রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

লন্ডন ও নিউইয়র্কের যত কথা-

নঈম নিজাম

লন্ডন ও নিউইয়র্কের যত কথা-

বিবিসি থেকে ফোন করলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। বললেন, আপনি কোথায়? আমি বললাম, অক্সফোর্ড স্ট্রিট আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে নামলাম মাত্র। অনেক দিন এ এলাকায় হাঁটাহাঁটি করি না। মোয়াজ্জেম হাসলেন। বললেন, আপনার একটি সাক্ষাৎকার নেব বিবিসির জন্য। আমাদের অফিস থেকে আপনি মাত্র পাঁচ মিনিট দূরত্বে। চলে আসুন। বললাম, সাক্ষাৎকার কী নিয়ে নেবেন? মোয়াজ্জেম বললেন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ব্রিটেন যাত্রা। অন্যকিছু নয়। প্রিন্ট মিডিয়ার এক কঠিন সময় চলছে। ব্রিটেনের বাংলা মিডিয়াগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আপনাদের সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলব। হাঁটা দূরত্বে বিবিসি অফিস। নিচে নেমে এলেন মোয়াজ্জেম। ভিতরে প্রবেশের জন্য ছবি তুলে আইডি কার্ড হলো। আমাদের নিয়ে গেলেন বাংলা বিভাগে। আমার সঙ্গে রয়েছেন লন্ডনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্য কর্মরত আফজাল হোসেন ও কুমিল্ল­া আওয়ামী লীগের এক নেতা আবুল কালাম আজাদ। তার সঙ্গে দেখা বিমানবন্দরে। বললেন, লন্ডন ব্যক্তিগত সফরে রয়েছেন। আমার সঙ্গে ঘুরতে ও আমাদের অনুষ্ঠানে থাকার আমন্ত্রণ জানাই তাকে। দেখা হলো বাংলা বিভাগের প্রধান সাব্বির মোস্তফা ও পুরাতন বন্ধু মাসুদ হাসান খানের সঙ্গে। হালকা আড্ডা হলো অল্প সময়ের জন্য। এর মাঝে মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে স্টুডিওতে প্রবেশ করি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ব্রিটেন যাত্রা নিয়ে আমরা কথা শুরু করি। বিশ্ব মিডিয়ার চ্যালেঞ্জের মুহূর্তে বাংলাদেশের একটি প্রিন্ট মিডিয়া কেন লন্ডনে? আমি বললাম, বাংলাদেশ প্রতিদিন বাংলাদেশের গণমানুষের একটি দৈনিক। এই দৈনিকটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। বাংলাদেশে আমাদের প্রচারসংখ্যা এখন প্রায় ছয় লাখ। অনেক দিন থেকে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কাগজ প্রকাশ শুরু করেছি। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার একটা আনন্দ থাকে। আর চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের সাফল্য মানুষকে অন্যরকমভাবে আলোড়িত করে। এই মুহূর্তে বাংলা মিডিয়ার নতুন মাত্রার ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক বাংলাদেশ প্রতিদিন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশনা শুরু গত মার্চে। আলোর ধারা নিয়েই এগিয়ে চলছে আগামীর পথ। এবার লন্ডন থেকে সপ্তাহে একদিন প্রকাশ। শুধু ব্রিটেন নয়, এই কাগজটি যাবে ইতালির রোম, প্যারিস ও স্পেনের একাধিক শহরে। চেষ্টা করব পরিসর ইউরোপে আরও বাড়াতে। শুরু করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা চাই প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজম্মে র কাছে বাংলাদেশের কৃষ্টি         সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা জানাতে। বিবিসির সাক্ষাৎকার শেষ করে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি, কেনাকাটা। তারপর ফিরে এলাম হোটেলে। রাতে আড্ডা ছিল বাংলাদেশ প্রতিদিনের লন্ডন অফিসে। ঢাকা থেকে লন্ডনের পথে রওনা হয়েছিলাম ৩ অক্টোবর। পৌঁছলামও একই দিন ওখানকার সময় বিকালে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউরোপ যাত্রা অনুষ্ঠান ৫ অক্টোবর। আগেই গুগলে দেখে গিয়েছিলাম লন্ডনে শীত শুরু হয়েছে। তবে মিষ্টিশীত। এমন চমৎকার আবহাওয়া সব সময় পাওয়া যায় না। বিমানবন্দর থেকে সোজা পূর্ব লন্ডনের কাছে স্ট্রাটফোর্ড পার হয়ে আমাদের হোটেল হলিডে ইনে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ব্রিকলেনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের নতুন অফিস দেখতে গেলাম। সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনের দায়িত্বে নিয়োজিত আ ফ ম মাসুম ও আফজাল হোসেন। ওদের নিয়েই এক মাস আগে পত্রিকাটি বের করার সব প্রক্রিয়া শেষ করে এসেছিলাম। এবার চূড়ান্ত কাজ পত্রিকার প্রকাশনা। ব্রিটেনের সঙ্গে আমার আসা যাওয়ার সম্পর্কটা অনেক বছরের। এই শহরে রয়েছে অনেক স্মৃতি। যখনই আসতাম যেতাম বাংলা পত্রিকা অফিসগুলোতে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। এর মাঝে কথা হয় হাইকমিশনে কর্মরত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনের সঙ্গে। চমৎকার মানুষ। তার বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। সময়ের অভাবে যেতে পারিনি। আমি তাকে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাই। আমিন সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। ব্যক্তিগত জীবনে আমিন আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক শামীমের ছোট ভাই। একজন দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। সন্ধ্যায় ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা জনমত অফিসে বসে স্থির হয় পরের দিন আবার দেখা হবে। প্রস্তাবটা সৈয়দ নাহাস পাশা ভাই দিয়েছিলেন। মাসুম দায়িত্ব নিল আমাদের ঘনিষ্ঠ সবাইকে আমন্ত্রণের। ৪ অক্টোবর রাতে ব্রিকলেনে বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে আমরা সবাই বসলাম। একই পেশার প্রিয় মানুষগুলো যেখানে থাকুন না কেন মনের একটা মিল থেকে যায়। নজরুল ইসলাম বাসন, শামসুল আলম লিটন, সৈয়দ আনাস পাশাসহ অনেকের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা। ব্রিটেনের বাংলা মিডিয়াকে তারা সবাই জাগিয়ে রেখেছেন। এই মিডিয়ার জন্য দীর্ঘদিন থেকে নবাব ভাইদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। উদারতা নিয়েই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সবাই স্বাগত জানালেন। আমি আপ্ল­ুত। কৃতজ্ঞতা জানালাম সবার প্রতি। এই আড্ডায় আমরা সবাই দুজন মানুষকে স্মরণ করলাম। একজন আমিনুল হক বাদশা আরেকজন মিয়া আখতার হোসেন সানু। সানুবিহীন লন্ডন আমার কাছে এখনো অফুরন্ত শূন্যতা। যা হয়তো এই জীবনে আর কাটবে না। প্রিয় মানুষরা চলে যাওয়ার বোঝা অনেক কষ্টের। অনেক বেদনার। মানুষগুলো চলে যাওয়ার পর বোঝা যায় তাদের আমরা কতটা পছন্দ করতাম। এই যুগে সর্বজনীন মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এখন সবখানে কৃত্রিমতা। হৃদয় নিয়ে ভাবনার সময় কারও নেই।

৫ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউরোপ যাত্রার অনুষ্ঠান। হলজুড়ে লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির সবাই ছিলেন দলমত নির্বিশেষে। ঢাকা থেকে অতিথি হিসেবে যোগ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বসুন্ধরা গ্র“পের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। দুজনই বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ী। এর মাঝে বসুন্ধরা গ্র“পের চেয়ারম্যান সম্পর্কে আমরা বলি, তিনি ছাই ধরলে সোনা হয়ে ওঠে। স্বপ্ন সবাই দেখেন। বাস্তবায়ন করতে সবাই পারেন না। আহমেদ আকবর সোবহান স্বপ্ন দেখেন ও বাস্তবায়ন করেন। এই কারণে তৈরি করেছেন বাংলাদেশে বিশাল ব্যবসার সাম্রাজ্য। অন্যদিকে লোটাস কামাল ভাই একজন চমৎকার মানুষ। মন্ত্রী হিসেবে পুরোপুরি সফল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে নিয়ে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে কাজ করে চলছেন। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের গল্প বিদেশে জানাতেই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে লোটাস কামাল ও বসুন্ধরা চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান তাদের বক্তৃতায় তুলে ধরেন বাংলাদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা। ছিলেন বাংলা মিডিয়ার সব সম্পাদক ও টিভি মালিকরা। সবচেয়ে বেশি আপ্ল­ুত হয়েছি প্রিয় মানুষ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর উপস্থিতিতে। আগের দিন ফোনে কথা হয়। বললাম, আপনি আসবেন তো? তিনি বললেন, অবশ্যই তোমাদের শুভ কামনা জানাতে আসব। তিনি এলেন। পুরো অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছিলেন। রাতের ডিনারও শেষ করলেন আমাদের সঙ্গে। তারপর বাড়ি গেলেন। হুইল চেয়ার ছাড়া গাফ্ফার ভাই এখন চলতে পারেন না। কিন্তু প্রিয়জনদের জন্য তার ভালোবাসার শেষ নেই। গাফ্ফার ভাইকে আমরা আমাদের পরিবারের সদস্য মনে করি। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে আজীবন সম্মাননা দিয়েছিলাম। টাওয়ার হ্যামলেটের নির্বাহী মেয়র জন বিগস আমার সঙ্গে কথা বললেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন নিয়ে। তাকে জানালাম, আমরা বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক ও লন্ডনে একসঙ্গে পত্রিকা প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে আরও পরিকল্পনা আছে অন্যদেশ নিয়ে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বললেন, প্রিন্ট মিডিয়ার এই কঠিন চ্যালেঞ্জের যুগে বিশাল যাত্রাপথে আমার অভিনন্দন। ধন্যবাদ জানালাম জনকে। ছিলেন ডেপুটি হাইকমিশনার জুলকার নাইন। এ ছাড়াও বাংলা মিডিয়ার বন্ধুদের সরব উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামাল, বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান, মেয়র ছাড়াও বক্তব্য রেখে আমাদের উৎসাহিত করলেন ঐতিহ্যবাহী জনমত পত্রিকার সম্পাদক নবাবউদ্দিন, চ্যানেল এস ও সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ উস সামাদ জেপি, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা, সাপ্তাহিক পত্রিকার চিফ এডিটর মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ, সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক ফরিদ আহমেদ রেজা, দীর্ঘদিনের বন্ধু আয় অন টেলিভিশনের পরিচালক এনাম আলী এমবিই, সত্যবাণী অনলাইন সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইছির মাহমুদ, চ্যানেল আই ইউরোপ পরিচালক রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েব, ইকরা বাংলা টেলিভিশনের জি এম হাসান হাফিজুর রহমান, টিভি ওয়ানের জিএম গোলাম রসুল, নজরুল ইসলাম বাসনসহ বাংলা মিডিয়ার নবীন-প্রবীণ সাংবাদিকরা অনুষ্ঠান শেষেও অনেকে দীর্ঘ সময় আড্ডা দিয়ে যান।

লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার বন্ধুদের প্রেস ক্লাব একটি। তারা একটি ভবন কেনার চেষ্টা করছেন। চমৎকার। এখানকার সাংবাদিকরা নিউইয়র্কের মতো বিভক্ত নন। এই ঐক্য ভালো লেগেছে। মত ও পথের ভিন্নতা থাকতে পারে। পেশার স্বার্থে সবার মাঝে ন্যূনতম সৌহার্দপূর্ণ একটি সম্পর্ক দরকার। ব্রিটিনের সাংবাদিক বন্ধুদের মাঝে এই আন্তরিকতাটুকু খুঁজে পেয়েছি। নাগরিক জীবনে আমরা ভুলে গেছি অতীতকে। একটা সময় গ্রামে একজনের বিপদে দশজন ছুটে আসত। শহরেও তাই ছিল। এখন বাঙালির সেই সংস্কৃতি আর নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবধান বাড়ছে। ধর্মের বিরোধ গড়াচ্ছে দলীয় রাজনীতির ঝামেলায়। রাজনীতি ও ধর্ম কেড়ে নিচ্ছে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্কের বন্ধনগুলো। আবেগ অনুভূতিগুলোতে আঘাত হানছে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর অতি আধুনিকতা ও অতি দলবাজির রোগ। নব্য রাজনৈতিক সমাজের একদল মানুষ নিজেকে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় মনে করছেন। কারও কারও অতিদলবাজি, তেলবাজি দেখে মনের ভিতরের কষ্টগুলো আরও পাথরচাপা পড়ে যায়। আহারে সুসময়ের পাখিরা হৃদয় খুঁড়ে দেখারও সময় পাবে না খারাপ কোনো সময় এলে। তোমাদের মতো চেহারাগুলো বহু বছর থেকে আমার দেখা আছে। দুনিয়াতে ক্ষমতা নিয়ে অহংকারের কিছু নেই। মনের জানালায় নানারকম উঁকিঝুঁকিতে সিদ্ধান্ত নিলাম নিউইয়র্ক যাব অনুষ্ঠান শেষ করে। লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের আকাশপথের দূরত্ব মাত্র ৭ ঘণ্টা। ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় পৌঁছলাম নিউইয়র্ক। অফিসের কিছু কাজ ছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন নিউইয়র্ক থেকেও প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে সন্তানদের সঙ্গ পাওয়ার একটা সুযোগ হলো স্বল্প সময়ের জন্য। ঢাকায় ফেরার টিকিট নিলাম ৯ অক্টোবর। আকাশের ঠিকানায় বেশি সময় কাটবে। নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ। এখনো শীত শুরু হয়নি। তবে মাঝে মাঝে পশ্চিমা আবহাওয়ার রূপ বদল হয়ে ওঠে। এই কারণে শীতের কাপড় সঙ্গে রাখতে হয়। কথায় আছে পশ্চিমা থ্রি ডাব্লিউর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এই তিন             ডাব্লি­উ হচ্ছে, ওম্যান, ওয়ার্ক অ্যান্ড ওয়েদার। আজব সব             বিশ্লেষণ। কাজ বা নারীর মতি গতি জানি না। তবে আবহাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই তা আমি টের পেয়েছি ইউরোপ আমেরিকা গত ৩০ বছরের ঘোরাঘুরিতে।

নিউইয়র্কে ৭ অক্টোবর যোগ দিলাম হুমায়ূন মেলায়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, পুরবী বসু, মেহের আফরোজ শাওন, আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনিসহ অনেকের সঙ্গে দেখা। এই মেলার আয়োজক ছিলেন আলমগীর আলম। নিউইয়র্কের একজন ভালো আয়োজক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন মেলার মিডিয়া পার্টনার। আলম জানালেন, আগামীতে আরও বড় পরিসরে হুমায়ূন মেলা করার চিন্তা করছেন। আমেরিকায় বাংলাদেশকে নতুনভাবে দেখলে ভালো লাগে। হাঁটাচলার সময় বাংলায় সাইনবোর্ড দেখলে মনটা ভরে যায়। বাংলাদেশিরা আসলে অনেক দূর এগিয়ে চলছে। এই মেলাতে যোগ দিয়ে ২০০৪ সালের একটি স্মৃতি হঠাৎ মনে পড়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বাংলা টিভি চ্যানেল হিসেবে এটিএন বাংলার আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম। নিউইয়র্কের আমাজুরা হলে এটিএন বাংলা আমেরিকা যাত্রার অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। মঞ্চে দুই মার্কিন কংগ্রেসম্যান ছাড়াও ছিলেন এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট প্রয়াত ড. হান্নান ফিরোজ, ফাতিনাজ ফিরোজ, মোহসীন মাসুম, পনির ভূইয়া, ফখরুল ইসলামসহ অনেকে। মাহফুজ ভাই, হান্নান ভাই সুইচ টিপে এটিএন বাংলার উদ্বোধন করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো হল করতালিতে মুখরিত হয়। আবেগ আপ্ল­ুত অনেকের চোখে ছিল পানি। এখন বাংলাদেশের সব টিভি চ্যানেল আমেরিকায় দেখা যায়। রয়েছে স্থানীয়ও দুটি। এ ছাড়া অনেকগুলো বাংলা পত্রিকা প্রকাশ হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে পাঠকরা এর মাঝে গ্রহণ করে নিয়েছে। বাংলা ও বাংলাদেশ নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়াতে। হুমায়ূন মেলায় বসে সেইসব কথা ভাবছিলাম। দিনব্যাপী বইমেলা শেষে রাতে ছিল এস আই টুটুল ও শাওনের গান। তাদের দরাজ গলা দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। সবগুলো গানই ছিল হুমায়ুনকে ঘিরে। শরৎচন্দ্রের পর মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠকদের নতুন মাত্রা দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। আমরা নিহার রঞ্জন আর ফালগুনী মুখোপাধ্যায় পড়তাম। সেই ধারাটা বদলে দেন হুমায়ূন আর মিলন। মেলায় আমার বক্তব্যে বললাম, হুমায়ূন আহমেদ নিজেই একটা ইতিহাস। এত বিশালত্ব নিয়ে খুব কম মানুষ জম্ম  নেন। আমরা সবাই বৃষ্টি দেখি, জ্যোৎস্না দেখি। কিন্তু আয়োজন করে বৃষ্টি আর জ্যোৎস্না দেখার বিষয়টি শিখিয়েছেন হুমায়ূন। আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যায় টানা আটবার তার উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি তার নাটকে, সিনেমাতে শামসাদ বেগমের গানকে যেমন এনেছিলেন, তেমনি বাংলার ফোক সংগীতকে জাগিয়েছিলেন। হাছন রাজা, রাধারমন, শাহ আবদুল করীম, দূরবীন শাহ, উকিল মুন্সীকে নতুন করে তিনি আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। হঠাৎ মনে হলো, বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে চলে গেলেন হাওরে বা নেপালের পাহাড়ে। এমন মানুষগুলো বেশি দিন থাকেন না। হুমায়ূনও থাকেননি। তার মৃত্যুও ছিল বড় ট্র্যাজিক। হঠাৎ হারিয়ে গেলেন মানুষটা। আহারে এভাবে মানুষকে যেতে নেই। মৃত্যুর আগে তিনি জানতেন চলে যাচ্ছেন চিরতরে। মৃত্যু নিয়ে তার চোখে অশ্র“ দেখেছিলাম। ওয়াশিংটনের একটি বাড়িতে শাওন গাইছেন, মরিলে কান্দিসনারে আমার দায়... মরিলে কান্দিস না...। হুমায়ূন চোখের অশ্র“ মুছছেন। হয়তো ভাবছিলেন এই পৃথিবীর মায়া আর তার জন্য নয়। এই দুনিয়া আর তার জন্য নয়। সব কিছু ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুই সত্য। এই সত্যকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে আপ্ল­ুত হয়েছিলেন হুমায়ূন। তার লাশ দেশে আনার পর দাফনের সময় আকাশে মেঘ ছিল। বৃষ্টি ঝরছিল নুহাশ পল্লীতে। আকাশের কান্নার মাঝেই হুমায়ূন বিদায় জানিয়েছিলেন এই পৃথিবীকে।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর