বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

ফকির লালন শাহর বিশ্বাস, মানুষকে ভালোবাসলে স্রষ্টাকে ভালোবাসা হয়। তদ্রুপ মানুষকে ভজনা করলে স্রষ্টাকেই ভজনা করা হয়। যিনি পরমাত্মা তিনিই ঈশ্বর। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তিনি একজন। একজন মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন। মানুষ ভজলেই অটল রূপের মনের মানুষের সন্ধান মেলে। মানুষকে নিয়েই যত গান। সে কারণে তিনি সব ধরনের সাধনসিদ্ধির জন্য মানুষগুরুর প্রতি নিষ্ঠাবান হতে বলেছেন।

সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে

পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে॥

ভজ মানুষের চরণ দুটি

নিত্য বস্তু পাবি খাঁটি॥

ফকির  লালন সাঁই তার গানের আড়ালে যে সুচিন্তিত বক্তব্য এবং গূঢ়তাত্ত্বিক বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছেন আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লালন সাঁই তার দীর্ঘ ১১৬ বছরের জীবনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গান। তাঁর গানে আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদবিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা এবং সূক্ষ্ম অথচ তীর্যক উপমা উপস্থাপন করেছেন। ধর্ম কিংবা ঈশ্বর লালন বিশ্বাস করতেন এটি যেমন সত্য তেমনি সত্য তার মতে সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। যার কারণে চন্ডীদাসের অমর বাণীর (‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’) মতো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে তার গানে। তিনি কখনই জাতিত্বের সংকীর্ণতায় আবদ্ধ থাকতে চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন জাতির এবং জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে আলাদা এবং অকর্মণ্য এবং কূপম-ূক করে রাখে। তার গানে এসব প্রতিফলন স্পষ্ট এবং অসম্ভব তীব্রতর

জাত না গেলে পাইনে হরি

কিছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়াতাম আগুন দিয়ে।

জাতের বিপক্ষে এ রকম তীব্র বাণী লালন করেছিলেন গানের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ তাকে অসম্ভব যাতনা দিয়েছিল সেটি উক্ত অংশ প্রমাণ করে।

গানের পর্ব থেকেই লালন সমাজ সংস্করণের মহান দায়িত্ব গ্রহণ না করলেও চেতনা সংস্করণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অত্যন্ত গুরুবাদী লালন সাঁই আধ্যাত্মবাদিতা থেকে শুরু করে ভক্তিবাদ, হিন্দু-মুসলিম পুরাণ পর্যন্ত তুলে ধরেছেন তার গানে। স্বামী বিবেকানন্দের মতো লালন সাঁই সৃষ্টির সেবায় ঈশ্বর সেবা চেয়েছেন। আবার তিনি পুঁথিগত ঈশ্বর চাননি চেয়েছেন নিরাকার ঈশ্বর।

টলে জীব অটলে ঈশ্বর

তাতে কি হয় রসিক শিখর

লালন বলে রসে বিভোর

রস ভিয়ানে॥

দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বে এবং অবক্ষয়ে ক্ষয়িষ্ণু সমাজে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার অভাবই যে বড় সংকট, লালন সাঁইয়ের সংগীত সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’; যে বাণী এখনও প্রাসঙ্গিক।

‘এই মানুষ ছাড়া মন আমার

পড়বি রে তুই শূন্যকার।

লালন বলে মানুষ আকার

ভজলে তারে পাবি’-

ধর্মচেতনা মধ্যযুগীয় মরমি সাধকদের যেরূপ আশ্রয় দিয়েছিল লালন সাঁইও তাদের একজন। লালন ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। তার কণ্ঠে সুরারোপিত হয়ে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান। মানবধর্ম আর মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক কিংবা অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার অন্যতম সার্থক রূপকার লালন সাঁই কেবল মানবাত্মার মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করেননি তার সাধনার মূলমন্ত্র ‘আত্মং বিদ্ধিং’। যার অর্থ ‘নিজেকে চেন’। দেহের ভেতর আত্মার বসতি। সবাই টের পেলেও সে আত্মাকে কেউ স্পর্শ করেনি কিংবা মানবচক্ষে দেখতে পায়নি। লালন তার গানে এ ভাবধারাই প্রকাশ করলেন

বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা

এক পড়শি বসত করে

আমি একদিন না দেখিলাম তারে॥

আবার ধর্মান্ধদের পথ প্রদর্শনের বিষয়টিকে লালন তীব্রভাবেই কটাক্ষ করেছেন তার গানে। তার মতবাদ অনুযায়ী ‘দুই কানা’ বাস করে। পৃথিবীতে যারা নিজেরা কিছু না চিনলেও অপরকে ঠিকই নিজেদের দিকে টানাটানি করে। তাই তো লালন বলেন

এসব দেখি কানার হাটবাজার

বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানা আর এক কানা মন আমার

সত্যিই লালনকে সন্ধান করতে গেলে ফাঁপরে পড়তে হয়। কে এই লালন, কী তাঁর জাত পরিচয় অথবা কেমন তাঁর ধর্ম-জীবনপ্রণালি, প্রশ্ন জাগে। মানুষের মতামতের যেমন শেষ নেই, তেমনি গবেষকরাও তার সব বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। অথচ ১২৮ বছর আগের দেহত্যাগী লালনের একজোড়া গুরু-শিষ্যকে ধরে নেমে এলেই জীবিত বাউলের দেখা মেলে। যেহেতু বাউলবাদ গুরুবাদী, সেহেতু গুরু-শিষ্যের সরেজমিন কথোপকথন, জীবন, যৌনাচার সবকিছুর বিশ্লে­ষণ করলেই পাওয়া যাবে সম্যক লালন ও তার দর্শনকে। দেশময় ছড়িয়ে থাকলেও বাউলদের মন পড়ে থাকে লালনের বারামখানায়। নানা ছুঁতোয় তারা চলে আসেন মনতীর্থে। দোল কিংবা কার্তিক হলে তো কথাই নেই। ফকির লালন সমকালে যেমন শিষ্যদের নিয়ে ফাগুনের পূর্ণিমায় মচ্ছব করতেন, তেমন করে প্রতিবছর মচ্ছব বসে আখড়াবাড়িতে। ১৮৯০ সালের পয়লা কার্তিকে লালন গত হওয়ার পর থেকে দোলের সঙ্গে স্মরণোৎসবও যোগ হয় মচ্ছবানন্দে। পরম্পরায় বয়ে চলেছে এ ধারা। কার্তিক এলেই আউল-বাউল,  সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদনৃত্যে ভারি হয়ে ওঠে সাধুবাজার। গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের চোখে চোখ রেখে শুরু হয় ভাবের খেলা। ভাবজগতের মধ্যে বেজে ওঠে তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে। একতারা, দোতরা, ঢোলখোল, হারমোনি, বাঁশি, জোয়ারি, চাকতি, খমক হাতে একযোগে বাউলরা উড়াল তোলে। শোক বিয়োগের দিন হলেও ভক্তভারে ক্রমেই দৃশ্যগুলো তখন পাল্টে যেতে শুরু করে। খ- খ- মজমা থেকে তালের উম্মাাদনায় দমকে দমকে ভাসতে থাকে ভাববাদী ঢেউ। স্মরণোৎসব শোকাচ্ছন্ন থাকে না, উল্টো আনন্দময় মচ্ছবে পরিণত হয়। দুটো বড় আয়োজন বাদেও প্রায় প্রতিদিনই সাধু-গুরুদের বাজার বসে আখড়াবাড়িতে।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

mail:[email protected]

সর্বশেষ খবর