শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইতিহাসকে পাশ না কাটিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করুন

নূরে আলম সিদ্দিকী

ইতিহাসকে পাশ না কাটিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করুন

সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের প্রক্রিয়া থেকে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সরে দাঁড়িয়েছেন। রাজনৈতিক আঙ্গিকে এই বিভক্তিটা ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে কিনা, তা স্পষ্ট না হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা হলেও অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বেশিদিন একসঙ্গে ঐকমত্যে থাকতে পারেন না প্রান্তিক জনতার মানসিকতায় এ ধারণাকে বিষয়টি আরও বদ্ধমূল করেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহিষ্ণুতার অভাব, তারা একে অন্যকে বরদাশত করতে পারেন না, কারণ জাতীয় স্বার্থের চাইতে খন্ডিত দলীয় স্বার্থ, কখনো ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার প্রতি মোহ তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ বা একটি সফল আন্দোলন সৃষ্টির চাইতে বড় হয়ে দাঁড়ায়। আইয়ুব খানের আমলে একটি সফল আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে মরহুম নূরুল আমিনকে আহ্বায়ক করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি মোর্চা গড়ে ওঠে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন কারাগারে। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, যেটি শিক্ষা আন্দোলনের ছত্রছায়ায় মূলত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি আন্দোলনই ছিল। ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতার আশঙ্কায় এবং দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ মহলের পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ চাপে আইয়ুব খান সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেরিয়ে এলে ডাকসু, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি প্রতিনিধি দল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বিনম্রভাবে চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বলেন, আপনার অবর্তমানে এনডিএফের নেতা হয়েছিলেন নূরুল আমিন সাহেব। এখন আপনি বেরিয়ে এসেছেন। এনডিএফের কর্তৃত্ব এখন আপনাকে নিজ হাতে গ্রহণ করতে হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার স্বভাবসুলভভাবে মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আইয়ুব খান সাহেব আমাদের গোলাম বানিয়ে ফেলেছেন। গোলামের মধ্যে কে বড় গোলাম, সেটি এখন বিচার্য বিষয় নয়। বরং গোলামীর জিঞ্জির ভাঙার সঠিক ও সফল আন্দোলন করাই নৈতিক দায়িত্ব।

আজকের মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত এ অসহনীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বের সংঘাতে অথবা  নেতৃত্বের আভিজাত্যের কশাঘাতে সম্ভাব্য কোনো আন্দোলন বিঘ্নিত হলে তা গণমানুষের হৃদয়কে ভেঙে চৌচির করে দেয়। নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থার বক্ষ বিদীর্ণ করে দেয়। আজকে মৌলিক অধিকার ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যখন জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ব্যক্তিত্বের কলহে ঐক্য বিনষ্ট হলে রাজনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আজকে যারা আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেন, যাদের প্রতি জনগণের কিছুটা হলেও প্রত্যাশা ও আস্থা রয়েছে, তারা আত্মকলহে নিমজ্জিত হলে জাতির হতাশা বৃদ্ধি পায়। প্রত্যাশা ঘনঘোর অন্ধকার অমানিশায় নিপতিত হয়।

ড. কামাল ও ডা. বি চৌধুরীর এ ছাড়াছাড়ির বিক্ষিপ্ত বক্তব্য জাতি খোশমেজাজে নেয়নি। বরং মনে মনে অভিশম্পাত দিয়েছে। সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করার দায়ভার তাদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে। এক ডক্টরেট ও এক ডাক্তারের মধ্যে হারজিতের প্রশ্নটি এখানে মুখ্য নয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষায়, গোলামীর জিঞ্জির ভাঙা অথবা সত্যিকারের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সংকল্পের কথা উভয় নেতাই জাতিকে শুনিয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। বোধ করি সে কারণেই দুজনার কারোরই কোনো কৈফিয়ত জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের জনগণ নেতৃত্বের কাছ থেকে উদার চিত্তের মানসিকতা দেখতে চায়। ব্যক্তিত্ব ও দলের চাইতে জাতির স্বার্থে নিষ্কলুষ মানসিকতা ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের পথে এগিয়ে আসাই প্রধানত জাতির কাম্য।

শুধু ডক্টর ও ডাক্তারই নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনের ব্যক্তিদের মধ্যে এই মানসিকতা মরুভূমির নিষ্কলুষ সুর্যোদয়ের মতো বা উদ্গত উদ্ধত পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো যত অমলিনভাবে বিকশিত হবে, রাজনৈতিক অঙ্গন ততটাই পরিচ্ছন্ন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত হবে। রক্তের চড়া দামে কেনা এই স্বাধীনতার মূল্য দিতে হলে এ উপলব্ধিটা সব রাজনীতিকের জন্যই একটা নির্জলা শর্ত।

আমার জানামতে, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে একজন হাস্যরসিক ও প্রাণোচ্ছল মানুষ। তার বিনয়ী বিনম্র ও আন্তরিক ব্যবহার তার সংস্পর্শে আসা যে কোনো মানুষকেই বিমুগ্ধ করে। ডাক্তার হিসেবে তার আন্তরিকতা, যশ, বিনম্রতা ও সৌজন্যবোধ তাকে মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি এনে দেয়। বিটিভি যখন ডিআইটি থেকে সম্প্রচার শুরু করে, তখন থেকেই ‘আপনার ডাক্তার’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা পেশা ছাড়াও অসাধারণ কথক হিসেবে একটা ভিন্নমাত্রায় তার পরিচিতি ভাস্বর হয়ে ওঠে। ‘আপনার ডাক্তার’ অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা গগণচুম্বী ছিল বললেও ভুল হবে না। ওই অনুষ্ঠানটিতে তার বাচনভঙ্গির অপূর্ব শৈলীর কারণে তিনি সাধারণ জনগোষ্ঠী তো বটেই, জেনারেল জিয়াউর রহমানেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রবলভাবে। জিয়াউর রহমানই তাকে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করে দলের মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা, মন্ত্রী এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। অবশ্য তিনি রাজনৈতিক পরিবারেরই সন্তান। তার পিতা কফিলউদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার বদান্যতায় বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আবার তারই রোষানলে পড়ে অত্যন্ত অসহায়ের মতো রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে তার বিদায়ের পর্বটি ছিল অত্যন্ত করুণ, অনাকাক্সিক্ষত এবং হৃদয়বিদারক।

ডা. চৌধুরী কালের স্রোতধারায় বিকল্পধারা নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি করলেও প্রচ- প্রতাপে রাজনৈতিক মাঠ সরগরম করতে পারেননি। বিনম্র, ভদ্র ও জনপ্রিয় হলেই যে সুদৃঢ় চিত্তের সফল রাজনৈতিক সংগঠক হতে পারবেন, তার যে কোনো নিশ্চয়তা নেই, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর বাস্তব উদাহরণ। বিকল্পধারাকে সুদৃঢ়ভাবে সংগঠিত করতে তিনি একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে ১০০টি আসনে তিনি প্রার্থী দাঁড় করাতে পারবেন না বলেই মানুষের ধারণা। পারলেও তাদের কতজনের জামানত টিকবে, সেটিও একটি ভাবনার বিষয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো সাফল্য বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কৃতিত্ব বিকল্পধারার নেই। তার অনেক শুভাকাক্সক্ষীই মনে করেন, মৌসুমি রাজনীতি তার জন্য শোভা পায় না। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর পুরোপুরি চিকিৎসা পেশাতে আত্মনিয়োগ করাই তার পক্ষে সম্মানের হতো। কেননা, ‘আপনার ডাক্তার’ থেকে রাজনীতিতে এসে তার যে অর্জন তা আকাশছোঁয়া। পরবর্তীতে রাজনীতিতে অযথা তার বিচরণ বা অবস্থান খুবই বেমানান ও সম্মানহানিকর হয়েছে। বিগত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার ছেলে মাহী বি চৌধুরীর অংশগ্রহণ পরাজয় তো বটেই, বিকল্পধারা ও তার জনপ্রিয়তার অবস্থাটিই তুলে ধরেছে।  

ড. কামাল হোসেনের রাজনীতিতে আগমন ধূমকেতুর মতো। রাজনীতিতে কোনো আন্দোলনে সক্রিয় অংশীদারিত্ব তার ছিল না। শুধু যৌবনের উচ্ছলতার সঙ্গে তার আইন শিক্ষায় ডক্টরেট ডিগ্রি ও বংশমর্যাদা বঙ্গবন্ধুকে তার প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে এবং ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে ঢাকায় তার নিজের নির্বাচিত আসনটি ছেড়ে দিয়ে উপনির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে প্রার্থী করে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় নির্বাচিত করে আনেন। সত্যি বলতে কী, তখনকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই বিষয়টিকে প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি। তা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতেই হয়, নিজগুণে ছাত্রলীগের তদানীন্তন নেতৃত্বের সঙ্গে তিনি একটি সুখকর অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ব্যক্তিগত জীবনে ভদ্রলোক, অত্যন্ত সদালাপী, ভোজনরসিক, কৌতুকপ্রিয় এবং নিঃসন্দেহে অন্তরঙ্গ। তার সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক সফর আমি করেছি। এটি ছিল আনন্দদায়ক, সুখকর, উপভোগ্য এবং মনে রাখার মতো। সরাসরি ছাত্র রাজনীতি না করলেও ছাত্রলীগের সাবেক ও সত্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে তার গড়ে ওঠা হৃদ্যতা আওয়ামী লীগে শুধু মন্ত্রিত্ব লাভই নয়, তার জন্য সুদৃঢ় অবস্থানের একটা ভিত্তি স্থাপন করে। তাকে ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বোধহয় কেউই উড়ে এসে জুড়ে বসা বলে ভাবতেন না। 

ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। কিন্তু সারা দেশে এমনকি ঢাকাতে প্রতি পাড়া-মহল্ল­া তো দূরে থাক, সম্ভবত প্রতিটি থানায়ও তার সক্রিয় ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। এটা তার পদ-পদবি ও সম্মানের সঙ্গে নিতান্তই বেমানান। সরকার-বিরোধী একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যে অকুতোভয় মানসিকতা প্রয়োজন, তার চরিত্রে এর বড়ই অভাব। অন্যদিকে আইন পেশার জৌলুসে তিনি প্রায়ই দেশের বাইরে অবস্থান করেন। আমি আগেও বলেছি, সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কেউ টেলিফোনে একটু হুঁশিয়ারি দিলে তিনি সুদূর লন্ডন অথবা আমেরিকায় অবস্থান গ্রহণ করবেন। ১৫ আগস্টের পর কোনো নির্বাচনেই তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। অথচ তার দল গঠনের ঘোষণা দেওয়ার প্রাক্কালে কয়েকজন সংসদ সদস্য তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সংগঠনের প্রতি নিষ্ঠা ও যত্নের অভাব গণফোরামের সব সম্ভাবনাকেই প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলেছে।

৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পর আওয়ামী লীগ প্রজ্বলিত অগ্নিমশালের মতো জ্বলে ওঠে। এর আগে আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল নিভু নিভু প্রদীপের মতো। ৬ দফা প্রদান ও ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলনেই গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় আওয়ামী লীগকে ভিসুভিয়াসের মতো জাগিয়ে তোলে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ।

ডক্টর ও ডাক্তার সাহেবের ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা তাদের উভয়কেই একটি গ-ির মধ্যে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। কারণ এদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের সম্পৃক্ততা বা দুর্দমনীয় একাগ্রতা ছাড়া কখনোই কোনো আন্দোলন সফল হয়নি, আর ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। সবদিক বিবেচনা করে সরকার-বিরোধী জোট বা সংগঠনকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে আমি স্মরণ করাতে চাই, মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত সমাজ বা শাসনব্যবস্থা আজকে আপাতদৃষ্টিতে যতই নির্বিঘ্ন মনে হোক না কেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সভা ও মিছিল বিবর্জিত এই নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশটি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। তাই বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সরকারি দল বগল বাজালে তাদের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবুও কথা হলো, ইতিহাস যত নির্মমই হোক না কেন, সেই কালজয়ী প্রবাদটি আজ সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’। এর সঙ্গে সবিনয়ে সংযুক্ত করতে চাই, ইতিহাস হতে মুখ ফিরিয়ে না রেখে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। তাতেই দেশ ও জাতির কল্যাণ হবে এবং এটিই অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষা করবে।

আজকের আন্দোলনের বিষয়বস্তু নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি সর্বজননের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ দাবিটি সময়ের দাবি, এটি সন্দেহাতীতভাবে শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিতভাবে বলা যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা জনগণের নাড়ির স্পন্দন ও হৃদয়ের ভাষা অনুধাবন করেন, তারা এ ব্যাপারে দ্বিমত করবেন না, এটা নিশ্চিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম লগ্ন থেকেই পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক চক্র বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ অর্থনৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করে শুধু জনগণকে বিকলাঙ্গ করাই নয়, পূর্ব- পাকিস্তানকে শোষণের চারণক্ষেত্র বানানোর কুটিল প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ বিষয়টি অনুধাবন করে এবং অতি দূরদর্শিতার সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের কুটিল প্রক্রিয়াকে শক্তভাবে মোকাবিলা করার রাজনৈতিক ভিত মজবুত করতে থাকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে কুটিল প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস না করলেও খুবই কৌশলী, দূরদর্শী ও জনসম্পৃক্ত নেতা ছিলেন। মজার বিষয় হলো, তিনি বিষ দিয়ে বিষ কাটাতে জানতেন। আজকের প্রজম্মে র এটা জানা প্রয়োজন। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে তিনি যখন একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন তার প্রথম সংগঠনটির নামকরণ করা হয় জিন্নাহ মুসলিম লীগ। পরবর্তীকালে সেই সংগঠনটি আওয়ামী মুসলিম লীগে রূপান্তরিত হয়। মওলানা ভাসানী তখন সক্রিয় রাজনীতিবিদ কিন্তু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক রাজনীতি থেকে অবসর জীবনে চলে গিয়েছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রাক্কালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেরে বাংলার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রচ- দৃঢ়তার সঙ্গে অনুধাবন করে তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে শেরেবাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কৃষক প্রজা পার্টির অস্তিত্ব তত শক্তিশালী না হলেও ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের মুহূর্ত  থেকে জনপ্রিয়তায় ভাস্বর ছিলেন। কিংবদন্তি এই মহানায়কের নাম সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গ্রথিত ছিল নিবিড়ভাবে। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ঋণ শালিসি বোর্ডের প্রবর্তন, এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা জনগণকে উজ্জীবিত করার মহান প্রয়াসের কারণে ব্যক্তি থেকে তিনি এ দেশের রাজনীতিতে সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হন। এ বাস্তবতাটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জানতেন। তাই তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে ও মুসলিম লীগের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্ট গঠন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালে শেরেবাংলাকেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুখ্য নেতৃত্ব হিসেবে গণআন্দোলনের অগ্রভাবে দাঁড় করান। এটি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের উদারতা ও চিন্তাচেতনার দূরদর্শিতার পরিচয় তো বটেই, বরং রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে শুচিশুদ্ধ মানসিকতায় ধারণ করার দৃষ্টান্ত। যুক্তফ্রন্ট গঠনের সুদূরপ্রসারী চেতনা ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায়। দোর্দ- প্রতাপশালী মুসলিম লীগের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন তখনকার ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে পরাজিত হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে কুটিল ছিলেন না কিন্তু কুশলী ছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে শেরেবাংলার অবস্থান তার অবস্থানকে ম্রিয়মাণ, এমনকি নিষ্প্রভ করে দিতে পারে, এমন চিন্তাকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাত্তাই দেননি। এসব দৃষ্টান্ত আজকের নেতৃত্বের দৃষ্টিকে উম্মোাচিত করুক এটাই সবার কাম্য।

আগামী জাতীয় নির্বাচন অতি সন্নিকটে। সব দলের অংশগ্রহণে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে হয় না। আর নির্বাচন না হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তীব্র হয়ে ওঠে। এটা সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব যত আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করবেন, ততই জাতির জন্য মঙ্গল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা পার পেয়ে গিয়েছিলেন। এবার সেই একই ভাবনায় নিমজ্জিত থাকলে হয়তো জাতিকে মহাসংকটের দিকেই ঠেলে দেওয়া হবে, যে সংকট মোকাবিলার ক্ষমতা শেখ হাসিনারও নেই।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর