মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আইনের শাসনের সূচনা হয়েছিল যেভাবে

ড. শেখ আকরাম আলী

আইনের শাসন উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে মৌলিক বিষয় হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। ব্রিটিশ শাসন সমাপ্তির সঙ্গে এ উপমহাদেশ থেকে ন্যায়বিচার তথা আইনের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে বলে বলা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর বর্তমান বিচারব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে কথাটি অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের এ উপমহাদেশের আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রবর্তক যে ব্রিটিশ তা বোধ হয় কেউ অস্বীকার করবে না। ব্রিটিশ শাসনের দীর্ঘ সময়ে অনেক জ্ঞানী-গুণী ও দক্ষ শাসকের আবির্ভাব ঘটে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রজাহিতৈষী। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের উৎসাহ ও প্রচেষ্টার ফলে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা হয়। এ উপমহাদেশে আধুনিক বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যারা প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা রেখেছেন তার মধ্যে সবার আগে যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৮৬-১৭৯৩)। সাত বছরের শাসনামলে তিনি যুগান্তকারী অবদান রেখে আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আমরা এখানে বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তার ভ‚মিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। লর্ড কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে নতুন যুগের সূচনা হয়। তিনি সুনির্দিষ্ট সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার শাসনের মূলনীতি ছিল সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। এটা করতে গিয়ে তাকে প্রথমেই প্রশাসনিক সংস্কারের কাজে হাত দিতে হয়। এখানে তিনি ব্রিটিশ সাংবিধানিক আইনকে সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, যার মূলনীতিই হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। লর্ড কর্নওয়ালিস মনেপ্রাণে ক্ষমতার পৃথক কারণে বিশ্বাস করতেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই প্রশাসকদের ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার পরিহার করা সম্ভব। তাই তিনি সরকারি প্রশাসকদের শাসনের পরিবর্তে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। বাংলার গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োগের সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ তাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাস্তবায়নের শর্ত দিয়ে ভারতবর্ষে পাঠায়। তিনটি শর্তের মধ্যে ১. ভ‚মি রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়ন ২. প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ৩. বিচারব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য, এ তিনটি বিষয়েই তিনি সমান দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক ঐতিহাসিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন ও আধুনিক বিচার-ব্যবস্থার গোড়াপত্তন এ উপমহাদেশে নতুন যুগের সূচনা করে এবং এসব কাজের জন্য ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে তাকে উচ্চ আসনে অধিষ্টিত করে। সাত বছরের শাসনামলের শেষ দিকে তিনি বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ১৭৯৩ সালে বিচার সংস্কার আইন প্রবর্তন করে ভারতবর্ষে আধুনিক বিচারব্যবস্থার রূপকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৭৯৩ সালের বিচার সংস্কার আইন অতীতের কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনকে অচল ঘোষণা করে পরিবর্তে ভারসাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠা করে। ক্ষমতার অপব্যবহার চিরতরে বন্ধ করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এই প্রথম আইনবহির্ভ‚ত স্বেচ্ছাচারী কাজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে  জবাবদিহির জন্য তাদের আইন-আদালতের আওতায় আনা হয়। তিনি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে পুরনো বিচার-ব্যবস্থার পরিবর্তে আধুনিক বিচার-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। নিম্ন আদালতের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলসহ নিম্ন আদালতের কার্যবলি পর্যাবেক্ষণ ও তদারকির জন্য উচ্চ আদালতকে ক্ষমতা প্রদান করেন। এসব সংস্কারের কাজ তিনি ১ মে, ১৭৯৩ সালে ৪৮টি বিধানের মাধ্যমে প্রবর্তন করে একটি একক কোডে রূপান্তরিত করেন; যা পরবর্তীতে ইতিহাসে কর্নওয়ালিস কোড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
অত্যন্ত সতর্ক ও দক্ষতার সঙ্গে আদালত ব্যবস্থাপনার বিধানগুলো তৈরি করা হয়। সদর আদালত থেকে শুরু করে  মুনসেফ আদালতের গঠন, ক্ষমতা ও এখতিয়ার বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়। বিচারিক ট্রাইব্যুনালের কার্যবিধিও যত্নসহকারে উল্লেখ করা হয়। নতুন ও আধুনিক এই বিচারব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয় যেন এর মাধ্যমে সূক্ষ, দক্ষ এবং সর্বোপরি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। গরিব-ধনী সব মানুষের জন্য বিচার উপযুক্ত করে লর্ড কর্নওয়ালিস কোর্ট ফি প্রথা বিলোপ করেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে দেওয়ানি আদালতের বিচারকদের কাছ তা অর্পণ করেন। রাজস্ব সংগ্রহ করাই সরকারি কর্মকর্তাদের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস বিশ্বাস করতেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেই মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা দেওয়া এবং জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে মূলত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনটি মৌলিক নীতি দ্বারা তিনি পরিচালিত হন। প্রথমত বিনা খরচে বিচারের ব্যবস্থা, দ্বিতীয়ত জেলা আদালতের অধীন নিম্ন আদালতের ক্রমবিকাশ এবং তৃতীয়ত প্রশাসন ও বিচার বিভাগের পৃথক্করণ।
লর্ড কর্নওয়ালিসকে এ উপমহাদেশের আইন পেশার জনক বলে অভিহিত করা যায়। তিনি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দক্ষ আইনজীবীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত সংস্কার আইনে পেশাদার আইনজীবী সৃষ্টির জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আগে আইন পেশার চর্চা বহাল থাকলেও তা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে। অতীতে যারা আদালতে অভিযোগ নিয়ে আসত তারা নিজেরাই অথবা তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধি মামলা পরিচালনা করত। বাদী বা তার প্রতিনিধি কারোরই আইন ও আদালতের কার্যবিধি সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞান ছিল না। ফলে বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার থেকে অধিকাংশ সময় বঞ্চিত হতো। এসব বিবেচনায় নিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিস সদর দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে সরকারি সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ উপমহাদেশে লর্ড কর্নওয়ালিসই প্রথম শাসক যিনি আইনের শাসনের ধারণাকে স্বীকৃতি দিয়ে ও আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়ে এবং তার বাস্তব রূপ দিতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন। এ উপমহাদেশের প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন কর্নওয়ালিস।
লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

 

সর্বশেষ খবর