বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন

পীর হাবিবুর রহমান

মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন

জীবনে না হলাম বৈষয়িক, না হলাম গোছানো। না হলাম বৈরাগী, না হলাম পুরো সংসারী। না হলাম প্রেমিক, না হলাম বিপ্ল­বী। তবে আত্মতৃপ্তির জায়গা এটাই যে, মানুষের কল্যাণে নিরন্তর সংগ্রামে কখনো পিছু হটিনি। কি ছাত্র-জীবনে, কি পেশাগত জীবনে। মানবজীবন অপার রহস্যময়। ছোট্ট জীবন, তাও নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা হাত ধরাধরি করে চলতে চলতে একসময় জীবনের ইতি টানতে হয়। দিনে দিনে বেলা অনেক গড়িয়েছে। মধ্য গগনের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে। হিসাব-নিকাশ ছেলেবেলা থেকেই কম বুঝেছি। জীবনের অঙ্ক সেখানে খুব একটা মেলাতে যাইনি। বহতা নদীর মতো জীবনকে তার আপন গতিতে চলতে দিয়েছি। আড্ডায় আড্ডায় কত মত-পথের মানুষের সঙ্গে চলেছি। কবিগুরু রবিঠাকুরের কঠিনেরে ভালো বাসিলাম আমি, সে করে না বঞ্চনা এ মর্মবাণী হৃদয়ে আত্মস্থ করেছিলাম। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের উক্তি, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি।’ এই মহান বাণীকে চিন্তা ও চেতনা দিয়ে হৃষ্ট-পুষ্ট করে পথ হাঁটার চেষ্টা করেছি। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি একটি জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে, কথা বলতে ও রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন। বিশ্বনন্দিত মহান রাজনীতিবিদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তাঁর সমকালীন আদর্শ নেতৃত্ব বা রাজনীতিবিদ আজকের পৃথিবীতে নেই।

আজকের পৃথিবী যেন অনেকটা আদর্শহীন পথহারা নির্বাচিত একনায়কদের হাতে বন্দী। দেশে দেশে আজ গণতন্ত্রের নামে রীতিমতো প্রহসন চলছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ঘাতকের বুলেটে পরিবার-পরিজন হারিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বাতিঘর হয়ে এসেছিলেন। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সংগ্রামমুখর রাজনীতিতে অকুণ্ঠ জনসমর্থন নিয়ে গ্রেনেড, বোমা ও বুলেট উপেক্ষা করে পথ হেঁটেছেন। সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি। ৩৮ বছরের রাজনীতিতে ১৫ বছর তিনি এই দেশের প্রধানমন্ত্রী। মানুষ তাঁকে ভালোবেসে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে ডেকেছে। তাঁর সরকারের টেকনোক্রেট কোটার মন্ত্রীর আনা বিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে। এই আইন আমরা বিশ্বাস করি, সময়ের প্রয়োজনে উপযোগী হলেও তার কতগুলো কালো ধারা গণমাধ্যম ও মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের চিন্তাকে রুখে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রপতি বিলে সই করার মধ্য দিয়ে আইনটি কার্যকর হলো। কালো ধারাগুলো গণমাধ্যমকে প্রাণহীন করে কণ্ঠরোধ করে দিল। এর পরিণতি কী জানি না! এই কালো ধারাগুলো থেকে গণমাধ্যমকে মুক্তি দিতে সম্পাদক পরিষদসহ আমরা আকুতি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার নাকচ করে দিয়েছে। জানি না, আওয়ামী লীগ একদিন যখন বিরোধী দলে যাবে, তখন এ আইনের জন্য আত্মযন্ত্রণা ভোগ করবে কিনা?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের অধিবেশন থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক জ ই মামুনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন তিনি যতক্ষণ আছেন আস্থা রাখতে। এর অপপ্রয়োগ তিনি হতে দেবেন না। এর আগে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আজ ক্ষমতায় মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আছেন। আমরা না হয় তাঁর ওপর আস্থা রাখলাম। কিন্তু তিনি যখন থাকবেন না, তখন আমাদের ভয়ভীতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর এর অপব্যবহার যে কণ্ঠ ও হাত-পা চেপে ধরবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় বুঝি না। এত আকুতি, এত মিনতি করার পরও সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনের কথা চিন্তা করল না।

আমি সব সময় বলি, আমার কোনো দল নেই। মানুষই আমার দল। বাংলাদেশই আমার দেশ। জীবনের কঠিন টানাপড়েনেও পিষ্ট হয়েছি। সুখের আশায় পশ্চিমা দেশে পাড়ি দিইনি। অনেক সহকর্মী নিরাপদ জীবনের আশায় চলে গেলেও পূর্বপুরুষের জম্মে র ভিটেমাটি আঁকড়ে স্বাধীনভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার লড়াই করতে গিয়ে বিশ্বাস করেছি বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ, নিরহংকারী, গণমুখী, দেশপ্রেমিক রাজনীতি ও তাঁর গণতান্ত্রিক চেতনায় আমার ধমনিতে প্রবাহিত আদর্শের মৃত্যু নেই। যে আদর্শে মানুষে মানুষে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, সাম্য ও স্বাধীনতায় আজম্ম  বিশ্বাস করেছি। মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ আমার ঠিকানা। এ স্বপ্নই দেখেছি। যেখানে আমার সব অস্তিত্ব ও চেতনার প্রজ্বলিত সাহসের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে আজকাল ক্ষমতানির্ভর করুণাশ্রিত চাটুকারদের নির্লজ্জ বেহায়াপনা, দালালি ও সুবিধাভোগী চরিত্রের আস্ফালন দেখলে ভয় লাগে। মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধু কোথায়? এ দেশ তিনি জম্ম  দিয়েছিলেন। আমাদের নিরাপদ নিঃশঙ্কচিত্তে বসবাসের নিরাপদ ঠিকানা দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে আজকাল কেন জানি মন উথাল-পাথাল করে। নানা শঙ্কা ও ভয় জাগে। তবু যে শক্তি ও সাহসের ওপর কথা বলি, লিখি ও বুক ফুলিয়ে হাঁটি তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রিয় দেশ।

বঙ্গবন্ধু নামটি বুকের ভিতর অসীম শক্তি ও সাহস জোগায়। এ শক্তি ও সাহস যতক্ষণ, ততক্ষণ সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে কোনো সংশয় রাখতে পারি না। তাই এখনো সরকারের কাছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন দাবি রাখি। সম্পাদক পরিষদসহ গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে খোদ প্রধানমন্ত্রীর একটি আলোচনা আশা রাখি।

শুরুতেই বলছিলাম, বেহিসাবি খেয়ালি মনের মানুষ আমি। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন নিউইয়র্কের পর লন্ডন থেকে ইউরোপ সংস্করণের সূচনা করেছে। ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় লন্ডনে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে। আমারও অনুষ্ঠানে থাকার কথা ছিল। বিমানের টিকিট কাটার আগে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেখি ভিসার মেয়াদ গত মাসে শেষ। ভিসা করতে গিয়ে দেখি পাসপোর্টের মেয়াদ আর পাঁচ মাস আছে। ভিসা করতে গেলে ছয় মাস মেয়াদ থাকা লাগে। স্বরাষ্ট্র সচিব ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী এক দিনে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিলেন। জরুরি ভিত্তিতে ভিসা পেতে জমা দিলাম। কিন্তু ব্রিটিশ হাইকমিশনের সার্ভার তিন দিন ডাউন থাকায় কোনো পাসপোর্ট সরবরাহ করতে পারেনি। লন্ডনে আমার সব মতপথের আপনজনরা রয়েছেন। গণমাধ্যমের প্রায় সবাই পরম আত্মার আত্মীয়। যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা ছিল। শেষ মুহূর্তে যেতে না পারায় বিষাদ ছুঁয়ে গেছে মন। তবু আনন্দ যে, লন্ডনে সব মতপথের সুধীজন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি বর্ণাঢ্য হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইউরোপ সংস্করণে একটি লেখাও দিয়েছি। সেই লেখার অংশবিশেষ এমন দেশে সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। দেখা-সাক্ষাৎ হয় লন্ডন গেলে। ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছি বাড়িতে ‘লন্ডনি’ মেহমান আসতে। মাতুলালয়ের নিকটাত্মীয়রা ব্রিটেনপ্রবাসী। আমাদের ছেলেবেলায় সিলেট অঞ্চলে এই প্রবাসীদের ‘লন্ডনি’ বলে ডাকা হতো। এই ‘লন্ডনি’ শব্দের মধ্যে একটা অহংকার ও সাহেবানা ব্যাপার-স্যাপার জড়িয়ে ছিল। দেশে এলে সেসব লন্ডনি বাড়তি আদর-সমাদর পেতেন আত্মীয়স্বজনদের দেখতে গিয়ে। তাদের উপহারের ‘কেরোলিনের’ শার্ট গায়ে পরে গর্বিত হতাম। পরবর্তীতে কেডস-জিন্স এসবে গড়ায়। যাক, এই প্রজম্ম  এখন আর অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে যেমন লন্ডনি বলে আত্মীয়দের নিয়ে বাড়তি আকর্ষণ বোধ করে না তেমনি তাদের নিয়ে অত বেশি কৌতূহলও নেই। আমাদের ছেলেবেলায় অনেক লন্ডনি বিলেত গিয়ে মেমসাহেবও বিয়ে করে আনতেন। এ নিয়ে আমাদের সে কি তুমুল উত্তেজনা ও কৌতূহল! ছেলেবেলায় তাদের দেখে আমিও ভাবতাম, বড় হয়ে লন্ডন যাব। স্বর্ণকেশী মেমসাহেব বিয়ে করব। তা আর কপালে জোটেনি। তবে টেমসের তীরে রাত নামলেই ডকল্যান্ডের মৃদুলের ‘মেম সাহেব’ রেস্টুরেন্টে কত রাত আড্ডায় ডুবেছি। আহা আড্ডা আমার আড্ডা!

ব্রিটিশরা শুধু সাহসী জাতিই নয়, সভ্য ও গণতান্ত্রিক চেতনায় যেমন বিকশিত তেমনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মানবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পায়নের যুগে আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষকের পরিচয় ছেড়ে জাহাজে চড়ে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে বিলেতপ্রবাসী হয়েছিলেন। হয়েছিলেন লন্ডনি। তারপর আত্মীয়তার সুবাদে, বিয়ে-শাদির সুবাদে সিলেট অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ব্রিটেন-প্রবাসী হয়েছেন। আর সিলেটীদের হাত ধরে সিলেটের পরম মমতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেকে এখন ব্রিটেনপ্রবাসী। এই প্রবাসীরা ব্রিটেনের অর্থনীতিতে মূলধারায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। নতুন প্রজম্ম  লেখাপড়ায় উচ্চশিক্ষিত হয়ে নানা প্রশাসনিক পদে বিভিন্ন পেশায় দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। একসময় রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সিলেটী লন্ডনপ্রবাসীরা ভূমিকা রাখতেন। এ প্রজম্ম  এখন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নয়, প্রফেশনাল হিসেবে নিজেদের তৈরি করেছেন।

একসময় সবাই ছুটি-ছাঁটায় ঈদে-চাঁদে দেশে আসতেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। মায়া-মমতার বাঁধন আরও গভীর করেছিলেন। সেই বাঁধন ছিন্ন হচ্ছে দিনে দিনে। তবে আশার আলো, এই প্রজম্ম  দেশে কম বেড়াতে এলেও দুনিয়া ঘুরছে। আর ব্রিটেনের মূল স্রোতে মেধা সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষায় মানুষ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। একসময় লর্ডসভায় বাংলাদেশের মুখ দেখে আমরা গর্বিত হয়েছিলাম। এখন ওয়েস্টমিনস্টার ডেমোক্রেসিতে বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক, সিলেটী কন্যা রুশনারা আলীসহ অনেকেই মুখ আলোকিত করছেন। এমন কোনো শহর নেই যেখানে সিলেটী ও তাদের ব্যবসা নেই। আর স্থানীয় সরকারে আমাদের স্বজনরা প্রতিনিধিত্ব করছেন না। ব্রিটেন আমার কাছে পৃথিবীর একটি অন্যতম প্রিয় দেশ। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব মত-পথের মানুষের সেখানে আশ্রয় ঘটে। দার্শনিক কার্ল মার্কসের সমাধিও লন্ডন শহরে। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘যেখানে শিল্পবিপ্ল­ব ঘটবে সেখানেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হবে।’ কিন্তু মানবিক রাষ্ট্র ব্রিটেন সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বর্গ হিসেবেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়নি, সব নাগরিকের অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আঁতুড়ঘরেই সমাজতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। এ ছাড়া এমন কোনো শহর নেই যেখানে আত্মীয় বা বন্ধু-স্বজন নেই। সব মিলিয়ে ব্রিটেনকে কখনোসখনো নিজের দেশের পরই আরেকটি আপন দেশ মনে হয়। লন্ডন শহর আমার প্রিয় শহর। আর লন্ডনিরা আমার প্রিয় স্বজন। একটা সময় ছিল প্রতি সামারে লন্ডন গেছি। আর সেখানে গিয়ে আড্ডায় ডুবতে ভুগতে তিন মাস, দুই মাস, এক মাস কাটিয়ে এসেছি। সারা দিন ঘুমিয়েছি, সন্ধ্যা নামলেই লন্ডন ছেড়ে যে কোনো শহরে প্রিয়জনদের কাছে পরম আতিথেয়তা লাভ করেছি। রাত ১২টায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে সবাই মিলে বসিয়েছেন বাউল গানের জলসা। অসংখ্য স্বজনের নাম নিতে হয় তাই নেওয়া হলো না।

বার্মিংহামপ্রবাসী বড় আপা হিফজুন্নেছা খানম জুঁইয়ের অকালমৃত্যু যেন দ্বিতীয়বার মাতৃহারা করেছে। বার্মিংহাম তো বটে। লন্ডনের প্রতিও আকর্ষণ কমিয়ে দিয়েছে। বিলেতপ্রবাসীদের আজকের চাকচিক্যময় সাফল্যে গৌরবময় ক্যানভাসের দিকে তাকালে আমাদের সেসব পূর্বপুরুষের কথা মনে পড়ে। যারা জাহাজে চড়ে সেখানে গিয়ে কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশ, অসহনীয় ঠাণ্ডা আবহাওয়া, এক জায়গায় শোয়ার ঘর আরেক জায়গায় স্নানঘর কী প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে জায়গা করেছিলেন। ভাষার সমস্যা তো প্রকট ছিলই। সেসব পূর্বসূরির কথা বলতেই হয় শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। যারা বর্ণবাদীদের আক্রমণ-হামলা প্রতিরোধ করে জীবনই দেননি, জয়ী হয়ে ইস্ট লন্ডনে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে বাংলা টাউন বানিয়েছিলেন। বাংলা টাউনের কারণে লন্ডন গেলে মনে হয় সিলেট বেড়াতে গেছি। বাংলা টাউন ঘিরে বাংলা গণমাধ্যম প্রিন্ট মিডিয়া থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রসারিত হয়েছে। বাংলা কবিতা শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে প্রজম্ম  থেকে প্রজম্ম  হৃদয় দিয়ে জড়িয়েছে। বৈশাখী উৎসব থেকে সিলেট উৎসব বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। গানের জলসা, কবিতার আসর, নাটক হামেশাই হচ্ছে। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব ঘিরে। সেখানকার সাংবাদিকদের রয়েছে হৃদয় নিঃসৃত আবেগ-অনুভূতিনির্ভর সম্পর্ক ও মহান ঐক্য। ছেলেবেলা থেকেই ব্রিটেন মানেই আমাদের কাছে লন্ডন নামে খ্যাত। লন্ডন তখন আর ব্রিটেনের ক্যাপিটাল সিটি থাকে না। একটি দেশের প্রতীক হয়ে যায়। নব্বইয়ের দশকে প্রথম লন্ডন গিয়েছিলাম অকাল প্রয়াত বন্ধু মিয়া আকতার হোসেন ছানুর অতিথি হয়ে। কত মানুষ কত শিল্পী কত সাংবাদিক ছানু নিয়ে গেছে! রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তার অকালমৃত্যু লন্ডনের প্রতি অনীহা বাড়িয়েছে। প্রবীণ সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশার মৃত্যুও গভীর শূন্যতার। বাদশা নাম ছাড়া যেমন এ দেশের ষাটের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস লেখা যাবে না তেমনি ছানু মিয়ার নাম ছাড়া ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালিদের ইতিহাস টানা যাবে না। সবখানে ছিল ছানুর উপস্থিতি। সবকিছুতেই যেন জড়িয়ে ছিল। লন্ডনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দেশে গ্রামের বাড়িতেও এখন যে পিঠাপুলির আদর-যত্ন পাওয়া যায় না সেখানে বিলেতপ্রবাসীদের ঘরে সেই পরম আতিথেয়তা আদর-যত্ন পাওয়া যায়। একসময় যা ছিল স্বপ্ন আজ তা হাতের মুঠোয়। বাংলা টাউন জুড়ে অসংখ্য বাংলা পত্রিকা। বিভিন্ন শহর থেকেও প্রকাশিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠানটির নাম ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া। দেশসেরা শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এখান থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান যার সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি মাটি স্পর্শ করলে সোনা ফলে যায়’ সেই আহমেদ আকবর সোবহানের স্বপ্নের ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া থেকে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত জনপ্রিয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পাঠক হৃদয় জয় করে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। কালের কণ্ঠ, ডেইলি সান, রেডিও ক্যাপিটাল ও টিভি নিউজ টোয়েন্টিফোর সুনামের সঙ্গে মাথা উঁচু করে আছে। নিউজপোর্টাল বাংলানিউজ তো আছেই। আগামীতে আরেকটি বিনোদন টেলিভিশন যুক্ত হচ্ছে। আমার প্রিয় বন্ধু নঈম নিজাম বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক হিসেবে সফলতার পর টিভি চ্যানেল ও রেডিওর সিইও হিসেবেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ এই সফল দক্ষ মানুষটি বন্ধু। তাকে নিয়ে আমিই নই, আজকের গণমাধ্যম গর্ব করতেই পারে। আমরা চিন্তা-ভাবনার দিকে কাছাকাছি। আর আমাদের মাথার ওপর অভিভাবকত্বের জায়গায় বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন আহমেদ আকবর সোবহান।

নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশের পর এখন থেকে নিয়মিত ইউরোপপ্রবাসীদের জন্য লন্ডন থেকেও নিয়মিত প্রকাশ হবে। এটি হবে বিলেতপ্রবাসীদের নিজেদের দৈনিক। এর সাফল্য নিয়ে আমরা স্বপ্নের চেয়েও বেশি আশাবাদী। এর মধ্য দিয়ে আত্মার বন্ধন লন্ডনিদের সঙ্গে আরেক ধাপ উচ্চতায় গেল। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার নীতিতে প্রতিদিন অবিচল থাকবে।

১৯১৫ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে লন্ডনে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের সূচনা হয়। বিলেতের ১০৩ বছরের বাংলা মিডিয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ আরেক ইতিহাস জম্ম  দিল। জাতীয় দৈনিক হিসেবে লন্ডন থেকে আরেক সংস্করণ বের করল। পাঠকপ্রিয় হবে বলে আমরা মনে করি।

বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে পশ্চিমারা সন্ত্রাসী বলেছিল। জীবনের সংগ্রাম দিয়ে তিনি তা মুছে দিয়ে গেছেন আত্মত্যাগের মহিমায়। কারামুক্তির পর ব্রিটেনের রাজ পরিবার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়েছিল। আর তখনকার সন্ত্রাসী বলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার কমনসভায় তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। উষ্ণ করমর্দনে অভ্যর্থনা জানানো কিছুটা সময়কে স্পিকার স্মরণীয় করে বলেছিলেন, ব্রিটেনের রানীকে ম্যান্ডেলা তার জন্য রাজ পরিবারের বাগানের ফটক খুলে রাখতে বলেছিলেন। আজ লন্ডনে প্রতিদিন পরিবারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশকালে আমার প্রিয় শহর লন্ডনের প্রিয় স্বজন লন্ডনিদের কাছে আবেগঘন নিবেদন করব, আমার জন্য, আমাদের জন্য আপনাদের হৃদয়ের দরজা সব সময় খোলা রাখবেন। আনন্দ-বেদনায় বুক ভরে শ্বাস নিতে আসব। এ যে আমার মামাবাড়ির আবদার।

অনেকদিন বঙ্গভবনে যাওয়া হয়নি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের বক্তৃতা শোনার পর ভেবেছি, শিগগির বঙ্গভবনে গিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে আসব। এমনিতেই আমি তাঁর ভক্ত। হাওর থেকে উঠে আসা একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদই নন, ছাত্রজীবন থেকে জেল-জুলুম সয়ে যে মহান আদর্শের পথ ধরে রাজনীতিতে হেঁটেছেন। সেই পথেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে যাচ্ছেন। দেশকে যেমন দিয়েছেন দেশও তাঁকে উজাড় করে দিয়েছে। এমন সফল মানুষ প্রাপ্তিযোগে এ দেশের রাজনীতিতে আর তেমনটি নেই। জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যের রসবোধ, তাঁর প্রখর হিউমার সেন্স একসময় রাজনীতির মঞ্চ মাতিয়েছে। পরবর্তীতে সংসদে আনন্দের বন্যা বইয়েছে। এখন তারুণ্যের পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুখরিত হচ্ছে। এমন স্মার্ট একজন রাষ্ট্রপতি ছাত্রসমাজের প্রাণখোলা হাসি আদায় করে করণীয় কর্তব্য ও দেশপ্রেম সমাজে বহমান দীনতাসহ সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে বার্তা দিতে ভুল করছেন না। সমাবর্তনে গিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বন্ধ্যত্ব ঘোচাতে ডাকসু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন।

রাজনীতি যে গতিপথ হারিয়ে সর্বস্বান্ত রূপ নিয়েছে কৌতুকের ছলে তাও তুলে এনেছেন। বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন গরিবের সুন্দরী বউ বা সবার ভাবী হয়ে গেছে।’ একসময় ছাত্রজীবন থেকে সবাই রাজনীতিতে মানবসেবার ব্রত নিয়ে যুক্ত হতেন। অনেকে শিক্ষাজীবন শেষে রাজনীতিকেই আদর্শিক পথে মানবকল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে ত্যাগের মনোভাবে প্রবেশ করতেন। একালে যার টাকা আছে, সে-ই রাজনীতিতে যখন-তখন চলে আসে। একজন আমলা, একজন প্রকৌশলী, একজন চিকিৎসক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা পেশাদারি জীবনের পুরোটা ভোগ করে অবসরকালে ভোগের নেশায় ক্ষমতার উচ্চাভিলাষে রাজনীতিতে চলে আসেন। গ্রামীণ জনপদের সহজ-সরল কর্মী ও মানুষেরা স্যার না বলে ভাই বলে ডাকলে মাইন্ডও করেন। জীবনের শেষ বেলায় ভোগবাদী চিন্তা থেকে আরাম-আয়েশে শেষ জীবন কাটাতে রাজনীতিকেই উত্তম বাহন হিসেবে ব্যবহার করেন। আর সেই সুযোগ করে দেন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মুখে পতিত রাজনৈতিক দলের নেতারা।

সবার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাতে রাষ্ট্রপতি জীবনের পড়ন্ত বেলায় যে তাগিদ দিয়ে গেছেন, তা তাঁকে অমরত্ব দেবে কিনা জানি না। কিন্তু সব দলের নেতৃত্বকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে থাকবে না কি সুবিধাভোগী ভোগবাদীদের হাতে তুলে দেবেন। রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অথবা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যদি রাজনীতিই করতে হয়, তাহলে সেই সব চাকরিতে না গিয়ে আদর্শ বুকে নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেননি কেন? কেন কষ্টের ত্যাগের রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে জেল-জুলুম সয়ে রাজনীতির জন্য নিজেকে তৈরি করেননি? আজ উড়ে এসে মাঠ নেতাদের হকে ভাগ বসাবেন কেন? মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনাকে অভিবাদন। সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভঙ্গুর দেউলিয়াত্বের মুখে আপনি যে আকুতি জানিয়েছেন, তা গণমানুষের বুকের ভাষা। নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মীদের আত্মার ক্রন্দন। এই রাজনীতির সংস্কার হোক।

লৈখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর