সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

যৌনদাসী থেকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাদিয়া

সুমন পালিত

যৌনদাসী থেকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাদিয়া

এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২৫ বছর বয়সী ইরাকি মেয়ে নাদিয়া মুরাদ। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়ে নাদিয়াকে এই মর্যাদাবান পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য লড়াই চালানোর স্বীকৃতি হিসেবে। একই ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য যৌথভাবে এ পুরস্কার পেয়েছেন কঙ্গোর চিকিৎসক ডেনিস মুকওয়েগে। তিনি ১৯ বছর ধরে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের চিকিৎসা দিয়ে  আসছেন। এ পর্যন্ত ৫০ হাজার নারী চিকিৎসা পেয়েছে তার হাসপাতালে।

ইয়াজিদি সম্প্রদায় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্মমত। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিদের মতো একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করে তারা। আরব ভূখন্ডে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পর ইয়াজিদি ধর্ম মতের অনুসারীদের অবস্থা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে। ইয়াজিদি সম্প্রদায় ইরাকের মাউন্ট সিনজার উপত্যকার বিভিন্ন গিরিখাতে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও। ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামী স্টেট বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীর অভ্যুদয়ের পর কুর্দি ভাষী এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যরা চরম নৃশংসতার শিকার হয়। এ সম্প্রদায়ের হাজার হাজার সদস্য প্রাণ হারায়। ইয়াজিদি নারী সদস্যদের আইএস জঙ্গিরা যৌনদাসীতে পরিণত করে। অস্তিত্বের সংকটে পড়ে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই ধর্মমতের অনুসারীরা।

মধ্যপ্রাচ্যের একশ্বরবাদী তিনটি প্রধান ধর্মের মতো ইয়াজিদিরাও ঐশী গ্রন্থের অধিকারী। তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম কিতাব আল জিলওয়াহ বা প্রত্যাদেশকৃত গ্রন্থ। ধর্ম পালনে নিষ্ঠাবান হলেও তারা অপর ধর্মের লোকজনের সামনে নিজেদের ধর্মাচারকে গোপন রাখার চেষ্টা করে।

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্ল­াহ মানুষ সৃষ্টি করেন মাটি দিয়ে। প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টি করার পর ফেরেশতাদের নির্দেশ দেন তাকে সেজদা করার জন্যে। ফেরেস্তাদের অন্য সবাই আল্ল­াহর এ নির্দেশ মান্য করলেও আপত্তি করেন প্রধান ফেরেশতা ইবলিশ। মাটি দিয়ে সৃষ্ট মানুষকে সেজদা করা নিজের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন তিনি। এই অবাধ্যতার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হয়। শয়তান হিসেবে ধিকৃত হন তিনি। ইয়াজিদিরা সৃষ্টিতত্ত্বের বিষয়ে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও শয়তান তত্ত্বের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে। ইয়াজিদিদের সর্বোচ্চ উপাস্যের নাম ইয়াজদান। খোদা বা ঈশ্বর হিসেবে তাকে মান্য করে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা। তাদের বিশ্বাস খোদা ইয়াজদান সাতজন  ফেরেশতার দ্বারা সৃষ্টি জগৎ পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে প্রধান হলেন মালিক তাউস। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস খোদা মানুষ সৃষ্টি করার পর তাকে সেজদা করার যে নির্দেশ দেন প্রধান ফেরেশতা মালিক তাউস সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করে কোনো অন্যায় করেননি। কারণ খোদা ছাড়া কাউকে সেজদা করা হলে তা সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যে ব্যত্যয় ঘটানো হতো। ইয়াজিদিদের বিশ্বাস, খোদা আদমকে সেজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ফেরেশতাদের পরীক্ষার জন্য। আদমকে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মালিক তাউস প্রকারান্তরে সর্বশক্তিমান খোদা যে একমাত্র উপাস্য সে প্রমাণই রেখেছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের একেশ্বরবাদী তিনটি প্রধান ধর্মমত ইসলাম, খিষ্টান ও ইহুদিদের বিশ্বাস, আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করায় ইবলিশকে প্রধান ফেরেশতার পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাকে অভিশপ্ত শয়তান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাদের উপাসনায় নিন্দিত ও ঘৃণিত  শয়তানের হাত থেকে রেহাই পেতে মহান আল্ল­াহর সহায়তা চান। পক্ষান্তরে ইয়াজিদি সম্প্রদায় আদমকে সেজদা করতে অস্বীকৃতিকারী ‘মালিক তাউস’কে শয়তান হিসেবে ধিক্কার দেওয়া এবং এড়িয়ে চলার বদলে তার উপাসনা করে। ইয়াজিদি সম্প্রদায় নিজেদের একেশ্বরবাদী বলে দাবি করলেও তারা নামাজ আদায় করে মালিক তাউসের উদ্দেশ্যে। যে কারণে একেশ্বরবাদী ইসলাম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা ইয়াজিদিদের শয়তান পূজারি মনে করে ও বাঁকা চোখে দেখে।

ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, খোদা ইয়াজদান সর্বশক্তিমান এবং তার কোনো শরিক নেই। তবে সরাসরি সর্বশক্তিমান খোদার উপাসনা করা যায় না। যে সাত ফেরেশতার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি জগৎ পরিচালনা করেন তাদের প্রধান মালিক তাউস বা ময়ূর ফেরেশতার উপাসনার মাধ্যমে তারা খোদা ইয়াজদানকে সন্তুষ্ট রাখে। কুর্দি ভাষাতাত্ত্বিক জামেল নেবেজের মতে, তাউস শব্দটির উদ্ভব গ্রিকভাষা থেকে, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তা।

ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের লোকেরা বারবার নির্যাতিত হয়েছে। গণহত্যার শিকারও হয়েছে তারা। ১৮ ও ১৯ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ইয়াজিদিরা অন্তত ৭২ বার গণহত্যার শিকার হয়। ২০০৭ সালে উত্তর ইরাকে গাড়িবোমা হামলায় কয়েকশ ইয়াজিদি নিহত হয়। ইরাক রেড সিক্রেন্টের মতে গাড়ি হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৮০০। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর এটিই সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা। আইএসের আক্রমণের শিকার হওয়ার আগে আল-কায়েদা ইয়াজিদিদের হত্যার হুমকি দিয়েছে। বারংবার আক্রমণের মুখে ইরাকের ৭০ হাজার ইয়াজিদি যা মোট ইয়াজিদি জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, ইউরোপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, বর্তমানে তাদের সংখ্যা আট লাখের মতো। ইরাকে ৬ লাখ ৫০ হাজার, জার্মানিতে ৬০ হাজার, সিরিয়ায় ৫০ হাজার, রাশিয়ায় ৪০ হাজার ৫৮৬, আর্মেনিয়ায় ৩৫ হাজার ২৭২, জর্জিয়ায় ২০ হাজার ৮৪৩, সুইডেনে ৪ হাজার, তুরস্কে ৩৭৭, ডেনমার্কে ৫০০ ইয়াজিদির বসবাস।

মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিদের মতো ইয়াজিদিরাও বিশ্বাস করে দুনিয়ার প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়া। তবে তারা নিজেদের আদম-হাওয়ার বংশধর বলে দাবি করে না। এ ক্ষেত্রে ইয়াজিদিরা অদ্বৈতবাদী চেতনার অনুসারী। তাদের বিশ্বাস ইয়াজদান বা খোদা মানব জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইয়াজিদিদের সৃষ্টি করেছেন। এ কারণে ইয়াজিদিরা অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এমনকি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা থেকে বিরত থাকে। মুসলমানদের মতো  ইয়াজিদিরা দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে। তাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নাম নিভেজা বেরিস্পেদে (ভোরের নামাজ), নিভেজা রোঝিলাতিনে (সূর্যোদয়ের নামাজ), নিভেজা নিভ্রো (দুপুরের নামাজ), নিভেজা এভারি (বিকালের নামাজ), নিভেজা রোজাভাবুনে (সূর্যাস্তের নামাজ)। তবে সাধারণত দুই ওয়াক্ত নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেয় ইয়াজিদিরা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নামাজ নিয়মিত পড়া হলেও সাধারণ ইয়াজিদিরা বাকিগুলো তেমন পড়ে না। সূর্যোদয়ের নামাজের সময় ইয়াজিদিরা সূর্য পূজারিদের মতো সূর্যের দিকে এবং সূর্যাস্তের নামাজের সময় লাল আভার দিকে মুখ করে থাকে। দিনের সব নামাজ সূর্যের দিকে ফিরে পড়া হয়। বুধবার হচ্ছে তাদের পবিত্র দিন এবং ইহুদিদের মতো শনিবার বিশ্রাম দিবস। ডিসেম্বর মাসে তারা তিন দিনের রোজা পালন করে।

ইয়াজিদি সম্প্রদায় একই সঙ্গে আলো ও অন্ধকারের পূজারি। তবে বিশেষভাবে সূর্যের উপাসনা করা তাদের ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ বা রীতি। তাদের মধ্যে পশু কোরবানি ও খতনা করার প্রথাও প্রচলিত ইহুদি ও মুসলমানদের মতো। তবে শুধু জম্ম  সূত্রেই কেউ এই ধর্মের অনুসারী হতে পারে, ধর্মান্তরসূত্রে নয়।  যে কারণে ইয়াজিদি ধর্মমতের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে আছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই।

মুসলমানদের মতো ইয়াজিদি সম্প্রদায়ও হজ করে। ইরাকের উত্তর মসুলের লালিসে অবস্থিত মধ্যযুগের সুফি সাধক শেখ আদি ইবনে মুসাফিরের মাজারে সাত দিনের তীর্থ ভ্রমণকে ইয়াজিদিরা তাদের সম্প্রদায়ের হজ হিসেবে পালন করে। ইয়াজিদি ধর্মগুরুদের নির্দেশনা সম্ভব হলে প্রত্যেক ইয়াজিদিকে তাদের জীবদ্দশায় শেখ আদির মাজারে তীর্থ ভ্রমণ বা হজ পালনে যেতে হবে। এই তীর্থ ভ্রমণের সময় তারা লালিশের পবিত্র জলাধারে ডুব দিয়ে পবিত্র হয়। মালিক তাউসের (মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের দৃষ্টিতে যিনি শয়তান) মূর্তি ধৌত করে পবিত্রতা অর্জন করে।

ইরাকের একাংশে ইসলামী এস্টেট বা আইএস জঙ্গিদের আধিপত্য বিস্তারের পর নির্মম নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় ইয়াজিদিরা। ফরাসি বার্তা সংস্থার এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে জিনান নামের এক ইয়াজিদি কিশোরীর যৌন দাসত্বের কথা। ১৮ বছর বয়সী ওই ইয়াজিদি কিশোরী ২০১৪ সালে আইএস এর হাতে অপহৃত হন। পালিয়ে আসার আগে তিনি আইএস এর হাতে তিন মাস বন্দী ছিলেন। তার বন্দী জীবনের কাহিনী নিয়ে লিখিত একটি বই প্রকাশনা উপলক্ষে ফ্রান্সের প্যারিসে গিয়েছিলেন জিনান। আর সেখানেই ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদকের সঙ্গে তার বন্দী জীবনের কথা বলেন।

২০১৪ সালে ইয়াজিদিদের ওপর হামলার সময় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস জিনানকে ধরে নিয়ে যায়। অপহরণের পর তাকে বেশ কয়েকবার যৌনদাসী হিসেবে স্থানান্তর করা হয়। সবশেষে তাকে এক সাবেক পুলিশ সদস্য ও মসজিদের ইমামের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

জিনান তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে একবার তাকে ইরাকের মসুল শহরের একটি বিশাল হলরুমে জঙ্গিদের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তার সঙ্গে আরও প্রায় শখানেক নারী ছিল।

‘দায়েশ’স স্লেভ’ নামের বইয়ে জিনান লিখেছেন, ‘ওই বিশাল হলরুমে আমাদের ছেড়ে দেওয়ার পর আইএস জঙ্গিরা আমাদের ওপর এসে চড়াও হতে থাকে। এ সময় তারা কর্কশভাবে হাসছিল, আমাদের শরীরে অশ্ল­ীলভাবে চিমটি কাটছিল, খোঁচা মারছিল।’ উল্লে­খ্য, আইএস-এর আরবি উপনাম ‘দায়েশ’। আর এই আরবি নামটি জিনান তার বইটির শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক ফরাসি সাংবাদিকের সহায়তায় জিনানের বইটি লেখা হয়।

জিনানের বর্ণনায় উঠে আসে সে সময় কোনো একজন নারীর প্রতি ইঙ্গিত করে এক জঙ্গি অভিযোগ করছিল : ‘ওই নারীর বক্ষযুগল অনেক প্রশস্ত। আমি একটি সাদা চামড়ার ও নীল চোখওয়ালা ইয়াজিদি নারী চাই। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নারীরাই সর্বোৎকৃষ্ট। এ জন্য যত পয়সা লাগে খরচ করতেও রাজি আছি আমি।’

২০১৪ সালের আগস্টের এক দিনে আইএস-এর কালো পতাকা বহনকারী একটি গাড়ি নাদিয়ার গ্রামে প্রবেশ করে। এরপর আইএস জঙ্গিরা পুরুষদের হত্যা করে, শিশুদের জঙ্গি বানানোর উদ্দেশ্য বন্দী করে এবং নারীদের জোরপূর্বক যৌনদাসী হতে বাধ্য করে। বন্দী জীবনে। সিরীয়, ইরাকি, তিউনিসীয় ও ইউরোপীয় আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর লালসার শিকার হতে হয় তাকে। যন্ত্রণায় কেটেছে তার প্রতিটি মুহূর্ত। এর তিন মাস পর নভেম্বরে কৌশলে পালিয়ে আসেন নাদিয়া। পালিয়ে এসেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং যোগ দেন আইএসের হাতে বন্দী ইয়াজিদি নারীদের মুক্তির সংগ্রামে। রুখে দাঁড়ান নারী পাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পরিণত হন ইয়াজিদিদের মুক্তির প্রতীকে। যৌন নিপীড়িত-নির্যাতিত এই নাদিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের শরণার্থীদের আইনজীবী হিসেবে। মানবাধিকার আদায়ে অনন্য ভূমিকার জন্য তাকে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সম্মানজনক শাখারভ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০১৫ সালে তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তুলে ধরেছিলেন নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। আইএসের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় তাকে তাদের স্বঘোষিত খেলাফতের রাজধানী মসুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনটি মাস তিনি বারংবার গণধর্ষিত, নির্যাতিত এবং প্রহৃত হন। পরে ইয়াজিদিদের মিত্র একটি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি জার্মানিতে তার বোনের কাছে চলে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। তারপর থেকেই তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছেন, ইয়াজিদি জনগণের মুক্তির যুদ্ধে। এরপর থেকেই তিনি তার সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং অত্যাচারিত গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তার যুদ্ধ শুরু করেন। এখনো তিনি নিখোঁজ ও নির্যাতিত ইয়াজিদিদের জন্য তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এ লড়াই নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

পৃথিবীতে যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মমতের উদ্ভব ঘটেছে। সভ্যতার বিকাশে প্রতিটি ধর্মমত অসামান্য অবদান রেখেছে। প্রতিটি ধর্মমতের উদ্ভব ঘটেছে মানব কল্যাণের ব্রত নিয়ে। এক ধর্মের সঙ্গে আরেক ধর্মের বিশ্বাসে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও কোনো ধর্ম তার অনুসারীদের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণু হওয়ার নির্দেশ দেয়নি। তাত্ত্বিকভাবে দুনিয়ার সব ধর্মই মানব প্রেম ও সহিষ্ণুতার কথা প্রচার করেছে। কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যা অনুসারীদের বিবেকবোধকে বারবার জিম্মি করেছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর ওড়াও হওয়ার পেছনে ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বিকৃত মানসিকতা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ইরাকে ইয়াজিদি ধর্মাবলম্বীদের ওপর আইএস জঙ্গিদের গণহত্যা ও নৃশংস নির্যাতনের মধ্য দিয়েও সে সত্যটি স্পষ্ট হয়েছে।

ইরাক ও সিরিয়ায় ইয়াজিদি ধর্মাবলম্বী, খ্রিস্টান এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী মুসলমান নারীদের ওপর আইএস জঙ্গিরা যে যৌন নির্যাতন চালিয়েছে, তা মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। নির্মমতার দিক থেকে তা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর নারী নির্যাতনের সঙ্গে তুলনীয়। ধর্মের নামে এ পৈশাচিকতার আশ্রয় নেওয়া হলেও পৃথিবীর কোনো ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে নির্যাতন নিপীড়নের ন্যূনতম সম্পর্কও নেই।

 

 লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর