সোমবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা

তপন কুমার ঘোষ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবরে আমাদের দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষের আস্থা নেই। বাংলাদেশের এ হার এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল ১১টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে এক সমীক্ষায় জানা যায়। আস্থা থাকবেই বা কেন? ফেসবুকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। ছবি             বিকৃত করে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যসহ পোস্ট করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত একটি মহল। গুজব কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার মর্মান্তিক ঘটনা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। মাস কয়েক আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয়। প্রসঙ্গত, মূলধারার গণমাধ্যম এ সময় সঠিক খবরই পরিবেশন করে। অনলাইনে ভুয়া সংবাদ আর গুজবের ছড়াছড়ি। অনেকে আবার গুজব বিশ্বাস করেন, যদি তার ভাবনা বা বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়। ফেসবুকে কমেন্ট করার সময় আমরা পরিমিতিবোধ বা মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তাই অনেক ক্ষেত্রে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে পি-ি চটকানো হয় প্রতিপক্ষের। ভুয়া খবর, বিকৃত ছবি বা মনগড়া ভিডিও অনলাইনে পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এটাকে বলা হচ্ছে ‘ভাইরাল’। উম্মু ক্ত ইন্টারনেট সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে             অশ্ল­ীলতা। অনেকে বলছেন, সোস্যাল মিডিয়াই যত নষ্টের গোড়া। তথ্য-প্রযুক্তির প্রসারের ফলে সারা বিশ্ব এখন               ‘গ্লে­াবাল ভিলেজ’ বা একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তথ্য-প্রযুক্তি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ইন্টারনেটের ভালো-মন্দ নিয়ে শুরু থেকেই বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। নয়া প্রজম্ম  ইন্টারনেট ছাড়া দিনযাপনের কথা ভাবতেই পারে না। ইন্টারনেট নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে। সেলফি তোলা, বন্ধু বা প্রিয়জনের সঙ্গে বার্তা বা ছবি আদান-প্রদান, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, গেম আর ইউটিউব নিয়ে কাটে অনেকটা সময়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর ভালো মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। সাইবার সিকিউরিটি প্রতিটি দেশেই একটি বড় সমস্যা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার বিস্তর অভিযোগ পুলিশের কাছে আসছে। আমাদের দেশে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরাই সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে বেশি মাত্রায়। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, ফেসবুকসহ ইন্টারনেটে সাইবার ক্রাইমের শিকার যারা হচ্ছেন তাদের ৭০ শতাংশ নারী এবং তাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। ফেসবুক এখন ভুয়া আইডির ফেসবুকে পরিণত হয়েছে। কে আসল আর কে নকল, বোঝা কঠিন। গত ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘ফেক আইডির ফেসবুক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কীভাবে ফেসবুক বন্ধুর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন এক নারী সেই করুণ কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এমন উদাহরণ অজস্র। প্রতারণার ধরন প্রায় একই রকম। প্রথমে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়। এরপর নিয়মিত চ্যাট। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। পরিচয়ের সূত্রে একদিন ফেসবুক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ। এরপর ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা। কিন্তু ওই ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধুই এক সময় চরম অবিশ্বাসের কাজ করে বসে। বন্ধু হয়ে যায় শত্রু। তখন কপাল চাপড়ানো ছাড়া করার কিছুই থাকে না। প্রতারণার শিকার হওয়ার পর কেউ কেউ পুলিশের দ্বারস্থ হন। আবার কেউ বা ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে আত্মহননের পথ বেছে নেন। সচেতনতামূলক প্রচার সত্ত্বেও পরিস্থিতির এতটুকু হেরফের হয়নি। একই চিত্রনাট্য বারবার মঞ্চস্থ হচ্ছে। সাবধান! ফেসবুকে প্রতারণার ফাঁদ পাতা আছে। ইতিমধ্যে ফাঁদে পড়েছে বহু ‘শিকার’। ফেসবুকে বন্ধুত্ব পাতানোর আগে বুঝেশুনে পা ফেলুন। কথায় বলে, ‘খারাপ সংবাদ দ্রুত ছড়ায়’। প্রবাদটি ‘ভুয়া’ সংবাদের ক্ষেত্রেও সত্য। ইন্টারনেটের বদৌলতে ভুয়া সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে। তাই বলা যায়, ‘ভুয়া সংবাদ আলোর বেগে ধায়’। কোনটা খবর আর কোনটা গুজব তা চিনে নিতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তথ্যের সত্যাসত্য কীভাবে বিচার করবেন? শক্ত প্রশ্ন বটে! সাধারণের পক্ষে এ কাজটি করা কঠিন, নিঃসন্দেহে। তবে সাধারণ কা-জ্ঞান বা ‘কমন সেন্স’ প্রয়োগ করলে অনেক ক্ষেত্রে বিপদ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু এ ব্যাপারেও আছে উদাসীনতা। কোনো লেখা বা ছবি শেয়ার করার আগে পাঁচবার ভাবতে হবে। কোনো মেসেজ পাঠিয়ে যখন শেয়ার করার জন্য বলা হয় তখন বেশি সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক ছবি বা ভিডিও পোস্ট বা শেয়ার করলে বা অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া দেখালে বিপদ আছে। আইনে জেল-জরিমানার বিধান আছে। আইনের চোখে অজ্ঞতার কোনো স্থান নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে, এটা যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকের জন্য সুসংবাদ নয়। এ প্রসঙ্গে ছোটবেলায় পড়া সেই বাঘ ও রাখাল বালকের গল্পটি মনে পড়ে যায়। একদিন এক রাখাল বালক মাঠে গরু চরানোর সময় ‘বাঘ-বাঘ’ বলে চিৎকার শুরু করে। তার চিৎকার শুনে গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করতে দৌড়ে আসে। কিন্তু কোনো বাঘ দেখতে না পেয়ে তারা ফিরে যায়। মাঝে মধ্যেই রাখাল বালক এমনটা করত। তামাশা করার জন্য রাখাল বালক যে এটা করছে, এক সময় গ্রামবাসী তা বুঝতে পারে। একদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসে। সেদিন তার আর্তচিৎকারে কেউ আর এগিয়ে আসে না। তার বিশ্বাসযোগ্যতা তখন শূন্য। এভাবে চলতে থাকলে সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাও এক সময় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকবে। ফেসবুকের অপমৃত্যু তখন অনিবার্য হয়ে উঠবে।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর