বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অনাচে কানাচে মহিষাসুর; বধ করবেন কটা!

মনজুরুল আহসান বুলবুল

অনাচে কানাচে মহিষাসুর; বধ করবেন কটা!

প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় থাকে মজাদার আয়োজন। সম্ভবত গেল বছর ছিল আধুনিক দুর্গা মায়ের কলকাতা দর্শন। প্রতিদিন কলকাতা দেখার এই আয়োজন ছিল বড়ই মজাদার। এবারও আয়োজন ছিল অসুর বধ নিয়ে ভার্চুয়াল গেম। গেমের বর্ণনা থেকে অস্ত্র বেছে নিন, আর অসুর বধ করুন। কিন্তু খেলার শিরোনামটি খুবই মন কেড়েছে আমার : আনাচে কানাচে মহিষাসুর; আপনি কটা বধ করবেন? বিভিন্ন প্রাচীন হিন্দু কাহিনীতে মহিষাসুরকে অপদেবতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রম্ভ নামক অসুর মহাদেবকে তপস্যায় প্রীত করে তার নিকট ত্রিলোকবিজয়ী পুত্রবর প্রার্থনা করায় মহাদেব তাকে সেই বর প্রদান করেন। রম্ভ এই বর লাভ করে অসুররাজ্যে ফেরার পথেই মতিভ্রম হয় তার। শেষ পর্যন্ত মহিষরূপী অপ্সরার মহিষরূপী বাবা রম্ভকে বধ করেন। তার মৃত্যুর পর যক্ষরা তার মরদেহ চিতায় স্থাপন করে। তার স্ত্রী শোকাহত মহিষী সহমরণের উদ্দেশ্যে চিতায় আরোহণ করেন। চিতায় অগ্নিসংযোগ করলে চিৎকার করে ওঠে মহিষী অপ্সরা। তার গর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয় তার মহিষরূপ ও রম্ভের মিলনজাত সন্তান, অর্ধ মহিষ অর্ধ মানব মহিষাসুর। শিব বরপ্রভাবে গর্ভসঞ্চার হয়েছিল মহিষীর। পশুরূপের সঙ্গে মিলনের ফলে জ্বলন্ত চিতা থেকে জম্মাায় অর্ধ মহিষ অর্ধ মানবরূপী মহিষাসুর। কিছুকাল পরে জম্মাায় অন্য পুত্র রক্তবীজ। বরপ্রভাবে জম্ম  গ্রহণ করে মহিষাসুর অতীব দুর্দান্ত হয়ে ওঠে এবং দেবদের দূরীভূত করে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে। বিতাড়িত দেবেরা শম্ভু ও বিষ্ণুর কাছে তাদের দুঃখের কাহিনী নিবেদন করলে তাদের তেজ থেকে ভগবতী দুর্গার আবির্ভাব হয়। দেবী দুর্গা যুদ্ধ করে এই অসুরকে বধ করেন। অসুরের জম্ম  ও তার বধের কাহিনী এ রকমই। ফিবছর দুর্গতিনাশিনীর কাছ থেকে এভাবেই অসুর বধের চেতনায় উজ্জীবনী শক্তি ধারণের প্রার্থনা করা হয়। হিন্দু পুরাণের অসুরকে বধ করা গেলেও আমাদের চারপাশে নানা জাতের অসুরকে বধ করা যাচ্ছে না বলে দুর্গতিও নাশ করা যাচ্ছে না। বোধ করি সে কারণেই আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে : অনাচে কানাচে মহিষাসুর; আপনি কটা বধ করবেন!

এই অসুর আর তাকে বধ করতে একেকজনের লড়াই, সংগ্রাম এবং সাফল্য-ব্যর্থতা একেক রকম। নমস্য মনীষী অধ্যাপক আহমদ শরীফ বলছেন, ‘... ঢাকা শহরেই আমার নিন্দুক রয়েছে আমার দু’হাজার পরিচিতজনের জন্যে ১৯৫০ জন। এদের মধ্যে একহাজার জন আমাকে সহ্য করে, আমার সম্বন্ধে উদাসীন থাকে; আটশ’জন আমার নিন্দা করে আর দেড়শ’জন আমাকে সহ্যই করতে পারে না। পঞ্চাশজন আমার অনুরাগী...’ [ভাব-বুদ্বুদ, পৃষ্ঠা ২৩]। অধ্যাপক আহমদ শরীফকে গোটা জীবন চারপাশের এই অসুরদের মোকাবিলা করেই বেঁচে থাকতে হয়েছে। তবে তিনি সৌভাগ্যবান তিনি অন্তত তাঁর চারপাশের অসুরগুলোকে চিনে শ্রেণিবিন্যাস করতে পেরেছিলেন। এক সিনিয়র সাংবাদিক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন : আগের দিন মাথায় হাত দিয়ে যাকে কন্যারূপে বলে আশীর্বাদ করেছেন, পরদিনই সে অসুররূপিণী হয়ে চড়াও হয়েছে তাঁর প্রতি। নিজের অভিজ্ঞতাও কম নয়। পিতৃদেব বলে পদস্পর্শ করে পুত্রসম আশীর্বাদ নিয়ে হঠাৎ করে অসুররূপের যে মহিষ চরিত্রের প্রকাশ দেখেছি ও দেখছি তাতে এখন মাঠে সাধারণ মোষ দেখলেও ভয় পাই। তবে সবার ব্যক্তিজীবনেই এমন অসুরের খোঁজ মিলবে এবং এই অসুরদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করেই বেঁচে থাকার নামই বোধহয় জীবন। কিন্তু যে মহিষাসুর দেশ, জাতি ও সমাজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে তার সঙ্গে তো লড়াই করতে হয় যূথবদ্ধভাবে, কারণ এই মহিষাষুরকে বধ করা না যাক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে তো অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।

মাত্র কয়েকদিন আগে গ্রেনেড হামলা মামলায় কিছু অসুরের বিচার হলো, বধ হবে কবে কে জানে? এই অসুরদের চেহারাগুলো দেখুন! জাতির নিরাপত্তার জন্য গঠিত একটি সংস্থার দুই মহাপরিচালক, পুলিশের তিন প্রধান বা সেনাবাহিনীর কয়েক কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছিল র‌্যাংক, দেওয়া হয়েছিল ইউনিফরম। কিন্তু এই ইউনিফরম আর র‌্যাংকের আড়ালে যে এমন ভয়াবহ অসুর লুকিয়ে ছিল তাকে চিনতেই তো কেটে গেল ১৪ বছর! এদের তো দেওয়া হয়েছিল ইউনিফরম আর পদবি, কিন্তু এদের নেপথ্যের রাজনৈতিক অসুরদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল গোটা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব! কল্পনা করা যায়? রাষ্ট্র পরিচালনার পবিত্র দায়িত্ব পাওয়া এই অসুররা কী ভয়ানকভাবে হাজির হয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে? রাজনীতিতে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরাই যদি অসুররূপে আবির্ভূত হয় তাহলে সেই দেশে বা রাজনীতির কী অবস্থা হয় তা দেশবাসী সবাই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন।

১৯৭৫ সালে এই অসুরদের পূর্বসূরিরাই তো সপরিবারে হত্যা করেছিল এ দেশটির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষকে। সেই অসুরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে এমন অসুররক্ষীরা তো আমাদের রাজনীতিরই অংশ, এখনো।

পত্রিকায় হঠাৎ চোখ আটকে যাওয়া খবরে একটি ছোটখাটো অসুরের সন্ধান পাওয়া গেল। রাজনীতির সামান্য স্পর্শ পাওয়া এক তরুণ কীভাবে হঠাৎ অসুরে পরিণত হয় সে খবর ছেপেছে ঢাকার একটি দৈনিক। ২৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক ছেপেছে; এক বর্তমান ছাত্রনেতা পিটিয়েছেন নিজ দলেরই এক সাবেক নেতাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিফটে ওঠা নিয়ে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে ওই ছাত্র সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি পিটিয়েছেন ওই সংগঠনেরই বিশ্ববিদ্যলয় শাখার সাবেক সহসভাপতিকে। দলের আশীর্বাদ, সামান্য রাজনৈতিক ক্ষমতা একজনকে কীভাবে অসুরে পরিণত করে এটি হলো তার একটি প্রমাণ। এই খুদে অসুরটিকে কয়েকদিন আগে কেউ গোনাতেই ধরত না; কিন্তু একটা দলের জার্সি ও পদবি তাকে অসুরে পরিণত করেছে, যে অসুর অন্য মানুষ তো দূরে থাকুক, নিজের দলেরই সাবেক নেতাকে পাত্তা দেয় না, জখম করে। এই খুদে অসুরটিকে বধ করা তো দূরের কথা নিয়ন্ত্রণ করার কথাও এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। আর কত দুর্গতির কারণ হলে তাকে বধ করে দুর্গতি নাশ করা হবে?

শুধু রাজনৈতিক অসুর কেন, কি ব্যাংক, কি ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি পেশাজীবীদের মধ্যেও কি নানা সাইজের অসুরের দেখা মিলবে না? এরা গাছেরটাও খায়, নিচেরটাতেও পকেট ভারী করে; কিন্তু নানা কারণে দাপটশালী এই অসুররা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দাপটশালী আরেক ধরনের অসুরের খবর ছেপেছে দৈনিক ইত্তেফাক। ২৭ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘উপরে আপা নিচে আমি, মাঝে কেউ নেই’। ইত্তেফাক বলছে : ‘উপরে আপা নিচে আমি, মাঝে কেউ নেই’ এই মন্তব্য কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে কিংবা ইঙ্গিতে প্রায়ই এমন মন্তব্য করেন তারা। এমপি থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছেও তারা প্রমাণ করতে চান, কারও কাছে গিয়ে লাভ নেই, তার কাছে এলেই চলবে।

এই ‘উপরে আর নিচে, মাঝখানবিহীন’ অসুররা শুধু মন্ত্রণালয়ে আছেন এমন নয়, এদেরও দেখা মিলবে সর্বত্র। চাকরিজীবী, ব্যবসাজীবী, বুদ্ধিজীবী তো বটেই এবং অবসরজীবীদের অনেকেই এই উত্তাপের অসুর। অযোগ্য, অথর্ব এই অসুরদের নিজস্ব শক্তি নেই বলেই ‘আপা’র নামের ব্যবহার। আপার নাম ভাঙিয়েই এই অযোগ্য অথর্বদের দাপট চলে। কর্মজীবনে নিজে যোগ্যতায় কর্মে টিকে থাকাই মুশকিল ছিল কিন্তু অবসরে শুধু ‘আপা’র নাম ভাঙিয়েই চর্ব, চুষ্য লেহনের সব কাজটি সারছেন। আপা পর্যন্ত হয়তো তাদের দুর্বৃত্তপনার খবর পৌঁছেও না কিন্তু ‘আপা’র নাম ভাঙিয়ে এই অসুররা তাদের দাপট চালাতেই থাকে। দুর্নামটি হয় আপার। একটি কথা বুঝতেই হবে, অসুররা বেসামাল অসুর হয়ে ওঠে ক্ষমতার অক্সিজেন পেয়ে। তবে এই ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা নয়, রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরের অসুর লালনকারী অনেক শক্তিই সগৌরবে উপস্থিত। রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে অসুরদের বরং সহজেই চেনা যায় কিন্তু এই কাঠামোর বাইরে অসুর ও অসুর লালনকারীদের চেনা অনেক সময়ই মুশকিল হয়ে পড়ে।

আনন্দবাজার পত্রিকার গেমটিতে সব অসুর বধ করা যায় কিনা জানি না, কিন্তু বাস্তবে শিরোনামটিই সত্যি : অনাচে কানাচে মহিষাসুর; বধ করবেন কটা! সব অসুর হয়তো বধ করা যাবে না, সব দুর্গতিই হয়তো একবারে নাশ করা যাবে না কিন্তু লড়াইটি জারি রাখা জরুরি। অসুরদের সঙ্গে লড়াইটি কারও একার হতে পারে না, সমাজের সব শুভশক্তি একসঙ্গে হলেই অশুভ, অসুরদের দমিয়ে রাখা সম্ভব।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর