মুসলমানের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতার অভিযোগ উত্থাপন কোনো কোনো পশ্চিমা নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মজ্জাগত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি যে চূড়ান্তভাবে সত্যের অপলাপ তা ফুটে উঠেছে ইউরোপের নেতৃস্থানীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও জার্মান পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য জারগেন টডেন হফারের লিখিত Whydo you kill zaid বইয়ের টেন থিসিস’ অংশে। তিনি লিখেছেন,পবিত্র যুদ্ধের’ উদ্ভাবনকারীরা মুসলমান ছিল না যারা ঐশী ইচ্ছার জিগির তুলে ক্রুসেডে যোগ দিয়ে ৪০ লাখ মুসলমান ও ইহুদির হত্যাকা- ঘটিয়েছে। যারা আমাদের রক্ষাকর্তা যিশুর সমাধিক্ষেত্রে প্রার্থনা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এসেছিল তারাও মুসলমান ছিল না। সে সময়ের প্রতিবেদনে যেমন বলা হয়েছে, তারা আনন্দের আতিশয্যে উল্লাস শুরুর আগে জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিল গোড়ালিসমান রক্ত বইয়ে দিয়ে। ইসলাম কখনই পবিত্র শব্দটি যুদ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত করে না। জিহাদ মানে হচ্ছে, স্রষ্টার পথে কঠোর প্রচেষ্টা চালানো’ (হান্স কুং) এবং সে প্রচেষ্টা কখনো প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধকে অন্তর্ভুক্ত করে না। কোরআনের কোথাও জিহাদকে পবিত্র যুদ্ধ এ অর্থ প্রদান করা হয়নি। যুদ্ধ কখনই পবিত্র হতে পারে না, কেবল শান্তি হচ্ছে পবিত্র। দুঃখজনকভাবে পবিত্র যুদ্ধ র ধারণাটি ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নেওয়া (দেখুন জেরেমিয়াহ- ৫১ : ২৭) । যারা আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশকরণের নামে ৫ কোটি মানুষের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তারাও মুসলমান ছিল না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যাতে ৭ কোটি মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইন্ধনদাতা ও মুসলমানরা ছিল না এবং মুসলমানরা নয়, বরং আমরা জার্মানিতে ৬০ লাখ ইহুদি সঙ্গী, নাগরিক, বন্ধু ও প্রতিবেশীকে কলঙ্কজনকভাবে হত্যা করেছি যা ছিল সভ্যতার ওপর অধ্যবসায়ের সঙ্গে সুসংগঠিত এক আঘাত। পাশ্চাত্য সভ্যতার চেয়ে অন্য কোনো সংস্কৃতিই বিগত শতাব্দীগুলোয় এত অধিক মাত্রায় সহিংস ও রক্তপিপাসু ছিল না। তথাকথিত খ্রিস্টান রাজনীতিকরা খ্রিস্টধর্মের মতো এত চমৎকার ভালোবাসাপূর্ণ ধর্মের প্রতি কবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন? এ কথা কারও অস্বীকার করার উপায় নেই, সপ্তম থেকে সপ্তদশ শতকের মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি একই সময়ে ইউরোপীয় শক্তির মতোই মূলত অস্ত্রের মাধ্যমে ঘটেছে। মুসলিম পক্ষেও অমার্জনীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মুসলমান বিজেতারা খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেনি কিংবা তাদের বহিষ্কার বা নিশ্চিহ্নও করে দেয়নি। যখন সালাউদ্দিন কঠিন যুদ্ধের পর ১১৮৭ সালে পুনরায় জেরুজালেম জয় করেন তখন তিনি পূর্ণরূপে প্রতিশোধ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং দরিদ্র খ্রিস্টানদের মুক্তিপণ মওকুফ করেন। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন মুসলিম সভ্যতার বিধান ও গৌরব ছিল। মুসলিম শাসনে সব খ্রিস্টান ও ইহুদি নিজেদের ধর্মেই বহাল ছিল যেখানে খ্রিষ্টীয় যাজক কর্তৃক বিচারে ভিন্ন বিশ্বাস পোষণকারীদের আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হতো।
যখন মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ ৭১১ সালে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে পদার্পণ করেন, তখন সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক বিকাশের এক নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটে যা সাত শতাব্দীরও অধিককাল টিকে থাকে এবং পশ্চিমা সভ্যতায় ব্যাপক অবদান রাখে। ইউরোপের সবচেয়ে আধুনিক অবস্থায় মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সহাবস্থান একটি অতুলনীয় সাফল্যকে প্রমাণ করে। ইহুদিরা খ্রিস্টান আধিপত্যের অধীনের চাইতে মুসলিম শাসনাধীনে অধিকতর ভালো অবস্থায় ছিল। অ্যারাগানের খ্রিস্টান রাজা ফার্ডিনান্ড কর্তৃক স্পেনে মুসলমানদের শেষ দুর্গ গ্রানাডা অধিকার ১৪৯২ সালে তার রিকনকুইস্তা সম্পন্নের পরে ইহুদিদের নির্দয়ভাবে বহিষ্কার করা শুরু হয়। লাখ লাখ ইহুদিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বহু শতাব্দী ধরে ইহুদিরা তাদের সমসাময়িক মুসলমানদের সঙ্গে সম্মান, উচ্চপদ লাভ করে এসেছে এবং শান্তিতে বসবাস করেছে। তাই অধিকাংশ ইহুদিই ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় পালিয়ে যায়। খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানের সহাবস্থান উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কেবল ঔপনিবেশিকতার ও জাতীয়তাবাদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে সমস্যাসংকুল হয়ে ওঠে। তুরস্কে আর্মেনীয় হত্যাকান্ডের দুঃখজনক ঘটনা ছিল জাতীয়তাবাদের ফসল, কোনো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ফল নয়। আলোকিত আন্দালুসিয়া যুগে মুসলমানরা আমাদের জন্য হারিয়ে যাওয়া গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতি ও দর্শনই শুধু উদ্ধার করে আনেনি, তারা নতুন নতুন বিজ্ঞানেরও জণ্ম দিয়েছে। তারা ছিল গবেষণালব্ধ আলোকবিজ্ঞানের প্রবর্তক, কম্পাস, গ্রহসমূহের পথপরিক্রমা এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ওষুধের বহু গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য বিষয়ের আবিষ্কারক। আমরা বিশ্বাস করি বা না করি আমরা এমন এক সংস্কৃতিতে বাস করি যা ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্ম ও ইসলাম কর্তৃক সংগঠিত হয়েছে।
জার্মান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জারগেন টডেনহফারের মূল্যায়নে প্রকৃত অর্থে বিশ্বব্যবস্থার বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে। বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থান ও পারস্পরিক সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে মুসলমানদের প্রতি অকারণ বিদ্বেষের অবসান ঘটাতে হবে।লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক