বুধবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সংসদ রেখে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

সংসদ রেখে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না

বর্তমান সংসদের মেয়াদ ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ সালে শেষ হবে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) (ক) উপঅনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ থেকে ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯-এর মধ্যে যে কোনো দিন নির্বাচন হতে হবে। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন শুরু হবে ৩০ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখে। হাতে এমনিতেই সময় কম। বিভিন্ন যুক্তিসংগত ও বাস্তব কারণে সরকারবিরোধীরা এখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তার ওপরে সরকার তাড়াতাড়ি করছে। এ পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কিছু বলছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী বলে আসছেন সংবিধান মোতাবেক সময়মতো নির্বাচন হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলে বেড়াচ্ছেন ডিসেম্বর, ২০১৮-এর মধ্যেই নির্বাচন হবে। আবার ইসি সচিব আগ বাড়িয়ে ডিসেম্বরে যে কোনো তিনটি তারিখে নির্বাচন হবেই বলে অনাহূত ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যদিও সংবিধান মোতাবেক সঠিক কারণ সংবিধান মোতাবেক ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে এবং তাই হবে। কিন্তু সেতুমন্ত্রী ও ইসি সচিবের আগ বাড়িয়ে অনাহূত তারিখ ঘোষণায় ‘ডাল মে কুচ কালা’ মনে হচ্ছে।

বিদ্যমান সংবিধান একতরফাভাবে সংশোধন করা হয়েছে বর্তমান সংসদে যেই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা বৃহত্তর জনগণের কাছে নেই। সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক একক সুবিধা অর্জন করার জন্য। ক্ষমতা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কুক্ষিগত রাখার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদটি অন্য আরও কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে করা হয়েছে। সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (৩) উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ যেখানে সংসদ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে সংসদ ভেঙে যাবে সেখানে সংসদ বলবৎ রেখে ১২৩ (৩)( ক) উপঅনুচ্ছেদ যাতে বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নববই দিনের মধ্যে’, বিধান রাখার প্রয়োজন ছিল না। একইভাবে ১২৩(৩)(খ) বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নববই দিনের মধ্যে’, অথচ এখানে ‘ব্যতীত’ শব্দটি অথবা শব্দটি থাকলে আজকে নতুন রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হতো। সংবিধান এখন যে অবস্থায় তা এখন সম্পূর্ণ ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে। এ অবস্থায় নির্বাচন হলে তাতে ন্যূনতম লেভেল প্লেøয়িং ফিল্ড হওয়ার সুযোগ থাকবে না। এ অবস্থায় কোনো সচেতন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

সংবিধান সংশোধনের এখন সময় নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা ও ১১টি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনে মাঠে নেমেছে। যদিও সেতুমন্ত্রী সাফ সাফ বলে দিয়েছেন ৭ দফার কোনো দফাই সরকার মানবে না। যদিও সেতুমন্ত্রীর কথাই শেষ কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, সংবিধান মোতাবেক যথাসময়ে আগামী সংসদ নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যথেষ্ট ইঙ্গিত আছে বলে অনেকে মনে করেন। তেমনি অনেকে মনে করে সরকারের শেষ সপ্তাহে এসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, এখন আলোচনা করারই সময় নেই। এখন জনগণ মনে করে দেশ ও জাতির স্বার্থে সরকারকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বসে আলোচনা করে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করে সবাইকে নির্বাচনে নেমে পড়া আশু দরকার। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দৃশ্যমান ভাবসাবে মনে হচ্ছে সংসদ বিলুপ্ত করে নির্বাচন দিলে হয়তো জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও নির্বাচনে চলে আসতে পারে। সরকার, সংবিধান, রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন সবকিছু জনগণের জন্য। জনগণের শান্তি বিঘিœত হয় এমন পদক্ষেপ কখনই কারও কাছে কাম্য নয়। তাই জনগণ মনে করে বল এখন সরকারের কোর্টে। সরকার যদি জনগণের আশা পূরণে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে রাজনীতির একটি বিজয় দেখার সৌভাগ্য জাতির হবে, যা জনগণের একান্ত কাম্য।

সরকার যদি তার নিজস্ব স্বার্থে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন করাতে চায় তাহলে নির্বাচন যে হবে তাতেও জনগণের কোনো সন্দেহ নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তি ডিসেম্বরের নির্বাচন ঠেকাতে পারবে বলে কোনো আলামত দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিমান সরকার এখন ক্ষমতায়। কিন্তু শক্তিমান ও জনপ্রিয় গ্রহণযোগ্যতা এক জিনিস নয়। ডিসেম্বরে একতরফা নির্বাচন করতে গেলেও কতগুলো মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসবে যার উত্তর খুঁজতে গেলে রাজনীতি আরও জটিল হয়ে যাবে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া মানে এক মাসের বেশি সময় হাতে থাকার পরও নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। এক মাস আগে নির্বাচন হওয়ার হেতু কী? তা জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের জম্ম  দিয়েছে। এ প্রশ্নের আরও বড় কারণ হলো, সংবিধানে ১২৩(৩)(ক) ধারা মোতাবেক নির্বাচনের বেলায় একটি সুস্পষ্ট শর্ত আরোপ করা হয়েছে যা হুবুহু এখানে দেওয়া হলো ‘তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ তার পরিষ্কার মানে হলো নতুন নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা বৈধ সদস্য হবেন না। বিষয়টি যথেষ্ট ঘোলাটে এবং সন্দেহজনক মনে হচ্ছে!!! আগামী নির্বাচনে যদি কোনো দৈব দুর্ঘটনায় বর্তমান সরকারের পা পিছলায় তাহলে তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য নির্বাচন বাতিল করার সর্বময় কর্তৃত্ব তো রয়েই যাচ্ছে। তখন যে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা, জঙ্গি উত্থান প্রতিহত করা, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বিদ্যমান রাখা এবং সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ঐতিহাসিকভাবে দায়বদ্ধ থাকবে না তার গ্যারান্টি জনগণকে কে দেবে? যদি সরকার নির্বাচনের তারিখ ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখের পরে দেওয়ার চিন্তা করত তাহলে অবশ্যই জনগণের মাথায় এই সরল সর্বনাশা সন্দেহ কখনই আসত না।

কিন্তু সরকার সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে সরকার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করাতে চায়। এ প্রমাণকে আরও দৃঢ় করেছে ইসি সচিবের অনাহূতভাবে এবং আগ বাড়িয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং বার বার দৃঢ়তার সঙ্গে একই কথা বলে যাওয়া। সরকারের এই পাতানো নির্বাচনে কোনো সচেতন ও গণবান্ধব সৎ, চরিত্রবান ও দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। তবে এখন তো আবার দেশে কোনো চরিত্রহীন লোক নেই বা থাকলেও বলা যাবে না!! তবে যাই হোক, যদি কেউ অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আশা করেন তাহলে সংসদ রেখে সে নির্বাচন আশা করা কুহেলিকা ছাড়া অন্য কিছু হবে না।

সংবিধানে সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থাও সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩)(খ) উপঅনুচ্ছেদে রাখা হয়েছে। উক্ত বিকল্প উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’। তার মানে অনেকে হয়তো বলার চেষ্টা করবেন যে এই উপধারাটি সংসদের মেয়াদ যদি কোনো কারণে পূর্ণ না হতো তাহলে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু অনেকের বক্তব্য হলো সংসদের মেয়াদ অবসানের ৯০ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচন না হয় তাহলে ওই অবস্থায় সংবিধান কোনো কিছুই উল্লেখ করেনি। তার মানে ওই সময় নির্বাচন না হতে পারাটা সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না বা কোনো সাংবিধানিক সংকট অথবা শূন্যতা সৃষ্টি করবে না। জনগণ এই সরকারকে চার বছর নয় মাস চোখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছে এবং বাকি তিন মাসও মেনে নেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে জনগণ চায় এই সরকার ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে থেকে ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ তারিখে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বলুক। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকুক বা যদি ইচ্ছা হয় তাহলে সরকার ভেঙে দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিরোধী দল থেকে পাঁচজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নিয়ে ৫০ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেও জনগণের কোনো আপত্তি থাকবে না। প্রয়োজনে সরকার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও অন্য রাজনৈতিক দল বা দলগুলোর সঙ্গে গোলটেবিল আলোচনা করে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে যাতে সরকার বাধ্য হয়েছে বলে কেউ অপবাদ দিতে না পারে। কিন্তু সংসদ রেখে নির্বাচনে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। দেশ যেভাবে চলছে চলুক, জনগণের কথা কে ভাবে??? উপায় যখন নেই তখন জনগণ সবই মেনে নেবে। দলের বাইরে জনগণের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং আগামীতে মনে হয় আরও থাকবে না। যে দেশে চরিত্রহীনকে চরিত্রহীন বললে মানহানি হয়েছে বলে ভদ্রলোকেরা খেপে ওঠেন সেখানে আর নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাই না। জনগণ চাইলেই কী আর না চাইলেই কী??? সরকারকে বলব, নির্বাচন দিয়ে দিন। চরিত্রবান লোকের অভাব হবে না। নির্বাচনে অনেক চরিত্রবান লোক পাওয়া যাবে। জনগণ ছাড়া সবাই আসবে। ভগবান চরিত্রবানদের সহায়!!!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর