শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পোলট্রি বর্জ্য থেকে জৈববিদ্যুৎ

শাইখ সিরাজ

পোলট্রি বর্জ্য থেকে জৈববিদ্যুৎ

আমি বেড়ে উঠেছি এই ঢাকা শহরেই। বড় প্রিয় এ শহর। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় ঢাকা ছিল অন্যরকম এক সৌন্দর্যের শহর। প্রতিটি মানুষের মাঝে ছিল প্রাণের ঝঙ্কার। এই শহরের প্রতিটি মানুষই যেন ছিল একে অন্যের আপন। ক্রমেই বাড়তে থাকল শহরে মানুষের সংখ্যা। আর মানুষ দূরে সরে যেতে থাকল একে অন্যের থেকে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ২ কোটির ওপরে। ২ কোটি মানুষ ঢাকা শহরটিকে পরিণত করেছে বর্জ্যরে নগরীতে। যে যেখানে পারছে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। আবর্জনা যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হয় তাই-ই অধিকাংশের শিক্ষার মাঝে নেই। রাস্তাঘাট, পার্ক, খোলা জায়গা হয়ে উঠেছে ডাস্টবিন। ২০১৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন প্রায় ১১ হাজার মিনি ডাস্টবিন বসিয়েছিল রাস্তার পাশে। আমি ভেবেছিলাম, যাক, এবার নিশ্চয়ই রাস্তাঘাটের চিত্র বদলাবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। দুই বছরে মিনি ডাস্টবিনগুলোকেই আমরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। একটা অনভ্যস্ত জাতিকে অভ্যস্ত করা খুব কঠিন বিষয়। সেটা শুরু করতে হবে পরিবার ও স্কুল থেকে। গত বছর ডয়েচে ভেলের একটা প্রতিবেদন পড়ে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম। এক প্রকার কালো মাছি নাকি বর্জ্যকে পশুখাদ্যে পরিণত করতে পারবে। অনেকটা কেঁচো থেকে আমরা যেমন জৈবসার পাই সে রকম। এসব মাছি নাকি রোগ ছড়ায় না। ইন্দোনেশিয়ার কৃষিশিল্পের সাবেক উপমন্ত্রী আগুস পাকপাহান এ নিয়ে গবেষণা করে সফল হয়েছেন। পুরো প্রতিবেদনটি ছিল খুব আশাজাগানিয়া।

যাই হোক, বলছিলাম বর্জ্যরে কথা। সারা পৃথিবীই এখন শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তিত। কৃষি খাতে, বিশেষ করে পোলট্রি শিল্পের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সঠিকভাবে এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে অল্প দিনেই পোলট্রি খামার পরিবেশের জন্য যেমন বিরূপ হয়ে ওঠে, একইভাবে বিরূপ হয়ে ওঠে পোলট্রির জন্যও। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে অথবা ব্যবস্থাপনা না করার কারণে খামারের মুরগি নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এ ছাড়া গবাদিপশুর বিষ্ঠা বা গরুর গোবরের যেমন বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে, পোলট্রি বর্জ্যরে এমন বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে ছোটো খামারিরা খুব বেশি সচেতন নন। তবে অনেক কৃষক ও খামারি পোলট্রি বর্জ্য সংরক্ষণ করে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর জৈবসার হিসেবে তা আবাদি খেতে ব্যবহার করেন। অনেকে পোলট্রি বর্জ্যকে কেঁচো সারের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রায় বছর দশ-বারো আগে ঢাকার বেরাইদে স্থাপিত আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় পোলট্রি খামার ওমেগা পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু করে। অবশ্য, সেটি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় না হলেও ছিল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি কার্যকর উদ্যোগ।

পোলট্রি বর্জ্য থেকে জৈবসার বা বায়োগ্যাস উৎপাদন পুরনো খবর। বায়োগ্যাস নিয়ে কাজ করেছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে ’৯০-এর দশকে। সে সময় বিটিভিতে বায়োগ্যাস প্ল­ান্ট নিয়ে ডজনখানেক প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। ফলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে। সে সময় গ্রামীণ গৃহস্থালির জ্বালানির সংকট ছিল। এখন তো গ্যাস সিলিন্ডার চলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িও। তখন তা ছিল না। অবাধে বৃক্ষ নিধন হতো। ’৯০-এর দশকে বৃক্ষরোপণের ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। সেই সংকটের সময় যখন বায়োগ্যাস প্লান্ট বিষয়টাকে তুলে ধরলাম তখন মানুষের ভিতর বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। একটা গৃহস্থ পরিবারে যদি পাঁচটি গরু থাকে, সেই গরুর প্রতিদিনের যে গোবর আসে, সেই গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্লøান্টের মাধ্যমে দুই বেলা রান্না, বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি পাওয়া যাবে জৈবসার। সেই প্রতিবেদনগুলো প্রচারের পর প্রচুর চিঠি আসত বিস্তারিত জানার জন্য। বিসিএসআইআরের জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক আখতারুজ্জামান সাহেবের দফতরে দেখেছিলাম বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণের অসংখ্য নির্দেশিকা। সেগুলো আমি নিয়ে এলাম। অনুষ্ঠানের এক পর্বে বলে দিলাম, যারা বিস্তারিত জানতে চান তারা যেন চিঠির সঙ্গে নিজের ঠিকানাসহ ডাকটিকিট-সংবলিত একটা খালি খাম পাঠান। প্রতিদিন হাজার হাজার চিঠি আসত। আমি আর আমার স্ত্রী শাহানা মিলে সেসব খামে ভরে ব্যাগে করে দিয়ে আসতাম খিলগাঁও পোস্ট অফিসে। ৩০ বছরে পৃথিবী বদলেছে অনেকখানি। হাজার গুণ গতিতে এগিয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু জৈব জ্বালানির বিকল্প পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি; যার কারণে উন্নত দেশগুলোও জৈব পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছে। এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক আছে। এক. বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দুই. জাতীয় গ্রিডে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। স্ট্যাটিস্টার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে গত বছর ১২২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে বায়োমাস পাওয়ার প্লান্ট থেকে। এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ১৬.৭ গিগাওয়াট, চীনের ১৪.৯ গিগাওয়াট, ভারতের ৯.৫ গিগাওয়াট, জার্মানির ৮ গিগাওয়াট, যুক্তরাজ্যের ৬ গিগাওয়াট ও জাপানের ৩.৬ গিগাওয়াট। ২০০৫ সালে জাপানের মরিওকায় অবস্থিত কইওয়াই অর্গানিক ফার্মে প্রথম বড় আকারের বায়োগ্যাস প্লান্টের ওপর প্রতিবেদন ধারণ করেছিলাম। ২০১৬ সালে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিলাম, জার্মানির জেলসনে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এক জৈববিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, যেখানে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রধানত শস্যদানা। খাদ্যসংকট না থাকায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ শস্যদানা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়।

এ তো গেল আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা উন্নত বিশ্বের বায়োমাস পাওয়ার প্লান্টের কথা। এ বছর জুলাইয়ে আমাদের দেশের প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের আমন্ত্রণে গাজীপুর গিয়ে দেখি তিনিও প্রতিষ্ঠা করেছেন জৈব পাওয়ার প্লান্ট। গাজীপুরের বানিয়াচরা গ্রামে সম্পূর্ণ পোলট্রি বর্জ্যকে ব্যবহার করে যে জৈব পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি নতুন উদ্যোগ। বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্পে বেশ সফল ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান প্যারাগন এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু করার মধ্য দিয়ে একটি শিল্পকে একাধিক শিল্পে রূপ দেওয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিক, সামাজিক ও পরিবেশসম্মত শিল্প ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত গড়েছে।

মশিউর রহমান জানান, তার আড়াই লাখ পোলট্রির বর্জ্য নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েন। প্রথমে ছোট ছোট কুয়া করে সেগুলোকে পুঁতে ফেললেও পরে দেখলেন এ বর্জ্যই হয়ে উঠছে তার খামারের পোলট্রির জন্য বিপজ্জনক ও ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। লাগছে অনেক লোকবল। অনেকটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। সমাধান পেয়েছেন ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর প্রতিবেদন দেখে। তিনিও উদ্যোগ নিলেন জৈব পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের। আর এখন আড়াই লাখ পোলট্রির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ৩৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ। এতে মেটাতে সক্ষম হচ্ছেন তার খামারের ১৪ ঘণ্টার বিদ্যুতের চাহিদা। পাশাপাশি উৎপাদিত জৈবসার ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ফল-ফসলের চাষে। পাওয়ার প্লান্টটিতে ব্যবহৃত হচ্ছে শতভাগ পোলট্রি বর্জ্য। এ ব্যবস্থাপনাটি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হওয়ায় শ্রমিক খরচ নেই বললেই চলে। জার্মানির জেলসনের জৈববিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রেও একই চিত্র দেখেছিলাম। ওই কোম্পানির দুজন মালিক দুই বন্ধু পিপা ও পাপে। তারাই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক থেকে মালিকের পুরো দায়িত্ব সামলান। সবখানেই এখন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটিই অনুসরণ করা হয়। ২০১৬ সালে পোলট্রি শিল্পের উৎকর্ষ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে চীনের শ্যাংডং প্রদেশেও একই চিত্র দেখেছি। সেখানে বড় বড় পোলট্রি খামার ও সংরক্ষিত মাতৃখামারগুলো পরিচালিত হচ্ছে একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। বিশাল বিশাল শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে একজন বা সর্বোচ্চ দুজনের মাধ্যমে। বেশকিছু পোলট্রি খামারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক ব্যবস্থাও দেখেছিলাম। প্যারাগনের স্বত্বাধিকারী মশিউর রহমান জানান, পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে এমন একটি জৈববিদ্যুৎ প্রকল্প সংযুক্ত করে দেওয়ায় বহুভাবে লাভবান হচ্ছেন তিনি। বড় পোলট্রি খামারগুলো যদি এ ব্যবস্থা অনুসরণ করে তাহলে তা আমাদের জাতীয় গ্রিডেও সংযুক্ত হতে পারে। পাওয়া যেতে পারে আরও নানাবিধ সুফল। এটি গোটা পোলট্রি শিল্পের জন্যই হতে পারে অনুসরণীয় এক দৃষ্টান্ত। বিশ্বব্যাপী কৃষি খামারের ব্যবস্থাপনাটি এখন মিলিত হয়েছে শিল্পব্যবস্থাপনার সঙ্গে। কৃষিশিল্প উদ্যোক্তারা চাইছেন একটি শিল্পপণ্যকে বহু শিল্পপণ্যে রূপ দিতে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রকুশলীর উৎকর্ষে তা সম্ভবও হচ্ছে সহজে। পোলট্রি শিল্পের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ব্যবস্থাটি বড় বড় সব পোলট্রি শিল্পে অনুসরণ করা হলে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার একটি অংশ পূরণ হতে পারে এ খাত থেকে। শুধু পোলট্রি শিল্প নয়, সব ধরনের জৈববর্জ্য থেকেই সম্ভব নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে বর্জ্যই খুলে দিতে পারে অমিত সম্ভাবনার দ্বার। সেই সঙ্গে পাওয়া যেতে পারে উৎকৃষ্টমানের জৈবসার। মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনার জন্য জৈবসারই এখন কৃষকের প্রধান ভরসা।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর