মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ডিজিটাল নিরাপত্তা : সালিশের সান্ত্বনা নয়, আমরা আইন চাই

তুষার কণা খোন্দকার

ডিজিটাল নিরাপত্তা : সালিশের সান্ত্বনা নয়, আমরা আইন চাই

সমান মাপের দুটি সরলরেখার মধ্যে একটিকে বড় বানানোর দুটি উপায় আছে। দুটি রেখার মধ্যে একটি রেখাকে টেনে লম্বা করে দিলে পাশের রেখাটি তার তুলনায় ছোট হয়ে যাবে। স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ নিজে ভালো কাজ করে উদাহরণ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে নিজের সুনামের রেখা লম্বা করে। এতে মানুষ তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বাঁকা বুদ্ধির মানুষ কিন্তু সরল পথে নিজের রেখা বড় করার কাজ পছন্দ করে না। তারা নিজের রেখা বড় দেখানোর জন্য পাশের রেখার দৈর্ঘ্য ইরেজার দিয়ে মুছে ছোট করার কাজে আনন্দ পায়। আমাদের দেশের রাজনীতির আঙিনায় সুনাম-দুর্নামের রেখা বড়-ছোট করার খেলায় পেনসিলের ব্যবহার উঠে গেছে। এখন রাজনীতিবিদদের হাতে হাতে একটি করে ইরেজার। উনারা ইরেজার ব্যবহার করে ভিন্নমতের রাজনীতিক কিংবা অন্য যে কোনো পেশার মানুষের রেখা মুছে ছোট করার কাজে নেমে পড়েছেন। রাজনীতির আঙিনায় দুই গ্রুপের মানুষ। এক গ্রুপ সরকারি লোক। তারা সরকারে থেকে দেশ পরিচালনা করছে আর বলছে, মারহাবা! দেখ আমরা ভুলত্র“টির ঊর্ধ্বে উঠে কেমন সুন্দর দেশ চালাচ্ছি। কাজেই এটি অবধারিত সত্য, আমরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আরেক গ্রুপ সরকারের বাইরে বসে সরকারের সব কাজ মন্দ বলে একতরফা প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। কথাটা এভাবে বললাম কারণ সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো রাজনীতিকের কথার মধ্যে নিরপেক্ষ বিচার, সহনশীলতা কিংবা ন্যায়বোধের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা সরকারি দলের সমর্থক নয়, তারা যুক্তির কথা বললেও সরকার তাতে কান পাততে নারাজ। আবার যারা সরকারি বৃত্তের বাইরে আছে তারাও ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলার সততা হারিয়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক বক্তৃতা মানেই পরনিন্দার নোংরা প্রতিযোগিতা। রাজনীতির চর্চা মানে যদি হয় কোনো একটি পক্ষ নিয়ে অন্য পক্ষকে গালাগালি করা তাহলে রুচিশীল মানুষ সেই আঙিনায় পা রাখবে কী করে! সব ধর্মে বলে, পরনিন্দা মহাপাপ। গিবতকারী ভাইয়ের মাংস খায়। রাজনীতির আঙিনায় পরনিন্দার অবিরাম চর্চা শুনে মনে হয় উনারা জীবনেও এমন সুবচন শোনেননি।

আমরা ছোটকাল থেকে শুনলাম, নিজে ভালো হওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় আত্মসমালোচনা। যে ব্যক্তি নিজের কাজের ভালোমন্দ নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে জানে সে নিজের ভুল নিজে শুধরে নিতে পারে। যে মানুষ নিয়মিত আত্মসমালোচনা করে সে মানুষ নিজেকে শুদ্ধ করে গড়ে তোলে। আত্মসমালোচনায় পটু মানুষ ভুল কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটায় না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কায়কারবার দেখে মনে হচ্ছে রাজনীতির অভিধান থেকে আত্মসমালোচনার চিরায়ত ধারণা মুছে গেছে। রাজনৈতিক দলের ময়মুরব্বিরা তাদের কর্মীদের আত্মসমালোচনা করতে প্রকাশ্যে নিষেধ করছেন। পত্রিকায় পড়লাম, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের বলেছেন, যারা বিএনপি আমলের দুঃশাসনের সমালোচনা না করে নিজ দলের লোকজনের সমালোচনা করবে তারা আওয়ামী লীগের শত্র“। এ ধরনের আত্মসমালোচনাকারীরা আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন আশা করতে পারে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বিশ্বাস করেন না যে আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধির উপায়? আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ দলে আত্মসমালোচনার পথ বন্ধ করে কি আত্মশুদ্ধির পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছেন না? কোনো দলের কর্মীবাহিনী দলের নীতিনির্ধারণে অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ না পেলে তারা স্রেফ হাততালি বাহিনী হিসেবে কত দিন টিকে থাকবে?

সম্প্রতি পার্লামেন্টে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পাস হলো। দেশের সাংবাদিকসমাজসহ সচেতন মহল আইনটি পুনর্বিবেচনা করে কিছু ধারায় পরিবর্তন আনার জন্য সরকারকে বার বার অনুরোধ করে আসছে। সরকার কারও কথায় কান না দিয়ে আইনটি পার্লামেন্টে পাস করিয়ে ফেলল। পার্লামেন্টের ভিতরে সরকারের তল্পিবাহক বিরোধী দল যেটি আছে তারা তাদের তল্পি সামলাতে ব্যস্ত। সরকারের তল্পি টানা বিরোধী দল মানুষের কোনো কাজে লাগে না। সরকারের লেজ জাতীয় পার্টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নাজুক একটি আইন পাস করার প্রতিবাদ করার সাহস রাখতে পারে না। কাজেই এ আইন পাস করার যাবতীয় দায়দায়িত্ব একসময় আওয়ামী লীগের একার ঘাড়েই বর্তাবে। আওয়ামী লীগের লোকজন যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় জেলের ঘানি টানতে থাকবে তখন জনগণের সামনে এসে মুখ ফুটে বলতে পারবে না আইনটি কালো আইন। আপনারা ভোট দিয়ে আমাদের ক্ষমতায় বসান, আমরা এ কালো আইন বাতিল করে আপনাদের একটি সাদা আইন উপহার দেব। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক বাহিনীকে কান পড়া দিয়ে বলা হয়েছে, সরকার যা কিছু করবে তাতেই তারা মারহাবা মারহাবা বলে ধ্বনি দিতে থাকবে। তারা সরকারের কোনো কাজের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করতে পারবে না। এমন একটি সংবেদনশীল আইন পার্লামেন্টে উত্থাপিত হলে একজন এমপিও বললেন না এ আইনে ইতিবাচক পরিমার্জন-পরিবর্তন-পরিবর্ধনের প্রয়োজন আছে। উনারা সমবেত উল্লাসে হ্যাঁ, হ্যাঁ ধ্বনি তুলে ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত’ হয়েছে বলে ঘোষণা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করলেন। তবে কী সুখের আইন উনারা পাস করলেন তা এখন টের পেলেন না। নিজেরা জেলের আঁধারে বসে ডিজিটাল আইনের মর্মার্থ যখন বুঝবেন তখন হ্যাঁ কিংবা না বলার অধিকার উনাদের থাকবে না। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের কথা কি আওয়ামী লীগের লোকেরা ভুলে গেছে! ইতিহাসের উপহাস স্মরণ করে দেখুন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন আওয়ামী লীগের সৃষ্টি অথচ এ কালো আইনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দুই দশক ধরে সামরিক-বেসামরিক সরকারের হাতে বর্ণনাতীত নিবর্তনের শিকার হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল না। বিশেষ করে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার জন্য মুখিয়ে ছিল। সে সময় আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার জন্য ’৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রয়োগ হতো।

দেশের সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা পরিবর্তন করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। সরকারের মন্ত্রীরাও তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। সম্পাদকদের দাবি মন্ত্রীরা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিবেচনা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে মন্ত্রীদের ওয়াদা রক্ষার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মন্ত্রীরা সম্পাদকদের কথা দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাস্তবে কিছু করতে পারছেন না কারণ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? উনারা ভাবছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করতে গিয়ে যদি উনারা মন্ত্রিত্ব হারান তাহলে উনাদের উপায় হবে কী? জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য জনগণের কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি নেই সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না বলেই মন্ত্রীরা চুপ মেরে আছেন। আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা থাকলে সরকারি লোকজনের চিন্তাভাবনা জনমুখী হতে পারত। ২০১৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে মন্ত্রীরা জনমুখী হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছেন না।

দেশের সাংবাদিকসমাজ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারার বিরোধিতা করে সংশোধন দাবি করায় সরকারের আইটি বিশেষজ্ঞরা আইনজ্ঞের ভূমিকায় অভিনয় করতে শুরু করেছেন। সরকারি আইটি বিশেষজ্ঞরা হরেকরকম স্তোকবাক্য শুনিয়ে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। এসব তামাশা করার সময় উনারা ভুলে গেছেন, আইটি বিষয়ে উনারা বিশেষজ্ঞ হলেও আইন বিষয়ে উনারা বিশেষভাবে অজ্ঞ। আইনের অপব্যবহার রোধ করার উপায় হিসেবে উনারা বলছেন, যারা খারাপ কাজ করবে না তাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেখে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আইটি বিশেষজ্ঞদের কথা শুনে সুকুমার রায়ের শিশুতোষ ছড়া মনে পড়ছে। সুকুমার রায় লিখেছেন, ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না - তোমায় আমি মারব না’। আইটি বিশেষজ্ঞরা আমাদের যত অভয় বাণী শোনান না কেন আমাদের মনের ভয় কিছুতেই কাটছে না। কারণ সুকুমার রায় তার ছড়াতেই বলেছেন, ‘ঘরে আমার গিন্নি আছেন, আছে আমার নয় ছেলে’। আইন প্রয়োগ করার জন্য সরকারের যেসব সংস্থা আছে তারা সবাই সব সময় সাধুতার সঙ্গে আইনটি প্রয়োগ করতে থাকবে এটি সালিশের কথা। বাস্তবে আইনের সঠিক প্রয়োগের নিশ্চয়তা আইনের মধ্যেই থাকতে হয়। তা না হলে বার বার অপপ্রয়োগ হতে হতে আইনটি কালো আইন বলে চিহ্নিত হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বেশ বেশ বলে নাচ জুড়ে দেওয়ার জন্য সরকারি আইটি বিশেষজ্ঞদের আমি দোষ দিচ্ছি না কারণ তেনারা আইন এবং সালিশের ফারাক জানেন না। উনারা যে ভাষায় আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন সেটি সালিশের, আইনের নয়। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবী আইনমন্ত্রী যখন একইভাবে আমাদের সালিশের ভাষায় আইন বোঝাতে চান তখন শৈশবের পাঠ্যপুস্তকে পড়া ছোটগল্পের কথা মনে পড়ে। কোন ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে গল্পটি পড়েছি কিংবা সেই গল্পের লেখক কে ছিলেন সে কথা মনে নেই।

শুধু মনে আছে, একজন উকিল আদালতের এজলাসে দাঁড়িয়ে মান্যবর হাকিমকে বলছেন, ‘হুজুরের আইনজ্ঞান দেখি আমার স্ত্রীর চেয়েও কম।’ মাননীয় আইনমন্ত্রী কি সাদা আইন ও কালো আইনের সংজ্ঞা ভুলে গেছেন? তিনি কি জানেন না, আইনের ব্যত্যয় সালিশ দিয়ে সারা যায় না? আইন প্রণয়নের সময় আইনের ব্যত্যয় ঘটার পথ রুদ্ধ করতে না পারলে সে আইন একসময় ক্ষমতাসীনের হাতে মারণাস্ত্র হয়ে ওঠে। বিজ্ঞ আইনমন্ত্রী আইন প্রয়োগের বাস্তবতা ভালো করেই জানেন। আমি বিশ্বাস করি, আইনমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও সাহস থাকলে দেশে জনবান্ধব ডিজিটাল আইন প্রণয়ন কোনো কঠিন কাজ নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি কাজটি করলে আমরা বলব, তিনি তার কথা রেখেছেন।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর