বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কবি নজরুলের কোমরে দড়ি ও প্রতিবাদের ভাষা

সাইফুর রহমান

কবি নজরুলের কোমরে দড়ি ও প্রতিবাদের ভাষা

মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা দর্শনটি দ্বারা যুগে যুগে অনুপ্রাণিত হয়েছেন পৃথিবীর বহু শ্রুতকীর্ত মানুষ। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং। বর্ণবৈষম্য, নাগরিক অধিকার, কর্মসংস্থানে সমঅধিকার প্রভৃতি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে ‘মাশায়া’ হিসেবে আবির্ভূত হন পঞ্চাশের দশকে। মার্টিন লুথারের জম্ম  ১৯২৯ সালে আমেরিকার আটলান্টায়। কালো মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে তখন বর্ণবৈষম্য চরম পর্যায়ে। সবকিছুতেই কালোদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। সে হোক ট্রেনের বিশ্রামাগার, পানি পানের কল, শৌচাগার কিংবা প্রসাধনকক্ষ। বেশির ভাগ দোকানের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলত ‘কুকুর আর কালোদের জন্য নিষিদ্ধ এই প্রাঙ্গণ।’ সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! সে সময় পাবলিক বাসেও কালোদের জন্য একেবারে পেছন দিকে দু-চারটি আসন সংরক্ষিত থাকত। কালোদের শুধু সেখানেই বসার অধিকার ছিল। কিন্তু বাসে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীর আধিক্য থাকলে সেই সংরক্ষিত আসনগুলোও ছেড়ে দিতে হতো শ্বেতাঙ্গদের জন্য। দুটো ঘটনা ঘটে ১৯৫৫ সালে। সে বছর মার্চে ক্লাওডেট কলভিন নামে ১৫ বছরের এক কৃ-ষ্ণাঙ্গ বালিকা বাসে ফিরছিল স্কুল থেকে। শ্বেতাঙ্গ যাত্রী বেশি হয়ে যাওয়ায় মেয়েটিকে বলা হলো সিটটা ছেড়ে দিতে কিন্তু মেয়েটি সিট ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে তাকে সোপর্দ করা হয় পুলিশে। এ নিয়ে শুরু হয় আন্দোলন। সেই আন্দোলন স্তিমিত হতে না হতে ঠিক নয় মাস পর ডিসেম্বরের ১ তারিখে রোজা পার্কস নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাও ঠিক উপরোক্ত ঘটনার মতো পাবলিক বাসে তার সিট ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। বাসের চালক রোজা পার্কসের কাছে এসে ধমকের সুরে তাকে সিট ছাড়তে আদেশ করেন কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। কিছুতেই আসনচ্যুত হবেন না তিনি। এ নিয়ে বাসের মধ্যে শুরু হয় হৈচৈ, ঝগড়াবিবাদ। এবারও যথারীতি রোজা পার্কসকে সোপর্দ করা হলো পুলিশে।

পরপর দুটি ঘটনা দক্ষিণাঞ্চলকে ভীষণভাবে উত্তপ্ত করে তুলল। সে অঞ্চলের কালোরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা পাবলিক বাসে আর চড়বেন না, এটিই হবে তাদের প্রতিবাদের ভাষা। এ বয়কট চলল টানা ৩৮৫ দিন। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে মার্টিন লুথার কিং বনে গেলেন দেশের জাতীয় বীর, সেই সঙ্গে নাগরিক অধিকারের প্রতিভূ। এরপর কালোদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন চলল নিরলস গতিতে। ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং ডাক দিলেন বৃহত্তর আন্দোলনের। ’৬৩ সালের ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের উদ্দেশে লং মার্চ। সেদিন সকালে মিসিসিপি, জর্জিয়া, টেনেসি, আলাবামা, নিউইয়র্ক, বোস্টন অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে পড়ল বাড়ি ছেড়ে। সঙ্গে নিল কেক, বিস্কিট, খাবার পানি ও থলেতে সামান্য কিছু ফলমূল। ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে আড়াই লাখ মানুষের জমায়েত হয়েছিল সেদিন। মার্টিন লুথার কিং দিয়েছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের সেরা একটি ভাষণ। আড়াই লাখ মানুষের সামনে তিনি শুরুতে লিখিত বক্তব্যই পাঠ করেছিলেন। তার বক্তব্য তিনি শুরু করলেন এভাবে ‘আমি আজ আপনাদের মাঝে এসে বেশ আনন্দবোধ করছি। ১৮৬৩ সালে অর্থাৎ এখন থেকে ১০০ বছর আগে কালোদের মুক্তির আইন পাস হলেও কার্যত কালোরা আজও সর্বত্র শৃঙ্খলিত।’ জনতার মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের জনপ্রিয় ধর্মাত্মক সংগীত গায়িকা ও রাজনৈতিক কর্মী মাহালিয়া জ্যাকসন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এ... ই... যে, মার্টিন, তুমি আমাদের তোমার স্বপ্নের কথা বল। কী স্বপ্ন তুমি দেখ আমাদের নিয়ে।’ তখন মার্টিন লুথার কিং তার লিখিত বক্তব্যের পাতাটি সন্তর্পণে এক পাশে সরিয়ে রেখে মাথাটি ঈষৎ ডান দিকে ঝুঁকিয়ে বলতে শুরু করলেন, I have a dream. ‘আমি স্বপ্ন দেখি।’ সে কি বক্তব্য!!! মনে হচ্ছিল যেন তিনি কোনো কাব্যগ্রন্থের পাতা থেকে কবিতা পাঠ করছেন। বক্তব্যটি আমি দুই ডজনেরও বেশিবার শুনেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বাক্যটি কম করে হলেও এক ডজনের বেশিবার ব্যবহার করেছেন মার্টিন লুথার কিং। I have a dream. ‘আমি স্বপ্ন দেখি আমার এ স্বপ্নটিও যে কোনো আমেরিকানের স্বপ্নের মতো মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন এ জাতি উঠে দাঁড়াবে এবং সব ধর্মমত ও বিশ্বাসকে তারা বুকে ধারণ করবে। আমি স্বপ্ন দেখি এ দেশে একদিন সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখা হবে। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমার চারটি সন্তান এমন একটি দেশ পাবে সেখানে তার শরীরের রং দেখে নয় বরং তাকে বিচার করবে তার চরিত্রের গুণাগুণ দেখে। আমি স্বপ্ন দেখি...।’ আড়াই লাখ মানুষের এত বৃহৎ একটি সমাবেশের পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শুরু হলো তোলপাড়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জন এফ কেনেডি। তিনি কালোদের অধিকাংশ দাবি মেনে নিলেন, জয় হলো কালোদের। উপরোক্ত বিষয় নিয়ে একদিন কথা হচ্ছিল আমার কিছু লেখক সুহৃদের সঙ্গে। তারা আমাকে বললেন, কেনেডি ছিলেন যোগ্য ও মেধাবী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও হার্ভার্ডের মতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কেনেডি নিজেও জানতেন এসব আইন পাস করলে নিজেও তিনি ইতিহাস হয়ে থাকবেন। আপনি কি মনে করেন আড়াই লাখ কিংবা ধরা যাক পাঁচ লাখ মানুষের কোনো একটি সমাবেশ যদি উগান্ডায় হতো তবে উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী কি তা মেনে নিতেন। আমি তাদের উদ্দেশে বললাম, তা অবশ্য ঠিক বলছেন। দাবি মেনে নেওয়ার জন্যও আকাশের মতো হৃদয় দরকার।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল পেলেন মার্টিন লুথার কিং। লুথারের গুরু মাহাত্মা গান্ধী কিন্তু নোবেল পাননি কিংবা তার গুরুর গুরু অর্থাৎ লিও তলস্তয়ও পাননি নোবেল। তলস্তয়ের লেখা পড়ে গান্ধী একসময় এতটাই মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে ২১ মাইল দূরে ৩ হাজার ৩০০ বিঘা জমি নিয়ে একটি খামার করেছিলেন গান্ধী। সেই খামারের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘তলস্তয় ফার্ম’। তলস্তয় ও গান্ধীকে নোবেল না দেওয়া ছিল নোবেল কমিটির চরম ব্যর্থতা। এজন্য তারা অনুশোচনাও প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সময়। মার্টিন লুথার কিংয়ের শেষ পরিণতি কিন্তু হয়েছিল তার পূর্বসূরি দুই গুরুর মতোই। ’৬৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হলেন মার্টিন লুথার কিং, যেমনটি হয়েছিলেন গান্ধী ১৯৪৮ সালে, নাথুরাম গডসের হাতে। তলস্তয় অবশ্য সরাসরি কারও হাতে নিহত হননি কিন্তু তিনি নিহত হয়েছিলেন পরোক্ষভাবে। স্ত্রীর অত্যাচার সইতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে যাত্রা করেন নিরুদ্দেশে। এক শীতের রাতে একটি ট্রেনস্টেশনে প্রচন্ড ঠাণ্ডায় জমে মারা যান তলস্তয়।

গান্ধীর প্রতিবাদের ভাষা অহিংসা হলেও বাংলা মুলুকে আরেকজন নেতা আবির্ভূত হয়েছিলেন উল্কার মতো যার আদর্শ ছিল গান্ধীর একেবারে ঠিক বিপরীত। বঙ্গদেশে যার জনপ্রিয়তা গান্ধীর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। হ্যাঁ, আমি নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের কথাই বলছি। যিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ রক্ত দেওয়া প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল ২০১১ সালের মার্চে থাইল্যান্ডে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা প্রদর্শন করেছিলেন এক অভিনব প্রতিবাদ। তারা প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ ভেজ্জাজিভাকে বললেন, আমাদের শরীর থেকে কষ্ট করে রক্ত ঝরানোর প্রয়োজন নেই। আমরাই আমাদের শরীরের রক্ত ঢেলে দিচ্ছি আপনার দুয়ারে। তবু আপনি জুলুম-নিপীড়ন বন্ধ করুন। এজন্য বিরোধী দলের প্রায় ৫০ হাজার নেতা-কর্মী নিজের শরীর থেকে ৩০০ লিটারেরও বেশি রক্ত প্লাস্টিকের বোতলে ভরে তারা ঢেলে দিয়েছিল ভেজ্জাজিভার বাসভবন ও অফিসের সামনে। তখন তাদের প্রত্যেকের শরীরেও ছিল রক্তবর্ণ পোশাক। মজার বিষয় হচ্ছে, রক্ত দেওয়ার কয়েক মাস পর অর্থাৎ ২০১১ সালের ৫ আগস্ট পতন হয় ভেজ্জাজিভার।

সে যাই হোক, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। তিনি লেখাপড়া করেছিলেন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইএস হয়েছিলেন তিনি। সুভাষ বসু জানতেন ব্রিটিশরা কী চরিত্রের, বিশেষ করে যেসব ইংরেজকে পাঠানো হয়েছে ভারতবর্ষে তারা কী ধাতুর তৈরি। সেজন্য তিনি মনে করতেন সহিংস আন্দোলন ছাড়া ইংরেজদের এ দেশ থেকে হটানোর দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে গান্ধী ও সুভাষ বসুুর মধ্যে চরম মতপার্থক্য ছিল কিন্তু তার পরও দুজন দুজনকে ভীষণ স্নেহ ও শ্রদ্ধা করতেন। গান্ধী সুভাষ বসু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সুভাষ হচ্ছে দেশপ্রেমিকের বরপুত্র।’ আর সুভাষ বসু গান্ধী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘গান্ধী হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক।’ ১৯৪২ সালে সুভাষ বসুই প্রথম রেঙ্গুন বেতার থেকে গান্ধীকে ‘জাতির পিতা’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। এরপর গান্ধী যখন আততায়ীর হাতে নিহত হন তখন সেই শবানুগমনের দিন জওহরলাল নেহরু বললেন, ‘আজ আমরা জাতির পিতাকে হারালাম।’ সুস্থধারার রাজনীতির এটাই সৌন্দর্য যে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য ও দর্শনের ভিন্নতা থাকলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সব সময় অটুট থাকে।

প্রতিবাদকে অসামান্য ও অনিন্দ্যসুন্দর ভাষায় বোধকরি কবি-সাহিত্যিকদের মতো করে আর কেউ বিদিত করতে পারেননি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমান ১৯৬৩ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লেখেন তার কালজয়ী নাটক ‘ক্রীতদাসের হাসি’। তার লিখিত এ নাটকটিই ছিল তার প্রতিবাদের ভাষা। নাটকটির একেবারে শেষে আমরা দেখি তাতারী বলছে, শোন, হারুনর রশীদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্তু কিন্তু ক্রীতদাসের হাসিনা না না না।

বাংলা সাহিত্যে ইসমাইল হোসেন শিরাজীই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে প্রথম কারাবরণ করেছিলেন। ধর্মবক্তা মুনশী মেহের উল্লাহ আয়োজিত এক জনসভায় শিরাজী ‘অনল প্রবাহ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। মুনশী মেহের উল্লাহ শিরাজীর কবিতা পাঠে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, ১৯০০ সালে নিজ খরচে তিনি ওই বইটি প্রকাশ করলেন। ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে তার প্রতি জারি করল গ্রেফতারি পরোয়ানা। শিরাজী কলকাতার চন্দননগরে গিয়ে আত্মগোপন করে রইলেন আট মাস। পরে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তাকে দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হলো। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন দ্বিতীয় কবি যিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে কারাবরণ করেছিলেন। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ধূমকেতু পত্রিকার পূজা সংখ্যায় কবির ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

পুলিশ এসে হানা দেয় ধূমকেতু অফিসে, ছাপাখানাও রেহাই পেল না। বন্দী হলেন সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক। নজরুল ফেরার হয়ে গেলেন। কবিকে গ্রেফতার করা হলো কুমিল্লা থেকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার এ মামলায় কোর্টে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো তা ছিল বর্ণনাতীত। অধ্যাপক এনায়েত আলী বিশ্বাস তার নজরুলের কারাজীবন ও বাংলা সাহিত্যে জাতীয় চেতনার উম্মে ষ প্রবন্ধে লিখেছেন, বহু উকিল এলেন স্বেচ্ছায় নজরুলের পক্ষ সমর্থনের জন্য। মলিন মুখোপাধ্যায় হলেন প্রধান উকিল। সাক্ষ্য শেষে নজরুল এক লিখিত জবানবন্দি দাখিল করলেন। সেখানে কবি বললেন, ‘সত্য স্বয়ং প্রকাশ, তাকে কোন রক্ত আঁখি, রাজদ- নিরোধ করতে পারে না। দোষ আমারও নয়, আমার বীণারও নয়। দোষ তার যিনি আমার কর্ণে তার বীণা বাজান। প্রধান রাজদ্রোহী সেই বীণাবাদক ভগবান। তাকে শাস্তি দেওয়ার মতো রাজশক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নেই। আমি সত্য রক্ষার, ন্যায় উদ্ধারে, বিশ্বপ্রলয় বাহিনীর লাল সৈনিক। বাংলার শ্যাম শ্মশানের মায়া নিদ্রিত ভূমিতে আমায় তিনি পাঠিয়েছিলেন অগ্রদূত তূর্যবাদক করে। আমি সামান্য সৈনিক যতটুকু ক্ষমতা ছিল তার আদেশ পালন করছি। বিচারক জানে, আমি যা বলেছি, যা লিখেছি, তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়। ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু তবুও হয়তো সে শাস্তি দেবে। কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য।’

১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেন। কারাবাসের প্রথম কিছুদিন নজরুলকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয় ওখান থেকে কবিকে স্থানান্তরিত করা হয় হুগলি জেলে। আলীপুর থেকে হুগলি জেলে কবিকে আনা হয়েছিল হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে। জেলখানায় ঢুকেই কবি উদাত্ত কণ্ঠে হাঁক ছাড়লেন ‘দে রে গরুর গা ধুইয়ে।’ রাজনৈতিক বন্দীরা সেদিন স্তম্ভিত ও নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন কবি নজরুলের কোমরে দড়ি দেখে।

কবি নজরুল ইসলাম কিন্তু ঠিক কথাই বলেছিলেন। দোষ তো আসলে তার-ই যিনি কবির কর্ণে বীণা বাজান। প্রধান রাজদ্রোহী তো সেই বীণাবাদক ভগবান। আফসোস! যুগে যুগে রাজা কিংবা শাসনকর্তারা অন্ধ ও বধিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। তারা সেসব উপলব্ধি করতে পারেন না। তা না হলে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে এত মানুষের আত্মাহুতির পরও কেন বিপ্লøবীদের উত্থান ঠেকানো যায় না। এটাই বুঝি প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ না কেউ প্রতিবাদ করবেই। কবি জুননু রাইন যেমন বর্তমান প্রেক্ষাপটে লিখেছেন, ‘আমি আজরাইল দেখিনি প্রভু/ক্রসফায়ার দেখেছি’ কিংবা তার অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘বিশ্বজিৎরা কৃষ্ণচূড়ায় ফুটবে, ফুটতে ফুটতে/ঝরে পড়বে মহামান্যের অলস এবং বিষণ্ন ফুলবাগানে।’ অন্যদিকে আবার যখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকে না তখন জোয়ান অব আর্ক, ব্র“নো, গ্যালিলিও কিংবা কোপারনিকাসের মতো মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় পৃথিবীর সব মানুষের প্রতিবাদ। একটি কণ্ঠ হয়ে ওঠে হাজার, লাখ, কোটি কণ্ঠ। এরকমই একটি একক প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন নাঙ্গেলি নামের এক নারী। নাঙ্গেলি জম্মে  ছিলেন ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিভাঙ্কুরে। নিম্ন বর্ণের নারীর আত্মমর্যাদা আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন একক সৈনিক। নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিম্ন বর্ণের নারীর সম্মান।

ত্রিভাঙ্কুরের রাজা তার রাজ্যের হিন্দু নীচু জাতের পুরুষ ও নারীর জন্য একটি বিশেষ কর আরোপ করেছিলেন। এ আইনে পুরুষরা গোঁফ রাখতে, আর মেয়েরা স্তন ঢাকতে পারত না, এ আইনে পুরুষদের গোঁফ রাখতে হলে তার জন্য কর প্রদান করতে হতো। একইভাবে মেয়েরা তাদের স্তন ঢেকে রাখার জন্য কর দিতে হতো। এ কারণে পুরুষরা গোঁফ রাখত না। কিন্তু নারীদের জন্য স্তন ঢেকে না রাখাটা ছিল নিতান্তই অস্বস্তি ও অবমাননাকর। ফলে তারা বাধ্য হয়ে স্তনকর পরিশোধ করত। স্থানীয় ভাষায় এ করের নাম ছিল ‘মুলাক্করম’।

৩৫ বছর বয়সেও নাঙ্গেলি ছিলেন অপূর্বসুন্দরী। কিন্তু নিজের রূপ ও সুষমাকে অভিশাপ বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না তিনি। দরিদ্র পরিবারের ভাত-কাপড় জোগাতে তাকে প্রায়ই ঘরের বাইরে যেতে হতো। ফলে তার মুলাক্করম বা স্তনকর জমে যায় অনেক। রাজার লোকেরা বার বার তার বাড়ি গিয়ে করের টাকার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে। কিন্তু দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত নাঙ্গেলি এতগুলো টাকা একসঙ্গে দিতে অপারগ ছিলেন। তিনি কর সংগ্রহকারীদের অপেক্ষা করতে বললেন। তারপর ঘরে ঢুকে কাটারি দিয়ে একে একে নিজের দুটি স্তনই কেটে কলাপাতায় মুড়ে সেগুলো তুলে দিলেন রাজার পেয়াদাদের হাতে।

অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত্যু হলো নাঙ্গেলির। শেষকৃত্যের সময় নাঙ্গেলির প্রেমময় স্বামী নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন জ্বলন্ত চিতায়। ভারতের ইতিহাসে কোনো পুরুষের স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়ার ঘটনা ওটাই ছিল প্রথম, আর ওটাই শেষ। এ ঘটনার কথা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। অতঃপর তুলে নেওয়া হয় অন্যায় স্তনকরের নিয়ম।

আমি নিজেও বিশ্বাস করি সর্বশক্তিমান কেউ একজন আছেন যিনি সত্যি সত্যি প্রতিবাদীদের কানে ফুস মন্তর দেন। ফিসফিস করে বলেন, ‘ওরে জেগে ওঠ এবার। প্রতিবাদ কর অন্যায়ের।’ তা না হলে কীভাবে একজন মানুষ নিশ্চিত মৃত্যু ও আগুনে দগ্ধ হওয়ার কষ্টকে উপেক্ষা করেও নিজের শরীরে নিজে আগুন ধরিয়ে দেন। হ্যাঁ এমনই একজন মানুষের গল্প শুনিয়ে শেষ করব আজকের এ লেখা। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। দক্ষিণ ভিয়েতনামের বৌদ্ধরা নিদারুণভাবে নিপীড়ন ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ন ডিন জিয়েমের হাতে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সমাবেশ করেও কোনো ফল হচ্ছিল না। ঠিক এমন সময়ে থিক কুয়াং ডুক নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি তার জীবন উৎসর্গ করবেন নিজ ধর্মের নিপীড়িত মানুষের উদ্দেশ্যে। ঠিক সেভাবেই ’৬৩ সালের ১১ জুন দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গন শহরের একটি ব্যস্ত রাস্তায় নিজের শরীরে নিজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানালেন উৎপীড়ক প্রধানমন্ত্রী ন ডিন জিয়েমের অত্যাচারের। ম্যালকম ব্রাউন নামে এক সাংবাদিক ছবি তুলেছিলেন আগুনে ঝলসানো সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর। সেই ছবি পত্রিকার পাতায় ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময়। নিন্দার ঝড় উঠল পৃথিবীজুড়ে। জন এফ কেনেডি ওই সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি। তিনি সেই ছবি দেখে বললেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোনো ছবি কিংবা খবর এতটা মর্মান্তিক নয় এটার মতো।’ পরে আমেরিকার হস্তক্ষেপে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী ন ডিন জিয়েম। ফটোসাংবাদিক ম্যালকম ব্রাউন পেলেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পুলিৎজার।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর