বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের পুজো

তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশের পুজো

বাংলাদেশ থেকে প্রায়ই খবর আসে, মন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে, হিন্দুদের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, দেশ ছাড়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বড় মন খারাপ হয়ে যায়। একাত্তরে যুদ্ধ করেছি দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর জন্য। বাঙালি মুসলমান অবাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বাস করতে চায়নি, চেয়েছে বাঙালির সঙ্গে বাস করতে, ধর্ম তাদের যা কিছুই হোক। বাংলাদেশ নামে একটি দেশের জম্ম  হওয়ার পর আমরা গান গেয়েছি ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’। এই দেশে চোখের সামনেই দেখছি ধীরে ধীরে পচন ধরছে। ধীরে ধীরে দেখছি একাত্তরের হায়েনাগুলো দখল করে নিয়েছে দেশ। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজ দেখছি ইসলামী মৌলবাদী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তাদের আদর্শেই চলছে দেশ। তারা ইসলামের আরো প্রসার চায়, প্রচার চায়, ইসলামী রাষ্ট্র চায়, ইসলামী আইন চায়। চায় না’র মধ্যে আছে... ইসলাম নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন করুক, যে প্রশ্নের উত্তর সহজ নয় অথবা অস্বস্তিকর, চায় না, অমুসলিমরা এ দেশে বাস করুক, ধর্মচর্চা করুক... চায় না। চাওয়া আর না-চাওয়া মেটাতে ওরা জোর জবরদস্তি, হুমকি ধামকি, এমনকী খুন খারাবি পর্যন্ত করে ফেলে। এই তো মুশকিল, চাওয়া, না-চাওয়া তো সবারই আছে। কিন্তু নিজের চাওয়া অন্যের চাওয়ার চেয়ে মূল্যবান, যে করেই হোক নিজের চাওয়াকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, এমন ভাবনা ভালো নয়। এটি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা  সব কিছুর বিরুদ্ধে যায়। এগুলোই যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি, তবে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না আমাদের।

বাংলাদেশ থেকে আসা শত দুঃখের খবরের মধ্যে একটি ভালো খবর শুনে মন খুব ভালো হয়ে গেল। শুনেছি বাংলাদেশে মোট ৩১,২৭২ দুর্গাপুজোর ম-প হয়েছে, ২৩৪টি হয়েছে ঢাকায়। যে ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া চলছে, দুদিন পর পরই বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, জমিজমা দখল করে নেওয়া হচ্ছে, ভয় দেখিয়ে গ্রাম থেকে শহর থেকে এমনকী দেশ থেকেও তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যদি শুনি তারা নিজের দেশে নিজের উৎসবটা নির্ভয়ে উদযাপন করতে পারছে, খুবই ভালো লাগে! পাকিস্তানে যখন খ্রিস্টানরা বা হিন্দুরা ধর্মীয় উৎসব করে, মন ভরে যায়। ভারতের মুসলমানদের, সংখ্যালঘু হলেও, যতটা শুনেছি, ধর্ম পালনে তাদের খুব একটা অসুবিধে হয় না। যদি অসুবিধে কিছু সৃষ্টি হয়ই, আশা করি ভবিষ্যতে সব অসুবিধে দূর হবে, মুসলমানেরা নিশ্চিন্তে নিরাপদে ধর্মের উৎসব করবে। অন্যের যেন সমস্যা না হয়, এমনভাবে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ যদি তাদের ধর্মীয় আনন্দ উৎসব করে, তাহলে করুক। সংখ্যালঘু পার্সিরা উৎসব করুক, বৌদ্ধরা করুক, বাহাইরা করুক, শিয়ারা করুক, আহমদিয়ারা করুক, ইহুদিরা করুক। এই উপমহাদেশ হয়ে উঠুক বিচিত্র সব বিশ্বাসীর নিরাপদ ভূমি। আর যারা আমার মতো ধর্মে নয়, যুক্তিতে বিশ্বাসী, তাদেরও যেন ঠাঁই হয় এই পুণ্যভূমিতে। তারাও যেন নিজের মত প্রকাশ করতে পারে কোনও রকম বাধা বিপত্তি ছাড়াই।

গত বছরের চেয়ে এ বছর বাংলাদেশে পুজোম-পের সংখ্যা ১১৯৫টি বেড়েছে। পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগই দেশভাগের সময় চলে গেছে, যারা যায়নি, গেছে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর। যারা পড়ে আছে দেশে, তারা হয় নি¤œবিত্ত, নয়তো উচ্চবিত্ত। এই উচ্চবিত্ত হিন্দুরা তাদের আত্মীয়স্বজনের অনেককে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে, ভারতে বাড়িঘরও কিনে রেখেছে। বাংলাদেশে বড় চাকরি বা বড় ব্যবসা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। বড় কোনও দাঙ্গা বাধলে জীবন বাঁচাতে যেন ভারতে চলে যেতে পারে। এদের এই নিরাপত্তাহীনতার কারণ নিশ্চয়ই আছে। হিন্দুর জায়গায় মুসলমান হলেও ঠিক একই কাজ করতো। নিম্ন বিত্তরা এপারেও অসহায়, ওপারেও অসহায়। ওরা তাই মাটি কামড়েই পড়ে আছে। দেশে পুজোম-প বাড়ছে, কারণ উচ্চবিত্ত হিন্দুরা বাড়াচ্ছে, সরকার নিরাপত্তার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে বলেই সম্ভবত। পুজোম-পের সংখ্যা বাড়ছে বলে সরকারও তার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ইমেজ তাদের দেখাতে পারছে যারা দেখতে চায়। পুজোম-পে এক চক্কর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন সৌদি আরবে। সৌদি আরবের সঙ্গে হৃদ্যতা থাকলে সুন্নি সালাফিগোষ্ঠী বড় প্রীত থাকে। সালাফি মতবাদীর সংখ্যা বাংলাদেশে অবিশ্বাস্যরকম বাড়ছে। এদের সংখ্যা যত বাড়বে, হিন্দুদের সংখ্যা তত কমবে এ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো সত্য। সৌদি আরবের সালাফিরা কোনও অমুসলিমকে নাগরিকত্ব তো দেয়ই না, অমুসলিমদের ধর্মচর্চা করারও অধিকার দেয় না। মন্দির, গির্জা, গুরদুয়ারা, সিনেগগ সৌদি আরবের মাটিতে এসব গড়া নিষিদ্ধ। সৌদি আরবে শুধু মসজিদ চলবে, আর কিছু নয়। বাংলাদেশের মুসলমানেরা যদি সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী হয়, তবে তো একদিন না একদিন তারা বাংলাদেশকেও সৌদি আরবের মতোই অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। আজ হিন্দুরা ধুমধাম করে পুজো করছে বটে দেশের মাটিতে, হয়তো ভবিষ্যতে এই পুজোটা শুধুই ইতিহাস হয়ে রইবে।

এবার সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, শারদীয় দুর্গাপূজায় সারা দেশের প্রতিটি ম-পে থাকবে কড়া নজরদারি। সারা দেশে পুলিশ আর র‌্যাবের পাশাপাশি এক লাখের ওপর স্বেচ্ছাসেবক নিরাপত্তা রক্ষী নিযুক্ত থাকবে। বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও ঢাকা মহানগর পুলিশের তরফে বিভিন্ন পূজা উদযাপন কমিটির সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পূজাকে কেন্দ্র করে কোনও ধরনের হুমকি না থাকলেও সতর্কতা চরমে। যে কোনও ধরনের নাশকতা ঠেকাতে সদা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে স্পেশাল পুলিশ র‌্যাব। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত সব ধরনের সহযোগিতা করেছে পুলিশ। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, সিসিটিভি, আর্চওয়ে, এসবি, পুলিশ ও র‌্যাবের ডগস্কোয়াড দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল সুইপিং করা ও বিসর্জনের দিন পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকছে।

চমৎকার আয়োজন। হিন্দুরা নিশ্চিন্তে নিজেদের পুজো করতে পারছে। এই নিশ্চিন্তির জন্য কিন্তু লক্ষাধিক নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু কেন এত নিরাপত্তা রক্ষীর দরকার হয়? মুসলমানের ধর্মীয় উৎসবের সময় তো এত নিরাপত্তা রক্ষীর দরকার হয় না! দরকার না হওয়ার কারণ, কেউ মুসলমানদের মারতে আসে না। হিন্দুদের মারতে আসে বলেই হিন্দুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দরকার হয়। বাংলাদেশে কোথাও কি হিন্দুদের জন্য পুলিশ বা নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া পুজো করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তবে এ নিশ্চিত যে, হিন্দুদের জন্য এই ভূমি নিরাপদ নয়। নিরাপত্তা রক্ষীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ম-প বানানো, পুজো করা একে আমি ধর্মীয় স্বাধীনতা বলি না। সংখ্যালঘুর ধর্ম পালনের জন্য পুলিশ বাহিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে, যে কেউ বুঝতে পারে যে, সংখ্যালঘুর অবস্থা শোচনীয়, তারা আজ আছে, কাল নেই।

একটা সমাজ ভালো কী মন্দ, তা বুঝতে হলে শুধু মেয়েদের অবস্থা দেখলেই চলে না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কেমন আছে, তাও দেখতে হয়। কোনও সভ্য জাতি তাদের সংখ্যালঘুর মানবাধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয় না। যারা কেড়ে নেয়, যারা নিজের বিশ্বাস, নিজের মত, নিজের ধর্ম, নিজের জাত-বর্ণকে সবার ওপরে রাখে, বাকিদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, তারা সভ্য হতে পারে না। বাংলাদেশ এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি, এখনও সময় আছে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান, সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মগ, মনিপুরী যারাই আছে সবাইকে বাঙালি মুসলমানের যে অধিকার, সেই অধিকার দেওয়ার। সবাইকে মানুষের সমান মর্যাদা দেওয়ার। এভাবেই সভ্য হয় দেশ আর দেশের মানুষ।

যে পাকিস্তানের জম্ম  দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হয়েছিল, সেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহও কিন্তু সভ্য হওয়ার জন্য দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাতিল করেছিলেন। তারপরও সেই পাকিস্তানকেও আমরা অস্বীকার করেছি, কারণ ইসলামী আদর্শে নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে পথ চলবো বলে উদ্বুদ্ধ হয়েছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাণে ধারণ করেছি, শোষণ উৎপীড়ন আর মানবো না বলে শপথ নিয়েছি। আমাদের সেই দৃঢ়তা এত অল্প সময়ে কী করে ভেঙে যায়! কিন্তু এতটা দূর এসেও কি আমরা হিন্দু আর মুসলমান দুই জাতি এই দ্বিজাতিতত্ত্বকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। তা না হলে কেন আজ হিন্দুরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়? সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে বাংলাদেশে উন্নয়ন এমনিই বেড়েছে যে, ভারতের চেয়েও কিছু কিছু স্তরে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নই কি উন্নয়ন? রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিক উন্নয়ন না হলে সত্যিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

যেদিন সংখ্যালঘুরা তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব করতে পারবে, কোনও রকম নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন হবে না, মানুষের গণতান্ত্রিক বোধই হবে তাদের নিরাপত্তা, সেদিনের সেই বাংলাদেশের অপেক্ষা করছি। সেই বাংলাদেশ নিয়ে শুধু আমি নই, গর্ব করবে গোটা পৃথিবী।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর