সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও নির্বাচন-২০১৮

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও নির্বাচন-২০১৮

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে এ নির্বাচনটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ১৯৭৫ সালের অব্যবহিত পর আমরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছিলাম সেটি ফিরে পাওয়ার সংগ্রামে ২০১৮ সালে এসে আমরা একটা টার্নিং পয়েন্টে বা যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। এ টার্নিং পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশ কোন দিকে মোড় নেবে তার ওপর নির্ভর করছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার সংগ্রামে আমরা কি জয়ী হতে চলেছি নাকি ভূতের মতো আবারও বাংলাদেশ পেছনের দিকে হাঁটা শুরু করবে। এই সময়ে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের স্বরূপটার দিকে তাকালেই উপরোক্ত টার্নিং পয়েন্টের বৈশিষ্ট্যটি বোঝা যায়। এতদিনে বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছে পঁচাত্তরের পর নতুন করে আবির্ভূত রাজনৈতিক শক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে নিষিদ্ধের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এবং পুনঃউত্থানের সুযোগ করে দেয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত, ৪৩ বছর এ দুই অপশক্তি মিলে বাংলাদেশের কতবড় সর্বনাশ করেছে তার ইতিহাস কমবেশি আমরা সবাই জানি। সে ইতিহাস অনেক লম্বা। ছোট করে কয়েকটি বিষয় উল্লে­খ করি। প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক একাত্তরের পরাজিত শক্তির ওপর ভর করে ১৯৭৮ সালে সামরিক আদেশ বলে সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শন বলতে যা বোঝায় তার সব শব্দ, বাক্য ও অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেন। একটা রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝা যায় তার সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে তাকিয়ে। সেখানে যখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শনের কোনো প্রতিফলন থাকে না, তখন সেটিকে আর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলা যায় না। সুতরাং ১৯৭৮ সালের পর যে রাষ্ট্র আমরা পাই সেটি ছিল বাংলাদেশের নামের খোলসে ধর্মাশ্রায়ী আরেকটি পাকিস্তানি মানসতন্ত্রের রাষ্ট্র। তার পরিণতিতে আমরা কী দেখলাম। রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হলেন। যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী এবং সবরকম মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তগণ দলে দলে মন্ত্রী, এমপি এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিমান পদে অধিষ্ঠিত হলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ পেয়ে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, জামায়াতিসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা কয়েক বছরের মধ্যে বিশাল ধন সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের মধ্যে এতিম হয়ে গেলেন। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হলো। যারা বেঁচে থাকলেন তারা চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু থেকে বঞ্চিত হলেন।

রাজাকার আর জামায়াতিরা মুখ ভেংচিয়ে জনসমাবেশে বলা শুরু করলেন, ও! মিয়ারা বলি নাই মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করে কোনো লাভ হবে না, চেয়ারম্যান, মেম্বর এখন আমরাই হব, দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের। হ্যাঁ এ কথা সত্য, দুয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্ষমতা ও অর্থ সম্পদের লোভে ভুলে যান মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার এক কাতারে চলতে পারে না। তখন পানের দোকান থেকে শুরু করে ওষুধের দোকান, শপিং মল, কোচিং সেন্টার, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, সব জায়গায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এক সময়ে এসে তারা বলা শুরু করে এদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। এ ধৃষ্টতার মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির দীর্ঘ সংগ্রাম এবং তার বাঁকে বাঁকে তৈরি অফুরান্ত চেতনার উৎস, অনুপ্রেরণার ঝরনাধারাকে অস্বীকার শুধু নয়, বাঙালি জাতির সব গৌরব ও অহংকারকে কালো অন্ধকার গুহার মধ্যে ফেলে দেয়। তাতে ৩০ লাখ শহীদ এবং লাখো মুক্তিযোদ্ধাকে অসম্মান এবং অস্বীকার করা হলো। নতুন প্রজম্ম  ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল এবং দুঃখজনক হলেও সত্য এ বিভ্রান্তিতে পড়া নতুন প্রজম্মে র বড় একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের ওই বিরোধীপক্ষের কুমন্ত্রণায় বশীভূত হয়ে যায়। ধর্মান্ধ উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। আদালতে আক্রমণ, বিচারক হত্যাসহ কোনো কোনো অঞ্চলে জঙ্গিরা নিজেদের স্বশাসন জারি করে প্রগতিশীল যুবকদের হত্যা করা শুরু করে এবং ধৃষ্টতার সব সীমা লঙ্ঘন করে নিহত ব্যক্তির লাশ উল্টো করে গাছের ডালের সঙ্গে ঝুলিয়ে মানুষকে ডেকে এনে তা দেখতে বাধ্য করে। সে সময়ের প্রশাসন সেটি দেখেও না দেখার ভান করে। উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রকাশ্যে স্লো গান দেয় ‘আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগান।’ কী ভয়ঙ্কর উম্মাাদনা। বংলাদেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের লোকেরা তখন ঘন ঘন পাকিস্তান আফগানিস্তানে সফর করা শুরু করে এবং দেশে ফিরে এসে যুব সমাজের মধ্যে উগ্রবাদের মন্ত্রণা ছড়াতে থকে। চট্টগ্রামে লালদীঘির বড় মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ এক মাওলনা আফগান ঘুরে এসে পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখলেন- তালেবানের অফগানিস্তানের জান্নাত দেখে এলাম। সেটি ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বীভৎস অন্ধকার সময়। কিন্তু বাঙালি জাতি পরাজয় মেনে নেওয়ার জাতি নয়। জাতির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের এক মহাশক্তিশালী মন্ত্রণা দিয়ে গেছেন। বলেছেন, মরতে যখন শিখেছি তখন বাঙালি জাতিকে আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বাঙালি জাতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক, সামাজিক শক্তিসহ জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং সমগ্র তরুণ প্রজম্মে র সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ ২০১৮ সালে এসে পরিপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে আমরা উপনীত হয়েছি। কালো অন্ধকার রাতের দুঃসহ যন্ত্রণা পেরিয়ে আলোকিত ভোরের অপেক্ষায়। আর একটু রাত পেরোতে পারলেই পরিপূর্ণ ভোরের দেখা। এর মধ্যে আমরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করেছি, মশহুর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও দ- কার্যকর হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রায় সবই সংবিধানের পুনঃসন্নিবেশিত হয়েছে। কিন্তু পরিপূর্ণ হয়নি। রাষ্ট্রধর্ম রয়ে গেছে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি বহাল আছে। গত ১০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর দেশ পরিচালিত হচ্ছে বলেই বাংলাদেশ আজ দারিদ্র্য দূরীকরণে রোল মডেল এবং উন্নয়নের বিস্ময়। শুধু তাই নয়, জঙ্গি দমনের রোল মডেল এবং বিশ্ব অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের মিশনের আওতায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আজ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিটি সূচকে চার থেকে পাঁচগুণ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য এবং বিচরণ করছে মহাশূন্যে।

কৃষি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্ট্র্যাটেজিক সেক্টর, একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য এ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে বাংলাদেশ আজ শক্তিশালী ভিত তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। সম্প্রতি বিশ্বের নামকরা অর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি এক গবেষণার মাধ্যমে বলেছে, বর্তমান সময়ের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ। এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরআইয়ের প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ তরুণ মনে করে, দেশ ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা অত্যন্ত আশাবাদী। পঁচাত্তরের পর যেসব অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ওপর কালিমা লেপন করেছে তারা সবাই আজ রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্থ এবং প্রান্তিক অবস্থানে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজম্ম  তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিজয়ী হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে থাকবে না। পরিপূর্ণভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সব রাজননৈতিক দল হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে এবং আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াকে অতিক্রম করবে, এরকমই ভবিষ্যদ্বাণী করছে বিশ্বের বড় বড় নামজাদা সব গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ২০১৮ সালের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে জয়ী করার জন্য বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজম্ম কে দায়িত্ব নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী তারাই যারা, এক. একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অবমাননা করে, অস্বীকার করে এবং জাতির পিতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার ও সম্মান করে না। দুই. মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তার স্মারক ও বৈশিষ্ট্য বাহাত্তরের সংবিধানে সন্নিবেশিত ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়বাদ এবং সমাজতন্ত্র, এই চার মৌলিক নীতিকে যারা অমান্য এবং অস্বীকার করে। তিন. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে প্রতিষ্ঠিত গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাবলির বিশাল ঐতিহাসিক মূল্যকে যারা অস্বীকার করে, ম্লান এবং আড়াল করে। চার. ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যারা করে এবং এদের সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে সহায়তা করে। পাঁচ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যারা বিরোধিতা করেছে এবং এখনো করছে। ছয়. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র নয় মাসে বিজয় অর্জনের পেছনে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত জয় বাংলা স্লো গানকে যারা অস্বীকার করে। এক থেকে ছয় পর্যন্ত ক্রমিকে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, বৈশিষ্ট্য এবং আলোর পথের দিশারী। এগুলো না থাকলে বাংলাদেশ থাকে না। নতুন প্রজম্মে র ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাইলে প্রগতিশীল, অধুনিক, অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধমুক্ত বাংলাদেশের কোনো বিকল্প নেই। আর সেটাই হলো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লে­ষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর