মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাকিস্তানের সেই স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল

সুমন পালিত

পাকিস্তানের সেই স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল

পাকিস্তানকে বলা হয় চক্রবক্র ভূতের রাজত্ব। জঙ্গি তৈরির কারখানা হিসেবেও ভাবা হয় এ দেশটিকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ট্র্যাটেজিক ফোর সাইট গ্রুপের গবেষণায় বলা হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার চেয়েও পাকিস্তান তিন গুণ বিপজ্জনক দেশ। সেনাশাসন পাকিস্তানকে কার্যত দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। দেশটির এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের অন্যতম জেনারেল আইয়ুব খান। স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শালও বলা হয় তাকে। সম্ভবত, তিনিই পৃথিবীর প্রথম ফিল্ড মার্শাল যিনি কোনো যুদ্ধজয় ছাড়াই এ তকমা ধারণ করেছেন। এদিক থেকে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল ইদি আমিনকে একই গোত্রের বলে ধরা যায়। দুর্জনরা বলেন, ইসরায়েলের কাছে গোহারা হারার পরও মিসরের সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ যদি ফিল্ড মার্শাল তকমা ধারণ করতে পারেন তবে আইয়ুব আর ইদি আমিনকে দোষ দিয়ে কী লাভ!

আইয়ুব খান পাকিস্তান নামের দেশটি শাসন করেছেন এক দশক। তাকে পাকিস্তানের হর্তাকর্তা বিধাতা বনতে সাহায্য করে মীরজাফরের চতুর্থ অধস্তন পুরুষ জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি নতুন দেশটির প্রতিরক্ষা সচিব হন। উচ্চাভিলাষী ইস্কান্দার মির্জা নিজের ক্ষমতার পরিসর বাড়াতে সেনাবাহিনীকে তার দাবা খেলার ঘুঁটি বানাবার প্রয়াস চালান। রাজনীতিকদের একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে ষড়যন্ত্র বিস্তারেরও প্রয়াস চালান তিনি। ষড়যন্ত্রী হিসেবে তিনি তার দাদার বাবা মীরজাফরের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না। মীরজাফর ইংরেজদের কাছে বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। তারই পাপে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে ১৯০ বছর সাদা চামড়ার বিদেশি শাসকদের গোলামি করতে হয়েছে। আর তারই বংশধর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও তার সাগরেদ জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানিদের জন্য আজীবন সেনা গোলামি নিশ্চিত করেছেন। দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানে মাঝেমধ্যে নির্বাচন হয়, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু পুতুলনাচের সুতো থাকে জেনারেলদের হাতে।

জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা ছিলেন। একাধিক সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙিয়ে প্রতিরক্ষা সচিব জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার পরামর্শে জেনারেল আইয়ুব খানকে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ইস্কান্দার মির্জা যখন দেশের প্রেসিডেন্ট তখন আইয়ুব খানের চাকরির মেয়াদও বাড়ানো হয়। প্রেসিডেন্ট মির্জা বিরোধী দলকে দমনের অশুভ উদ্দেশ্যে ’৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। পরদিন আইয়ুব খানকে বানান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। আইয়ুব খান সামরিক শাসক হয়ে বুঝতে পারেন তিনিই এখন সব ক্ষমতার অধিকারী। এক বনে দুই বাঘ থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে সম্ভবত আইয়ুবের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ১৯ দিন পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে  জেনারেল আইয়ুব খান নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। আইয়ুব খান তার সামরিক শাসন আড়াল করতে ’৫৯ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেন। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদ ছিল সর্বনিম্ন স্তর এবং এর সদস্যদের বলা হতো মৌলিক গণতন্ত্রী। সারা দেশের ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীকে নিয়ে একটি নির্বাচকম-লী গঠিত হয়। এই নির্বাচকম-লীর ভোটে প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করার বিধান রাখা হয় আইয়ুব আমলের সংবিধানে। তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা দেশবাসীর সমর্থন পায়নি এবং সংগত কারণেই আইয়ুব খানের আজীবন মসনদে থাকার স্বপ্নও সফল হয়নি। ’৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থারও অবসান হয়। ’৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার অভিলাষে মেতে ওঠেন। দেশের সিনিয়র রাজনীতিকদের তিনি রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করেন। ঢালাওভাবে গ্রেফতারও করা হয় রাজনীতিকদের। স্বৈরাচারী শাসনের জন্য আইয়ুব খান নিন্দনীয় ভূমিকা রাখলেও ভূমি সংস্কারসহ নানা সামাজিক সংস্কারে সাহসী ভূমিকা রাখেন।

’৫৮ সালে পারিবারিক ও বিবাহসংক্রান্ত আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেন আইয়ুব খান। এ বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য একটি আইন কমিশন গঠন করেন এবং কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ’৬১ সালে পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ জারী করা হয়। এ আইনে বহুবিবাহের সুযোগ সীমিত ও বিবাহবিচ্ছেদকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বাস্তবায়নেও জেনারেল আইয়ুব সাহসী ভূমিকা রাখেন।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে আইয়ুব খান নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার গৃহীত পদক্ষেপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসস্পূর্ণ করার লক্ষ্যে ভূমি সংস্কার, ভূমি একত্রীকরণ, কৃষিপণ্যের সংগ্রহমূল্য বৃদ্ধি, কৃষি খাতে বর্ধিত হারে বরাদ্দ ও উন্নতমানের বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ’৬২ সালের ১ মার্চ আইযুব খান পাকিস্তানের জন্য প্রেসিডেন্টশাসিত সরকারব্যবস্থাভিত্তিক সংবিধান চালু করেন। এ সংবিধানবলে তিনি দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। আইয়ুব খানের তথাকথিত মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ’৬৪ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের উভয় অংশে মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ’৬৫ সালের ২ জানুয়ারি পরোক্ষ নির্বাচনব্যবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিপূর্বে নির্বাচিত ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী এই নির্বাচনে নির্বাচকম-লী হিসেবে ভোট দেন। মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোট কেনার ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেন তিনি। ফলে জনসমর্থনে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদলীয় প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্নাহকে পরাজিত করে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের সঙ্গে এ দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতি এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কের বিপরীতে পাকিস্তান পশ্চিমা মদদে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার নীতি গ্রহণ করে। আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তান কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্যে পরিণত হয়। ’৫৯ সালে চীনের তিববত দখল ও দালাই লামার ভারতে আশ্রয় গ্রহণ দুই দেশের বন্ধুত্বে চিড় ধরে। ফলে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা দেয়। চীন ও ভারতের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠার বিয়োগান্ত পরিণতি ঘটে ’৬২ সালের সীমান্তযুদ্ধে। এ যুদ্ধে চীনের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন দুই দেশের বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপন করে। চীনের সঙ্গে এই অনানুষ্ঠানিক মৈত্রীই পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির চাবিকাঠিতে পরিণত হয়। ’৬৩ সালের মার্চে চীন-পাকিস্তান সীমান্তচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কারাকোরাম গিরিপথে সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। চীন তার আগের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায় এবং কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। সেন্টো ও সিয়োটো দুই পশ্চিমা সামরিক জোটের  সদস্য পাকিস্তানের সঙ্গে চীন বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা এবং সামরিক সরঞ্জামাদি প্রদানের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। পারমাণবিক প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়টিও দুই দেশের গোপন সমঝোতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। কাশ্মীর নিয়ে ’৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে চীনের কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সরঞ্জামাদি লাভ করে পাকিস্তান। সোভিয়েত ইউনিয়ন জোরালোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করলেও কৌশলগত কারণে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের সঙ্গে সম্পর্কের পথ খোলা রাখার নীতি অনুসরণ করে। ’৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আইয়ুব খান মস্কোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। পাকিস্তানের পাশের দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত থাকায় নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে পাকিস্তান মস্কোর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেবে না- এমনটি চেয়েছিল সোভিয়েত শাসকরা।

আইয়ুব খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন। এ উদ্দেশ্যে ’৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র যতটুকু সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করে, আইয়ুব খানের প্রত্যাশা ছিল তার চেয়েও বেশি। বিশেষত ’৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ভূমিকা পাকিস্তানের অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্মর্তব্য, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কচ্ছের সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে ’৬৫ সালের এপ্রিলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি রেখাবরাবর ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় এ সংঘর্ষের সমাধান হলেও দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। পাকিস্তানি জনগণের কাছে নিজেকে জাতীয় বীর বানাতে আইয়ুব খান ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ’৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান আচমকা হামলা চালিয়ে কাশ্মীরের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে। পাল্টা আক্রমণে ভারত পাকিস্তানের মূল ভূখ-ের লাহোর ও শিয়ালকোটে থাবা বিস্তার করলে পাকিস্তানের টনক নড়ে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আহ্বানে ২৩ সেপ্টেম্বর দুই দেশ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ’৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাশখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির ফলে দখলকৃত এলাকা থেকে উভয় দেশ নিজেদের সেনা প্রত্যাহারে রাজি হয়।

’৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে আইয়ুব খান নিজেকে ফিল্ড মার্শাল ঘোষণা করেন। যুদ্ধে আইয়ুব খানের অর্জন স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। যুদ্ধের সময় ভারতের বিরুদ্ধে বিশাল বিজয়ের কল্পকাহিনী প্রচার করে তিনি সাময়িকভাবে নিজেকে জাতীয় বীর হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পান। কিন্তু ভারতের বন্ধু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নেওয়া ও কাশ্মীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হওয়া জেনারেল আইয়ুব খানের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেয়। আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধের সময় ঘাস খেয়ে হলেও পারমাণবিক বোমা বানাবার অভিলাষ ব্যক্ত করে যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন, তা ধরে রাখতে তাশখন্দ চুক্তির প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এর পাশাপাশি ’৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি পেশ করেন। কোণঠাসা আইয়ুব তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার পথ বেছে নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলা দায়ের করার উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা। প্রথমত, তাশখন্দ চুক্তির পর পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খানের জনপ্রিয়তা নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। ভুট্টো মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে ছাত্র ও যুবসমাজে এ দল দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আইয়ুব খান নিজের পায়ের তলায় মাটি পেতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্তব্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিজের অবস্থান জোরদার করার পাঁয়তারা করেন। কিন্তু তার এ অপচেষ্টা সফল হয়নি। চরম নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও ছয় দফার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ছয় দফা দাবিসংবলিত ছাত্রসমাজের ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলায় জোরদার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ন্যাপপ্রধান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তথা শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নামলে আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। জেলের তালা ভাঙব/শেখ মুজিবকে আনব স্লোগানে রাজপথে নামে ছাত্র কৃষক শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ’৬৬ থেকে ’৬৮ সময়কালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আইয়ুব খান ’৬৯ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু এই সম্মেলন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে আইয়ুব খান ’৬৯ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ’৭৪ সালের ২০ এপ্রিল আইয়ুব খানের মৃত্যু হয়।

             লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

            ই-মেইল :[email protected]

 

সর্বশেষ খবর