বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সুবিদ আলী : রাষ্ট্র কি তাঁর প্রতি সুবিচার করেছে?

মনোজ রায়

সুবিদ আলী : রাষ্ট্র কি তাঁর প্রতি সুবিচার করেছে?

১৯ অক্টোবর ২০১৮ বাঙালির এক গর্বের ধন, সফল শিল্পপতি, ব্যবসায়ী দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের এক নীরব পৃষ্ঠপোষক, মানবতার এক নিরলস সেবক আলহাজ জহুরুল ইসলামের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই জনপদে মরহুম জহুরুল ইসলামের নিঃশব্দ পদচারণা সৃষ্টি করেছে এক নতুন ইতিহাসের। কী সেই ইতিহাস! পাকিস্তানি জমানায় বাঙালির কোনো সন্তান শিল্প-বাণিজ্যে পশ্চিমাদের সঙ্গে পাল্ল­া দিয়ে সমান্তরাল পথে হাঁটবে এটা তো তখন শুধু অবিশ্বাস্যই ছিল না, অসম্ভব ও অকল্পনীয় ছিল বৈকি। সৎ সাহস, অধ্যবসায়, দৃঢ়চেতা, মেধা এবং নিখুঁত দেশপ্রেমের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সাধারণ বাঙালি পরিবারের এই সন্তান সাফল্যের শিখরে উঠেছেন। দেশে-বিদেশে বিশেষত আরব দুনিয়ায় তাঁর অসামান্য ব্যবসায়িক সাফল্য এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। দেশের অর্থনীতিতে এই মানুষটির ভূমিকা কেমন ছিল তা নিয়ে যেমন আলোচনা-সমালোচনার অবকাশ আছে, তেমনি তার অসামান্য সাফল্যের উৎস এবং কৌশল নিয়ে গবেষণা যেমন জরুরি তেমনি অত্যাবশ্যকও বটে। বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে কী করে তিনি সিন্ধু তৈরি করেছিলেন তা জানার বা জানানোর বিশেষ করে নতুন প্রজম্মে র কাছে তুলে ধরা বিবেচনা করি রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।

মরহুম জহুরুল ইসলাম সম্পর্কে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজ নিজ বিবেচনায় নানা মন্তব্য করেছেন। তিনি কি শুধু একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী ছিলেন? সমাজ পরিবর্তনে, মানুষকে আত্মনির্ভরশীল বা স্বাবলম্বী করতে কিংবা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে তার কি কোনো ভূমিকা ছিল এ প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক বটে।

প্রবীণ রাজনীতিক, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য জনাব তোফায়েল আহমেদ বছর তিন আগে জহুরুল ইসলামের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রবন্ধ লিখেছেন। মরহুম জহুরুল ইসলাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে তিনি লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে জহুরুল ইসলাম ছিলেন আমার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর স্নেহ-ভালোবাসায় আমার জীবন সিক্ত। জনাব জহুরুল ইসলামকে আমি ছাত্রজীবন থেকেই চিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জহুরুল ইসলামকে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, কারাগারে বন্দী, ফাঁসির মঞ্চে দন্ডায়মান সেই কঠিন দুঃসময়ের দিনগুলোতে জহুরুল ইসলাম আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঊনসত্তরের ২২ জানুয়ারি জাতির জনক মুক্তি লাভ করেছিলেন এবং ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আমরা জাতির জনককে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম। এত বৃহৎ ও মহৎ এক আন্দোলন যেখানে সমগ্র জাতি জেগে উঠেছিল সেই আন্দোলনে জহুরুল ইসলাম আমাদের পাশে থেকে অভয় দিয়ে ছায়া হয়ে থেকেছিলেন।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জহুরুল ইসলামের নিবিড় সম্পর্কের একজন প্রত্যক্ষদর্শী তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ’৬৯-এর গণআন্দোলনের পরে যখন বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতে শুরু করি তখন দেখতাম জহুরুল ইসলাম প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২ নম্বরে আসতেন। বঙ্গবন্ধু গভীর আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কথা বলতেন। আমার দেখা মতে, বঙ্গবন্ধুর যখন অর্থের প্রয়োজন হতো, জহুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে তা দিয়ে যেতেন এবং এ বিষয়টা আমি চিরদিন মনে রাখব’।

দেশের দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে মরহুম জহুরুল ইসলামের অবদানের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের বিভিন্ন পর্বে যেমন-৫২ এর ভাষা আন্দোলনে কারাগারে অন্তরীণ নেতা-কর্মীদের মামলার খরচ বহন, ৫২(ক) ধারায় কুখ্যাত এবডো আইনে আটক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ-পত্রাদির           উল্লে­খযোগ্য অংশ তিনি বহন করেছেন। এ ছাড়াও ‘শেখ মুজিব ও অন্য রাষ্ট্রদ্রোহীদের মামলায়’ তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আইনি লড়াইয়ের খরচ বহনে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে বৈশ্বিক ও নৈতিক সহায়তা প্রদান করেছেন। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে তার এসব সহায়তার কথা পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়েছিল বলেই মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ’৭১-এর ৩ এপ্রিল জহুরুল ইসলামকে পাকিস্তান আর্মি তার বাসভবন থেকে প্রথমে গ্রেফতার ও পরে নির্যাতন করে। তারই প্রতিষ্ঠানের একজন পশ্চিমা কর্মচারীর সহায়তায় পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন। এর পর জুনের ১০ তারিখ দেশত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে সুবিদ আলী ছদ্মনামে জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করেন।  বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি জহুরুল ইসলামের দায়িত্ববোধের একাধিক ঘটনা উল্লে­খ করে তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‘জহুরুল ইসলাম সাহেবের গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন জাতীয় সংসদে জহুরুল ইসলাম সাহেবের নাম উচ্চারণ করে কৃতজ্ঞতা সহকারে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠকন্যা শেখ রেহানার যখন বিয়ে হয়, তখন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভারতে। ফলে বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি যেতে পারেননি। কিন্তু জহুরুল ইসলাম সাহেব লন্ডনে অনুষ্ঠিত সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি তার ¯েœহ-ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন। সামগ্রিকভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি তার দরদ ছিল অপরিসীম।’

ব্যক্তিগত সম্পর্কের বর্ণনা দিতে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে, ’৭৮-এ আমি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তাকে সালাম দিতে গিয়েছিলাম, তখন আমাকে বুকে টেনে আদর করে আমার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন। আমাদের তখন শূন্য অবস্থা, ভয়ানক দুর্দশা। এমন দুর্দশাকর অবস্থায় দল পরিচালনার জন্য তিনি নিয়মিত আমাদের অর্থ সহায়তা করতেন। জহুরুল ইসলাম সাহেব খাঁটি বাঙালি ছিলেন। বাঙালি ব্যবসায়ী সমাজের তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।’

দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এমন আরেকটি নিবন্ধে মরহুম জহুরুল ইসলাম সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘তাঁর মতো মানুষ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় একজন দেখি না। তিনি শুধু বড় মাপের একজন বিজনেসম্যানই ছিলেন না, অনেক বড় মনের অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলেই তখন সবাই চলে যেতেন জহুরুল ইসলাম সাহেবের কাছে। তিনি কাউকে বিমুখ করেছেন তা শুনিনি। তিনি রাজনীতি করতেন না, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না, অথচ এ দেশের অনেক নামিদামি রাজনীতিবিদ তার কাছ থেকে নানাভাবে সহায়তা পেয়েছেন। শুনতে ভালো লাগে অনেক রাজনীতিবিদ এই সত্যটি গোপন না করে জনসমক্ষে বলে থাকেন। জহুরুল ইসলাম সাহেব যদিও তার দান-অনুদানের কথা সব সময় গোপন রেখেছেন।’

আক্ষেপ করে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক লিখেছেন, ‘আমার দুঃখ হয় এমন একজন মানুষ যিনি দেশের জন্য এত কাজ করেছেন, এত লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন অথচ বাংলাদেশের কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে তাঁর কাজের যেমন মূল্যায়ন করেনি, তেমনি তাঁকে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান যেমন একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক কোনো কিছুই প্রদান করেনি। তবে মানুষ হিসেবে চিরকাল তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তার মহত্ত্বের জন্যই।’ প্রবীণ কূটনীতিক বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জনাব মহিউদ্দিন আহমদ মরহুম জহুরুল ইসলামের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম : একজন সুবিদ আলীর কথা’ শিরোনামে দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিকে এক দীর্ঘ নিবন্ধে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কোনো একদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উত্তর লন্ডনের দি গ্রিন রোডের বাসায় তাকে এবং তাঁর অপর এক কূটনৈতিক সহকর্মী লুৎফুল মতিনকে ডেকে পাঠানো হয়। বিচারপতি চৌধুরী বাসায় পৌঁছে দেখেন উনাদেরই প্রায় সমবয়সী এক বন্ধু, ব্রিটেনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ডাক্তার জোয়ারদার বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছেন। ডাক্তার জোয়ারদার তখন লন্ডনের একটি হাসপাতালে কাজ করতেন। কয়েক মিনিট দেশের অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন এসব নিয়ে আলোচনার পর বিচারপতি চৌধুরী মহিউদ্দিন সাহেবকে বললেন, ‘ডাক্তার জোয়ারদার পাঁচ হাজার পাউন্ড ক্যাশ নিয়ে এসেছেন, এটি রাখুন এবং এই পাউন্ডগুলো প্রাপ্তির একটি রসিদ দেবেন। রসিদটি কার নামে ইস্যু করবেন জানতে চাইলে বিচারপতি চৌধুরী বললেন, জনাব সুবিদ আলীর নামে রসিদটি ইস্যু করবেন।’ মহিউদ্দিন আহমেদ সুবিদ আলীর পরিচয় সেদিন আবিষ্কার করতে পারেননি বটে, তবে কিছুদিন পরেই বিচারপতি চৌধুরী সুবিদ আলীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তার সঙ্গে। সেই সুবিদ আলীই হচ্ছেন জহুরুল ইসলাম। (এখানে উল্লে­খ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান হাই কোর্টের একজন বিচারপতি এবং একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে বছর ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাঙালিদের বৃহত্তর সমাবেশে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। এর অল্পদিন পরেই জনাব লুৎফুল মতিনও পাকিস্তান দূতাবাসের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের ডাইরেক্টরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন)।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৯০ সালে ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ নামে একটি পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করেন। এই   পুস্তকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। এই পুস্তকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে জহুরুল ইসলামের সম্পৃক্ততা ও ভূমিকার বর্ণনা দেন এইভাবে ‘জুলাই মাসের শেষের দিকে একজন বাঙালি যুবক আমাকে একা পেয়ে জহুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করেন। এই যুবকটি বাঙালি হলেও ইতিপূর্বে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। শেখ আবদুল মান্নান এবং আরও দু-একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীকে এ কথা বলায় তাঁরা এভাবে সাক্ষাতের ঘোরতর আপত্তি করেন। তখন আমি যুবকটিকে বললাম, ‘আজ খুবই ব্যস্ত, পরে দেখা যাবে। তিনি চলে গেলেন। কর্মব্যস্ততার মধ্যে কথাটা আমিও ভুলে গেলাম। এর পাঁচ-ছয় দিন পর মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার আমাকে এসে বললেন জহুরুল ইসলাম লুইসহ্যাম হাসপাতালে আছেন। তাঁর কোনো অসুখ নেই। তিনি অসুখের কথা বলে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে লন্ডনে এসেছেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন। আমি সে দিনই জোয়ারদারের গাড়িতে হাসপাতাল যাই। জহুরুল ইসলামের সঙ্গে সেটাই আমার প্রথম দেখা।

মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর আমরা এমনভাবে আলাপ-আলোচনা করলাম যেন আমরা অনেকদিন থেকেই পরস্পর পরিচিত। তিনি তাঁর দুর্দশার কথা বললেন। ঢাকার রমনা প্রেসিডেন্ট ভবনে (পরে গণভবন) তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। সেখানে তাঁকে দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করার ভয় দেখায়। এমন সময় তাঁর একজন পাঞ্জাবি বন্ধু খবর পেয়ে আসে এবং অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে সেদিনকার মতো মুক্ত করে আনেন। সেই বন্ধুরই সাহায্যে তিনি লন্ডনে চিকিৎসার অনুমতি পেয়েছেন। বুঝলাম তিনি শঙ্কিত এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ঢাকায় ফিরবেন না। তিনি বললেন, তিনি মুজিবনগর, বিশেষ করে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছ থেকে আমাদের অর্থ সাহায্য করার অনুরোধ পেয়েছেন। তিনি নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করতে চান। আমি তখন তাকে বলি, ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে আমরা একটি ফান্ড গঠন করেছি মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনে অস্ত্র কিনে প্রেরণ করতে ও স্টিয়ারিং কমিটির খরচ চালাতে। সেই ফান্ড থেকে অন্য কোনো খরচ করা বাঙালিদের বা আমার ব্যক্তিগত মত নয়। কিন্তু আমাদের দূতাবাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁকে আরও বলি, দেখা গেছে বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিমাসে দুই থেকে আড়াই হাজার পাউন্ডের মতো লাগবে। পরে আরও কূটনীতিবিদ যোগ দিলে বেশি লাগতে পারে। এই দূতাবাসের খরচ যদি তিনি চালিয়ে নেন তাহলে আমি নিশ্চিন্ত মনে কূটনৈতিক কাজ সুচারুরূপে করতে পারি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার এস্টিমেট অনুযায়ী তিনি যদি দু-তিন বছরের টাকা একসঙ্গে দিয়ে দেন তাতে আমি সন্তুষ্ট হব কিনা। আমি উত্তর দিলাম, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি যদি আমাদের দূতাবাসের মাসিক খরচ প্রতি মাসে দেন তাহলেই ভালো হয়। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে বললেন, প্রতি মাসে তিনি মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে তাঁর দেওয়া অর্থ পাঠিয়ে দেবেন। তবে সেটা অন্য কারও নামে জমা করে নিতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তানিরা কোনোভাবে এ খবর পেলে ঢাকায় অবস্থানরত তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তখনই আমরা তিনজন মিলে একটি নাম ঠিক করলাম। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার সুবিদ আলী নামে একজন রোগীর পক্ষ থেকে দূতাবাসের খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে আসবেন। যত দূর মনে পড়ে মাসিক আড়াই হাজার পাউন্ড দেওয়ার কথা ধার্য হয়। এর মাত্র কয়েকমাস পরেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারপর আর তাঁকে দিতে হয়নি। অথচ তিনি দু-তিন বছরের খরচ একসঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। একেই বলে ভাগ্য। দূতাবাসের ফিন্যান্স ডিরেক্টর লুৎফল মতিন এই পাউন্ড গ্রহণ করে সুবিদ আলীর নামে যথারীতি রসিদ দিতেন। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের নামে অন্য অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। দূতাবাসের খরচ এই অ্যাকাউন্ট থেকে চলত। এই অ্যাকাউন্টের সঙ্গে বাংলাদেশ ফান্ডের কোনো সম্বন্ধ ছিল না। দূতাবাস অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেছে।           তদানীন্তন ফিন্যান্স ডিরেক্টর লুৎফুল মতিন বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব।

জহুরুল ইসলাম সেদিন একপর্যায়ে নিজে থেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার আপনার খরচ চলে কী করে? আমি উত্তর দিলাম ন্যাশনাল ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যাংকে ১৯৪৬ সাল থেকে আমার অ্যাকাউন্ট আছে। এই পুরনো সমন্ধ এবং একজন বন্ধু গ্যারান্টার হওয়াতে ওভার ড্রাফটের ব্যবস্থা করেছি। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত খরচ খুবই কমিয়ে রেখেছি। তা ছাড়া আমার পরিবার আমার সঙ্গে জেনেভায় আসাতে স্টেট ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে কিছু অর্থ বেশি আনতে পেরেছিলাম। তিনি বললেন, আমি আপনার জন্য জোয়ারদারের মাধ্যমে এককালীন তিন হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দেব। আমি বললাম অশেষ ধন্যবাদ। আমি সেই অর্থ গ্রহণ করব এই শর্তে যে, দেশ স্বাধীন হলে সেই সময়কার বিনিময় হার অনুুসারে আমি এই টাকা পরিশোধ করব, আর আপনি গ্রহণ করবেন। আর যদি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বেঁচে না থাকি আপনি কোনো দাবি রাখবেন না। তবে যখনই সম্ভব হবে আমার পরিবার এটা শোধ করে দেবে। এই তিন হাজার পাউন্ড শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহুরুল ইসলামকে তখনকার বিনিময় হারে তিন হাজার পাউন্ডের সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা সোনালী ব্যাংকের মারফত আমার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দ্বারা পরিশোধ করেছি। এই ঋণ গ্রহণের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে জানিয়ে ছিলাম এবং তাঁর জ্ঞাতসারেই পরিশোধ করেছি।’

বিদগ্ধজনদের লেখা থেকে মুক্তি-সংগ্রামের নানা পর্যায়ে, মহান মুক্তিযুদ্ধে মরহুম জহুরুল ইসলামের সম্পৃক্ততা, ভূমিকা, দায়িত্ব ও দেশপ্রেমের একটি পরিচ্ছন্ন চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুর ২৩ বছর পরে তাই একটি জিজ্ঞাসা আমার হৃদয়-মনে আলোড়িত হচ্ছে : রাষ্ট্র কি তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে? তিনি কি রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিচার পেয়েছেন?

            লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর