সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

চেচুয়া বিলের ‘অলৌকিকতা’ ইসলাম কী বলে

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

চেচুয়া বিলের ‘অলৌকিকতা’ ইসলাম কী বলে

মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন সে বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত থাকে। তখন তাদের মাঝে বাসা বাঁধে ভয়। আর এ ভয়কে পুঁজি করেই এক শ্রেণির লোক ব্যবসায় নেমে পড়ে। মানুষের মাঝে আতঙ্ক যত বাড়ানো যায়, তাদের মুনাফাও তত বেড়ে যায়। এ ব্যবসায় শিক্ষিত অশিক্ষিত দুই শ্রেণিরই কিছু অসাধু লোক জড়িত। কেউ বিভিন্ন রোগের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন টেস্ট, অহেতুক অপারেশন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। (তার একটি নমুনা দেখার জন্য ইউটিউবে যমুনা টিভির অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান, টিম থ্রি সিংটি ডিগ্রির রিংকিং দেখে নিতে পারেন) আবার কেউ অহেতুক গুজব ছড়িয়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রলোভন দিয়েও ব্যবসা করে।  (যেমন নিউজ২৪ এর হজবাবা দেখতে পারেন।) এরা আবার চিকিৎসাও করে (যেমন বিড়ি বাবা, তার বিড়ি খেলে নাকি সব রোগ দূর হয়ে যায়)। কেউ আবার মজা নেওয়ার জন্য হঠাৎ একটি গুজব ছড়িয়ে দেয়। অথচ হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি আল্ল­াহর রসুল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হবে।  (বোখারি : ৮৯৩)। অশিক্ষিত ও ভ- পীর ফকিরের দাবিদারদের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু একজন শিক্ষিত ডাক্তার এ দায় এড়াতে পারেন না। রোগীকে সঠিক চিকিৎসা ও দিকনির্দেশনা দেওয়া তাদের কর্তব্য। কিন্তু অল্পসংখ্যক বিপথগামী মানুষের কারণে হয়তো আজ সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের প্রতি অনাস্থা দেখা দিয়েছে। অথচ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য র‌্যাংকিং ২০১৮-এ চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮। এক নম্বরে রয়েছে ফ্রান্স। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত রয়েছে ১১২ নম্বরে।

(http://www.who.int/healthinfo/paper30.pdf)

ফলে অনেক ভালো মানের ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও কেউ চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। আবার যাদের সামর্থ্য নেই, তারা যাচ্ছেন বিভিন্ন পীর দাবিদার কিছু ভন্ডের মাজারে। কিংবা যেখানে কোনো আশার বাণী (গুজব) শুনছেন, সেখানেই ছুটছেন।

গত কয়েক বছর আগে ভোরবেলায় ফজর নামাজ আদায় করতে গিয়ে শুনেছিলাম, রাতভর অনেকেই বাঁশের পানি সংগ্রহ করেছেন। কারণ কোনো এক অজ্ঞাত বুজুর্গ নাকি বলেছেন যে, সে রাতে মহান আল্ল­াহর কুদরতে বাঁশ থেকে পানি বের হবে। যে তা পান করবে তার সব রোগ দূর হয়ে যাবে। মনোবাসনা পূর্ণ হবে ইত্যাদি। এমনকি আমাদের বাঁশ ঝাড়েও রাতের বেলায় নাকি বেশ ভিড় ছিল। কিন্তু সে পানি পান করে কারও কোনো উপকার হতে দেখিনি। মাঝে মাঝেই এরকম গুজব বিভিন্ন দিক থেকে বাতাসে উড়ে আসে। আবার হারিয়ে যায়। পবিত্র হাদিস শরিফে যে কোনো গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সব শোনা কথা (যাচাই-বাছাই করা ছাড়া) বলা কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯২)।

ইদানীং ময়মনসিংহের ত্রিশালেও নাকি একটি লিকুইড হসপিটাল চালু হয়েছে বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। যেখানকার পানি ও মাটিতে সর্ব রোগের চিকিৎসা রয়েছে বলে দাবি করছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হুজুগে মানুষগুলো সেখান থেকে পানি ও মাটি সংগ্রহ করছেন। কেউ আবার রোগীকে নিয়ে সেই পানিতে চুবোচ্ছেন। মাটি খাওয়াচ্ছেন। বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, এই কাদাযুক্ত পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে কয়েকশ নারী পুরুষ।

মহান আল্ল­াহতায়ালা তার বিভিন্ন সৃষ্টিতে মানুষের সুস্থতা অবশ্যই রেখেছেন। যা পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে ও রসুল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামের বিভিন্ন হাদিস দ্বারা স্পষ্ট। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, অতঃপর তুমি প্রত্যেক ফল থেকে আহার কর এবং তুমি তোমার রবের সহজ পথে চল।

তার পেট থেকে এমন পানীয় বের হয়, যার রং ভিন্ন ভিন্ন, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য রোগ নিরাময়। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। (সূরা নাহাল : ৬৯)। হজরত  ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হলো জমজমের পানি। তাতে রয়েছে তৃপ্তির খাদ্য এবং ব্যাধির আরোগ্য।’ (আল মুজামুল আউসাত, হাদিস : ৩৯১২)।

এমনিভাবে আজওয়া খেজুর, কালো জিরা, মধু ইত্যাদির ঔষধি গুণ নিয়েও রসুল (সা.) এর অনেক হাদিস রয়েছে। আমরা রোগ মুক্তির জন্য সুচিকিৎসার পাশাপাশি হাদিসে উল্লি­খিত বিভিন্ন জিনিসও গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু ইসলামের দোহাই দিয়ে কিংবা কোনো বুজুর্গের বরাত দিয়ে (অমুক বুজুর্গ স্বপ্নে দেখিয়েছেন) এ ধরনের অহেতুক কাজ করা, গুজব ছড়ানো ইসলাম সমর্থন করে না।

                লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।

সর্বশেষ খবর