শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের বেসম্ভব ত্রিকোণমিতি!

গোলাম মাওলা রনি

সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের বেসম্ভব ত্রিকোণমিতি!

একাদশ সংসদ নির্বাচন যে কবে হবে এবং কীভাবে হবে তা নিয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নির্বাচন নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলছেন তা একদিকে যেমন অস্পষ্ট তেমন বিভ্রান্তিকরও। তারা একেক সময় একেক কথা বলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এমন ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছেন যা থেকে এ মুহূর্তে শুধু রহস্যের ধোঁয়াই বের হচ্ছে। সরকারি দলের মুখপাত্র কয়েকদিন একনাগাড়ে বললেন যে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এখন তিনি নতুনভাবে বলা শুরু করেছেন, ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারির আগে যে কোনো একদিন নির্বাচন হতে পারে। অর্থমন্ত্রী একবার নির্বাচনের তারিখ ও দিনক্ষণের ঘোষণা দেন। তার সেই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেশ কর্তৃত্ব ও দাপট দেখিয়ে বিবৃতি দিলেন যে, অর্থমন্ত্রী ওভাবে বলতে পারেন না। কারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার ক্ষমতা তার নেই। সাম্প্রতিককালে তিনি আবার বললেন, আমি তো বলিনি যে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। তবে হ্যাঁ হতেও পারে! সম্ভাবনা আছে! তফসিল ঘোষণার পরই বলা যাবে, কবে নির্বাচন হবে।

উপরোক্ত কথাবার্তা ছাড়াও ইভিএম নিয়ে যা বলা হচ্ছে কিংবা শোনা যাচ্ছে, তাও জটিল সব বিতর্কের জম্ম  দিচ্ছে। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, নির্বাচন কমিশনের কমিশনারদের মধ্যে মতানৈক্য, নির্বাচন কমিশন সচিবের অতিরিক্ত নড়াচড়া এবং সিইসি নূরুল হুদার কথাবার্তা নির্বাচনসংশ্লিøষ্ট সব পক্ষকে এমনকি আওয়ামী লীগকেও বিব্রত ও বিভ্রান্ত করে তুলছে। সরকার এবং সরকারি দল আসলে বুঝতে পারছে না, তারা বর্তমান কমিশনের ওপর কতটুকু নির্ভর করতে পারে অথবা তাদের আস্থায় এনে চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায় কিনা! সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশনের অতীত ইতিহাস। অর্থাৎ অতীতে যারা কমিশনের ওপর নির্ভর করেছেন বা কমিশনকে বিশ্বাস করেছেন অথবা কমিশনের কাছ থেকে কিছু আশা করেছেন, তারা সবাই করুণ পরিণতির শিকার হয়েছেন। সেই হিসাবে বর্তমান কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অনেক গুণ বেশি। কারণ আগেকার কমিশনগুলোর সবাই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত এবং সমমত ও প্রায় সমযোগ্যতার অধিকারী। এবারই প্রথম ভিন্নমতের এবং ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতার একটি জটিল কমিশন গঠিত হয়েছে, যা ইতিমধ্যে অত্যন্ত সফলভাবে সরকার ও বিরোধী দলকে বেশ কয়েকবার বিভ্রান্ত করতে সফল হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর বিএনপি নেতৃত্ব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠককালে সিইসি হুদা বিএনপি নেতৃত্বকে নিজের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও অতীত কর্মকা- সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি বিএনপি জমানায় ডিসিগিরি করেছেন। তিনি সেদিনের আলোচনায় প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেন। বিএনপি নেতারা হাসিমুখে কমিশন থেকে বেরিয়ে আসেন এবং সীমিত আকারে নিয়ন্ত্রিত শব্দমালা ব্যবহার করে হুদার প্রশংসা করেন। এ ঘটনা নিয়ে শাসক দলে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হলে সিইসি বঙ্গশার্দূলের মতো পুনরায় ঘোষণা দেন যে, তিনি যা বলেছেন তা বুঝেশুনেই বলেছেন এবং তিনি আপন বিশ্বাস থেকেই বলেছেন। পরবর্তীকালের কয়েকটি ঘটনা বিশেষ করে বিচারপতি সিনহা থেরাপির সফল প্রয়োগের পর সরকারি অফিস-আদালতের চিত্র রাতারাতি পাল্টে যায়। তাদের মধ্যে যাদের হঠাৎ হিরো হওয়ার সাধ জেগেছিল তারা রাতারাতি ভোল পাল্টে সরকারি দলের নেতাদের সা-রে-গা-মার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের কণ্ঠনালির রেওয়াজ শুরু করে দেন; যা নিয়ে খোদ সরকার সমর্থকদের মধ্যেও অনেক সময় হাসির রোল পড়ে যায়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উল্লিখিত ত্রিভুজ সংকটের বাইরে শাসক দল ও জোটের মধ্যেও আরেকটি ত্রিভুজ সংকট রয়েছে। প্রথম সংকটটি হলো আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে। দ্বিতীয় সংকট হলো শাসক দলের শরিকদের মধ্যে আসন বণ্টনসংক্রান্ত এবং তৃতীয় সংকট হলো জোটের পরিধি বাড়ানো-কমানো। জোট ত্যাগ ও জোটে অন্তর্ভুক্তসংক্রান্ত। গত পাঁচটি বছর সরকারি দল ও জোট যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে তাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, রাজনীতিতে তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, নেই কোনো প্রতিপক্ষ। তারাই আবার ক্ষমতায় আসবে এবং শেখ হাসিনা যত দিন জীবিত থাকবেন তত দিনই তারা নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ভোগ করতে পারবেন। ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচন একটি অসিলা মাত্র, এটি অতীতের মতো কোনো বাধা-বিপত্তি বা বিপর্যয়ের কারণ হবে না। নির্বাচন হবে সরকারের ইচ্ছায় ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সেই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করবেন মাত্র। নেতা-কর্মীরা আরও বিশ্বাস করেন যে, ভোট, ভোটার, ভোটের দিন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। শুধু দলীয় মনোনয়ন পেলেই বিজয় শতভাগ নিশ্চিত। ফলে সারা দেশে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা, তাদের গতিবিধি, কর্মকা- ও তৎপরতা এতটাই বেড়েছে যা রীতিমতো গণউৎপাত বা পাবলিক নুইসেন্সে পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব উল্লিখিত পরিস্থিতি আন্দাজ করার পর বার বার বলছেন, এবারের নির্বাচন হবে কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। কেবল যোগ্য, জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে জয়লাভ করে আসতে পারবেন এমন প্রার্থীদেরই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। দলীয় কোন্দল, বিভেদ-বিসম্বাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চপদস্থ সাবেক ও বর্তমান আমলাদের দৌরাত্ম্য। অনেকে এমপি হওয়ার খায়েশে ইতিমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন এবং প্রশাসনের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে দলের পরীক্ষিত ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ের ওপর রেখেছেন। অনেক আমলা তাদের মামা-খালু-ভাগিনা-ভগ্নি-ভগ্নিপতিকেও মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন যাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা পরগাছা বলে অভিহিত করছেন। এই পরগাছারা বলে বেড়াচ্ছেন, নমিনেশন তাদের পকেটে অথবা তাকে নমিনেশন না দিয়ে সরকার পার পাবে না। তাদের মামা-খালুরা সারা দেশে সরকারকে বিনা ভোটে জিতিয়ে দেবে অথচ একটি সিটে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না এটা কি হয়! পরগাছাদের এমনতর যুক্তি শুনে কিছু টাউট, বাটপাড়, লোভী একযোগে বলে ওঠে, তা তো বটেই মামুর জোর তো সবকালেই ছিল। মামুর জোরে সরকার কলা খাবে। আর ভাগিনাদের কলা দেবে না এটা কি হয়!

ক্ষমতাসীনদের মহাজোটের অভ্যন্তরীণ সমস্যাও কম নয়। জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের দুই খন্ডিত অংশ যে কোনো পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে বাধ্য। গত পাঁচ বছরে তারা যা করেছেন, যা বলেছেন এবং যা পেয়েছেন-নিয়েছেন বা অর্জন করেছেন তা তাদের আজীবনের রাজনৈতিক আদর্শ, কথাবার্তা ও ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আওয়ামী লীগ তাদের ছুড়ে ফেলে দিলে অথবা তারা আওয়ামী লীগ ছেড়ে গেলে তাদের পরিণতি যে কী হবে তা গলির মোড়ের যে কোনো পান দোকানদারও মুখস্থ বলে দিতে পারেন। সেই দিক থেকে জাতীয় পার্টি রয়েছে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে। অন্যদিকে তাদের ঝুঁকিও কম নয়। কারণ আগামীতে যদি বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসে এবং জাতীয় পার্টি যদি তখনো পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারে, তবে ক্ষমতাসীনদের সব রাগ, ক্রোধ ও প্রতিশোধস্পৃহা জাতীয় পার্টির ওপর পড়বে; যা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। কাজেই বর্তমান সময়ে তারা খুব হিসাব করে এবং সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে, যা কিনা মহাজোটের জন্য রীতিমতো একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

মহাজোটের সঙ্গে আলোচিত-সমালোচিত হেফাজতে ইসলামের অন্তর্ভুক্তি ও মুফতি আহমদ শফীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। হেফাজত নিয়ে সরকারি মহলের অতিরিক্ত আগ্রহ দেশের সরকারপন্থি ও সরকারবিরোধী আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে যারপরনাই হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাদের মতে, হেফাজত কোনো সংগঠিত শক্তি নয়। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে যেভাবে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্ভব হয়েছিল, একইভাবে হেফাজতের সৃষ্টি হয়েছিল। হেফাজত যারা সংগঠিত করেছিলেন তার মধ্যে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন; যাদের সরকার এখনো চিনতে পারেনি বা মূল্যায়ন করেনি। অন্যদিকে মুফতি শফীকে সরকার যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তিনি আসলে হেফাজতের মূল সংগঠকদের দৃষ্টিতে সেরূপ গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম ও ভালো মানুষ হিসেবে তিনি হেফাজত আবির্ভূত হওয়ার আগে কেবল হাটহাজারী মাদ্রাসাসংশ্লি­ষ্ট মহলে পরিচিত ছিলেন। তার কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বগুণ কিংবা বিভিন্ন ইস্যুতে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের পক্ষে লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস নেই।

বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন ও ধর্মীয় তাহজিব-তমুদ্দুন প্রতিষ্ঠায় অতীতে হজরত হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী, মাওলানা ওবায়দুল হক, শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক, মাওলানা ফজলুল হক আমিনী প্রমুখ যেরূপ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন সেরূপ কোনো কর্মকান্ডে মাওলানা শফী জড়াননি। অধিকন্তু লেখাপড়া, বাগ্মিতা, নেতৃত্বগুণ এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তিনি মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী, মাওলানা বাবুনগরী প্রমুখের সমপর্যায়ের লোকও নন। কাজেই সরকার যখন মাওলানা শফী-কেন্দ্রিক হেফাজতের সঙ্গে ঐক্য করবে তখন তা সত্যিকার হেফাজত নেতাদের সরকারবিরোধী শিবিরে যোগদান করার রাস্তা তৈরি করবে যা সরকারের উপকার না হয়ে মস্তবড় ক্ষতির কারণ হবে। অধিকন্তু হেফাজতের সঙ্গে সরকারের যখন দূরত্ব চলছিল তখন সরকার সমর্থক মিডিয়া, সরকারি দল ও জোটের বক্তারা দশমুখে যাচ্ছেতাই বলে মাওলানা শফীকে সারা দেশের মানুষের কাছে তেঁতুল হুজুর বলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। ফলে সেই তেঁতুলের সঙ্গে রাজনৈতিক মিত্রতা দলের অভ্যন্তরে যেমন অস্বস্তি সৃষ্টি করবে, তেমন দলের বাইরে সৃষ্টি করবে নানামুখী হাস্যরস ও রংতামাশামূলক কেচ্ছা-কাহিনীর।

সরকারি প্রশাসনযন্ত্র ও ক্ষমতাসীন মহাজোট-কেন্দ্রিক ত্রিমাত্রিক সংকটের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এবার সরকারবিরোধী শিবির নিয়ে যে ত্রিভুজ সংকট নয়া ত্রিকোণমিতি সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে কিছু বলা যাক। বিরোধী দলকে নিয়ে সরকারের প্রথম সমস্যা হলো তারা বিরোধী দল ও জোটের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং অভিলাষ সম্পর্কে ধারণা করতে পারছে না। তাদের পরিকল্পনা, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কূটনৈতিক তৎপরতার সঠিক খবরগুলো সরকারের কাছে নেই। বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন এবং রাজনীতির ভাষা ও ব্যাকরণ বোঝেন এমন কোনো আওয়ামী লীগ  নেতাকে দায়িত্ব না দিয়ে সরকার বিভিন্ন সংস্থার লোকজনকে দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব লোকজন দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো যতটা সহজ তার ঠিক উল্টোটা ঘটে যদি তাদের দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা, কিংবা রাজনীতির অভ্যন্তরীণ খবরাদি সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। বেসামরিক কিংবা সামরিক আমলাদের কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দিয়ে রাজনীতিবিদদের মন ও মানস অনুধাবন ও মূল্যায়ন করা যায় না। অধিকন্তু রাজনীতির মানুষ না হলে এ অঙ্গনের সমস্যা ও সম্ভাবনা কেউ আন্দাজ করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা সরকারি নির্দেশে মহাহাঁকডাক করে বিরোধী দলের লোকজনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে যা জেনে যান, যা বোঝেন এবং যা তাদের নিয়োগকর্তার কাছে সরবরাহ করেন তার সঙ্গে প্রায়ই বাস্তবের মিল থাকে না।

বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে সরকারের দ্বিতীয় সমস্যা হলো সাম্প্রতিককালের যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক সমঝোতা। আমরা যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকেই নিশ্চিতভাবে জানতাম যে, ড. কামালকে কেন্দ্র করে আগামীতে বৃহত্তর একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্বের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উদ্যমের কারণেই তা হচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্ব মনে করছেন, গত ১০টি বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিভেদ ও ক্রোধের জম্ম  দিয়েছে তা বাংলার আনাচে কানাচে থাকা বিএনপি-জামায়াতের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে সংক্ষুব্ধ, উত্তেজিত, অস্থির ও প্রতিহিংসাপরায়ণ বানিয়ে ফেলছে। ফলে বিএনপি-জামায়াত যদি ক্ষমতায় আসে তবে সারা বাংলায় যে খুন-খারাবি শুরু হবে তা স্মরণকালের ভয়াবহতম পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তাই তারা ক্ষমতার রাজনীতি করলেও ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত। অধিকন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষনেতৃত্বের বিরুদ্ধে চলমান মামলা-মোকদ্দমা যেমন তাদের প্রধান সমস্যা তেমন নিজেদের দলে ঝামেলামুক্ত, ক্লিন ইমেজের কোনো জাতীয় নেতার অভাবও কম বড় সমস্যা নয়। এসব সমস্যা এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা সারা দেশে সুপরিচিত ও ক্লিন ইমেজধারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে নিজেদের জনসমর্থন, সাংগঠনিক ভিত্তি ও অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের আদলে একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠনের চেষ্টা করে আসছিলেন।

দেশের আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নেতৃত্বে এবং বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতায় জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যেভাবে শুরু হয়েছে তার শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা সরকারি মহল আন্দাজ করতে পারছে না। সরকার পাঁচ বছরে যেভাবে লাঠিথেরাপি প্রয়োগ করে বড় বড় রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেছে তা শেষ পর্যন্ত ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে কিনা তা নিয়েও তারা সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। সরকারবিরোধীদের ঐক্য, আসন বণ্টন ও তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উত্তাপ বহুলাংশে নির্ভর করবে। সরকারের জন্য তৃতীয় সমস্যা হলো জামায়াতে ইসলামী। তারা একদিকে যেমন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক ঐক্য অটুট রেখেছে। এর বাইরে আলাদা সত্তা হিসেবেও জামায়াত সামনের দিনগুলো থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যা কোনোভাবেই সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের কূটনৈতিক অঙ্গনেও ত্রিমুখী সমীকরণ শুরু হয়েছে। সরকারের বন্ধু বলে পরিচিত ভারত যে আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরের সঙ্গে সংযোগ রাখছে না কিংবা তাদের মদদ দিচ্ছে না তা দিব্যি করে বলা যাচ্ছে না। ওদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গেও সরকারের মিত্রতার বন্ধন অদ্যাবধি তৈরি হয়নি। জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, কমনওয়েলথ, ওআইসি প্রভৃতি সংস্থাহ ওপরে ওপরে সরকারের প্রশংসা করলেও তারা যে শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনের ইঙ্গিতে সবকিছু করবে তা সবাই জানে। ফলে এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সুবিধাভোগী লাখ লাখ সাধারণ মানুষ নির্বাচনের সময় কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে তা এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। এসব সমীকরণ ছাড়াও চীন, তুরস্ক, সৌদি আরব ও রাশিয়া ইদানীংকালে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা আগামী নির্বাচন সম্পর্কে রহস্যজনক নীরব ভূমিকার দ্বারা পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।

দেশের আর্থিক খাতের ত্রিভুজ সংকট নির্বাচনকে ক্ষমতাসীনদের জন্য জটিল ও কুটিল বানিয়ে ফেলবে। যারা গত পাঁচ বছরে প্রচুর কালো টাকা উপার্জন করেছেন তারা নির্বিচারে টাকা পাচার শুরু করেছেন বলে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের অভাব, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, সরকারি চাকুরে এবং বেসরকারি চাকুরেদের আয়-রোজগারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, সরকারদলীয় লোকজনের টাকার আধিক্য এবং বিরোধী দলের লোকজনের ক্রমাগত আর্থিক বঞ্চনার কারণে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তা সম্মিলিতভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শিরোনামে যে বেসম্ভব ত্রিকোণমিতির কথা বলেছি তা নিয়ে দু-চারটি কথা বলে নিবন্ধের ইতি টানব। একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরক্ষণ থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা এবং নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি দিন হবে সরকার ও বিরোধী দলের জন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো জটিল ও কঠিন। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন, গণমুখী অভিনব প্রচার-প্রপাগান্ডা ও জনসাধারণকে স্বপ্ন দেখানোর ক্ষেত্রে যারা বেশি সফল হবেন তারাই যুদ্ধে জয়ী হবেন এমনতর চিরসত্য অমিয় বাণী এবারকার কুরুক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। কারণ বহুসংখ্যক ত্রিভুজ সংকট একত্র হয়ে আমাদের রাজনীতিতে এমন এক জটিল ত্রিকোণমিতি সৃষ্টি করেছে, যার পরিণতিতে নির্বাচনের ফলাফল রাজনীতির সূত্রমতে হবে না।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর