্ত্রের দুই মুখের মধ্যে ওর মাথাটাকে গাছে চেপে ধরতে চেষ্টা করল। কিন্তু এক ঝটকায় সেটাকে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে সাপটা ফণা তুলে খাড়া হলো। অন্তত ফুট চারেক উঁচুতে ফণা তুলে ঈষৎ দুলতে লাগল ছোবল মারার জন্যে।
গোপালের মা দ্রুত কয়েকপা পিছিয়ে গেল। তার খুব ভয় হচ্ছিল। ওটা যে কালসাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওর ছোবল খেলে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু লোকটা তার লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে। একটুও নড়ছে না তার শরীর, দৃষ্টি সরাচ্ছে না সাপের চোখ থেকে। হঠাৎ বাঁ-হাতটা শূন্যে বাড়াল লোকটা।
সঙ্গে সঙ্গে সাপ সেদিকে ঘুরে তাকাল। লোকটা এক পা এগিয়ে গিয়ে আবার বাঁ-হাত তুলতেই বিদ্যুৎবেগে ছোবল মারল সাপ। হাতের নাগাল না পাওয়ায় মাটিতে মাথাটা আছাড় খাওয়ার উপক্রম হওয়া মাত্র লোকটা ওর লোহার লাঠির ডগায় দুটো ভাগের খাঁজে সাপের মাথার পেছনটা মাটির সঙ্গে চেপে ধরল। মাথা নাড়াতে না পেরে সাপটা কয়েকবার লেজ নাড়ল প্রবলভাবে। এবার লোকটা এগিয়ে নিচু হয়ে সাপের মাথাটা ধরে উপরে তুলে গোপালের মায়ের দিকে তাকাল, ‘এখন এ শান্ত ছেলে হয়ে যাবে’। তারপর গলায় ঝোলা বোতলের মুখ খুলে সাপের হাঁ মুখ চেপে ধরল তার কানায়। অবাক চোখে গোপালের মা দেখল টপটপ করে বিষ গড়িয়ে জমছে বোতলে। বিষ পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ সাপটাকে বোতলের ওপর চেপে ধরে থাকল লোকটা। তারপর ধীরে ধীরে সাপটাকে ঘাসের ওপর রেখে দিল। এখন আর ফণা তুলছে না সাপ, খুব ধীরে চলে গেল পেছনের জঙ্গলে।
গোপালের মা জিজ্ঞাসা করল, ‘কে কিনবে ওই ভয়ঙ্কর বিষ?’
‘যাদের দরকার। এই বিষ থেকে মানুষের অসুখ সারাতে ওষুধ তৈরি হবে’।
‘মানে?’
‘সাপের বিষ যাদের কাছে বিক্রি করব তারা হলো দালাল। আমার কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করবে ওষুধ কোম্পানির কাছে। তারা এই বিষ থেকে ওষুধ বানাবে। তা ধরো, আমি নিজের পেট যেমন ভরাব তেমনি মানুষের ভালো করছি। বোতলের মুখ বন্ধ করে আবার পাথর ছুড়তে লাগল লোকটা। গোটা পাঁচেক পাথর ছোঁড়ার পর লোকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘মরেছে’।
গোপালের মা দেখল দু-দুটো কালসাপ যেন ভয় পেয়েই ওপর থেকে বেয়ে আসছে তরতর করে। লোকটা চিৎকার করল, ‘কাকে ধরব? একটাকে ধরতে অন্যটা পালাবে’। বলতে না বলতেই সাপ দুটো নিচে নেমে এলো। কিন্তু তারা ফণা তুলল না। দুজন দুদিকে দৌড়াতে লাগল। লোকটা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একটা সাপের মাথার পেছনে তার অস্ত্র চেপে ধরলে সেটা স্থির হয়ে গেল কিন্তু দ্বিতীয়টা ওপাশ দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বাড়ির সামনের দিকে চলে গেল।
দ্বিতীয়টার বিষ বোতলবন্দী করে লোকটা সাপ ছেড়ে দিয়ে আফসোস করতে লাগল, ‘আহা! আর একটার বিষ হাতছাড়া হয়ে গেল মাসি। ওটাকে পেলে ক’দিন পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করতে পারতাম। চলো, এই সই। কপালে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হই’।
ফেরার জন্যে কয়েক পা এগিয়ে সে থেমে গেল। বলল, ‘কথা দিয়ে কথা না রাখা খুব অন্যায় কাজ। দাঁড়াও, তোমাকে কয়েকটা নারকোল এনে দিই’।
‘ওখানে যদি আরও সাপ থাকে’। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল গোপালের মা-র।
তিনটে লেজ ঝুলছিল। আর নেই। তবু এটা নিয়েই উঠি’।
মুখ বন্ধ বোতলটাকে ঘাসের ওপর রেখে লোহার অস্ত্রটাকে কোমরে গুঁজে লোকটা নারকোল গাছে উঠতে লাগল। ওটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এ ব্যাপারে ওর অভ্যেস আছে। কাছাকাছি পৌঁছে লোহার অস্ত্রটা দিয়ে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করে সেটা নিচে ফেলে দিয়ে চিৎকার করল, ‘না নেই!’
ঝপঝপ শব্দ করে তিন-তিনটে নারকোল আছড়ে পড়ল নিচে। নেমে এসে লোকটি হেসে বলল, ‘চাইতে লজ্জা করছে তবু চাইছি। একটা নেব?’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল গোপালের মা।
বোতলে বিষ আর অস্ত্র আর নারকোল ঝুলিয়ে লোকটা চলে গেল।
নারকোল দুটো বেশ ভারী। একটা থাক, পরে কাজে লাগবে। দা বের করে দ্বিতীয়টাকে ছাড়াতে বসল গোপালের মা। বেশ রোদ উঠেছে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন এলো। এত জায়গা থাকতে সাপ তিনটে ওই টঙে, গাছের মাথায় উঠে এই নারকোলের মধ্যে বসেছিল কেন? এই নারকোলের ওপর ওদের লোভ থাকার কোনো কারণ নেই। তবে কি পাখি ধরে খেত ওরা? ছোট চড়াই, বুলবুলি, মাছরাঙা? না, পাখি খেলে তার পালক তো নিচে এসে পড়ত। পড়লেই চোখে পড়ে যেত গোপালের মায়ের। কপালে দুর্ভোগ লেখা ছিল ওদের, তাই উঠেছিল।
ছাড়াবার পরে নাড়িয়ে বোঝা গেল জল আছে বেশ কিন্তু ওজন বেড়েছে শাঁসের জন্যে। অনেক নাড়ু বানানো যাবে। যত ইচ্ছে খেতে পারবে গোপাল। আর বিকেলে সেই ছেলেরা এসে গোপালের প্রসাদ পেট ভরে খাবে।
ছাড়ানো নারকোল নিয়ে ঘরে ঢুকল গোপালের মা। গোপালকে হাতে ধরা নারকোল দেখাতে গিয়ে শ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। গোপালের শরীর জড়িয়ে বসে আছে সাপ। এটা নিশ্চয়ই সেই তিন নম্বর সাপ, যেটা পালিয়েছিল। এখন তার চোখ গোপালের মায়ের দিকে। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করেই ফণা তুলল সোজা। ফণাটা দুলছে।
ততক্ষণে গোপালের মা কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। এবার ধমক দিয়ে বলল, ‘অ্যাই, যাঃ। যা এখান থেকে। যেখানে ছিলি সেই নারকোল গাছের মাথায় গিয়ে উঠে বস। কেউ আর পাথর ছুড়বে না। কথা দিলাম। ও গোপাল, বল না ওকে চলে যেতে’।
সাপ এবার প্রবল বেগে ছোবল মারল। ছোবল এসে পড়ল গোপালের মায়ের হাতে ধরা ছাড়ানো নারকোলের ওপর। ভয়ে জ্ঞান হারাল গোপালের মা।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখল গোপাল যেমন হাসে তেমন হাসছে। সাপ নেই। নারকোলের গায়ে বিষ মাখামাখি। বাইরে বেরিয়ে ওটা ফেলে দিতে গিয়ে অবাক হলো গোপালের মা। সাপটা উঠে যাচ্ছে নারকোল গাছের মাথায়। কিন্তু উঠছে খুব ধীরে।
গোপালের মায়ের মনে হলো, এখন সাপটার খুব কষ্ট হচ্ছে উঠতে।
লেখক : কথা সাহিত্যিক।