বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

উদারতাই একমাত্র পথ

তসলিমা নাসরিন

উদারতাই একমাত্র পথ

পিটসবুর্গের এক সিনেগগে ১১ জন প্রার্থনারত ইহুদিকে মেরে ফেলেছে এক লোক। ভেবেছিলাম, লোকটি নিশ্চয়ই মুসলিম সন্ত্রাসী, নিশ্চয়ই ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার শোধ নিচ্ছে। পরে দেখলাম রবার্ট বাওয়ার্স নামে এক খ্রিস্টান লোক গুলি করেছে ইহুদিদের। মুসলিমরা ইহুদিদের ঘৃণা করে, ইহুদিরা মুসলিমদের ঘৃণা করে এরকমই আমরা জানি। বেশির ভাগ মানুষ ভুলেই গেছে যে হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করার লোক এখনও অনেক আছে। নাৎসিবাদে বিশ্বাসীরা এখনও জম্ম  নিচ্ছে, এখনও প্রচণ্ড ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে তারা প্রতিরাতে ঘুমোতে যায়।

আমেরিকার মুসলিম সংগঠন সেলেব্রেট মারসি এবং এমপাওয়ারচেঞ্জ নিহত ইহুদি পরিবারের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছে। এই খবরটি একই সঙ্গে অভাবনীয় এবং অসামান্য। মুসলিমরা ইহুদিদের ঘৃণা করে, ইহুদিদের দিকে রকেট ছুড়ে মারে। ফিলিস্তিনি বাচ্চাদের শেখানো হয় ইহুদিদের ঘৃণা করতে। শেখানো হয় নিজে জীবন দিয়ে হলেও যেন ইহুদিকে খুন করে। যে মুসলমান ইহুদিদের খুন করে, মুসলমানরা তাদের সন্ত্রাসী বলে না, বলে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’। ওদিকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ভূমি। বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ইস্কুল হাসপাতাল। পিঁপড়ের মতো ফিলিস্তিনি মুসলমান মরছে ইহুদিদের হাতে। কোনওদিন শান্তির মুখ দেখবে না, যেন এমনই পণ করেছে দু’পক্ষ। দোষ দু’পক্ষেরই। তবে আমার চোখে বেশি দোষ ইসরাইলের। আজ ইসরাইল সারা বিশ্বে বিশাল এক মিলিটারি পাওয়ার। আর ফিলিস্তিনিদের হাতে শুধু মলিন কিছু অস্ত্র, আর ইটপাটকেল। এই অসম যুদ্ধ অনন্তকাল চলতে দেওয়া যায় না।

সেলেব্রেট মারসির পরিচালক তারেক এল-মাসিদি মনে করেন দুর্গতদের জন্য মুসলমানদের উচিত সাহায্যের হাত বাড়ানো, এমনকি সেই দুর্গত ইহুদি হলেও ইসলাম মুসলমানদের এমন শিক্ষাই দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ইহুদি আর মুসলমানের মধ্যে শান্তি চাই, আর যুদ্ধ নয়, আর ঘৃণা নয়। পিটসবুর্গের ইসলামিক সেন্টার বলেছে, ‘আমাদের গভীর সমবেদনা পিটসবুর্গের সিনেগগ হামলায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য, আহত এবং আহতদের পরিবারের সকলের জন্য, এবং সকল ইহুদি ভাই বোনের জন্য। আমরা প্রতিবাদ করছি সব রকম ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধ, হানাহানি, হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে।’ আরিজনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শায় খাতিরি নামে এক ছাত্র অনলাইনে ছ’লক্ষ ডলার সংগ্রহ করেছে ইহুদিদের সাহায্য করার জন্য। নিহতদের সৎকার আর আহতদের চিকিৎসার জন্যে মুসলমানরা টাকা সংগ্রহ করেছে। কোনও সংগঠন সত্তর হাজার ডলার, কোনও সংগঠন দেড় লক্ষ ডলার। অনলাইনে #Muslims4Pittsburgh হ্যাশট্যাগও ব্যবহার করা হচ্ছে। আহত এবং নিহত ইহুদি পরিবারের জন্য মুসলিমদের এমন উদারতা আমি আগে কখনও দেখিনি।

স্বীকার করি বা না করি, এই তথ্য সত্য যে মুসলমানদের নাম শুনলে অনেকের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। ইউরোপে মুসলমানদের ঢুকতে দেওয়া মানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে আমন্ত্রণ জানানো এ কথা বলে দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকরা জনপ্রিয় হচ্ছেন। বেশ কিছু সন্ত্রাসের ঘটনাও তো ঘটেছে ইউরোপের শহরগুলোয়। ইউরোপ আমেরিকায় অনেকেই মুসলিম ইমিগ্রেন্ট চায় না। মুসলিম নাম শুনলেই মানুষ তফাতে চলে যায়। নাইন ইলেভেনের পর দু’তিন বছর আমিও তটস্থ হয়ে থাকতাম যদি উড়োজাহাজে কোনও গোঁফ নেই কিন্তু দাড়ি আছে, এমন কোনও মুসলিমকে দেখতাম। ভয় হতো, এই লোক হয়তো বোমা মেরে উড়োজাহাজ উড়িয়ে দেবে। আইসিসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখেছে সবাই। অমুসলিম আর অবিশ্বাসীদের প্রতি কী প্রচণ্ড ঘৃণা ওদের! মানুষকে আল্লাহু আকবর বলতে বলতে গলা কেটে কেটে হত্যা করেছে। নিজেদের নৃশংসতা দেখতে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। গোটা বিশ্ব ওদের ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছে। মানুষ দেখেছে বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশেই কী করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একের পর এক প্রগতিশীল ছেলেদের ইসলামের নামে হত্যা করেছে। কী করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস করে দিয়েছে ওরা, প্রাচীন লাইব্রেরিতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ইসলামের নামে চূড়ান্ত বর্বরতা, নৃশংসতা, বীভৎসতা করে ইসলামেরই ক্ষতি ওরা সবচেয়ে বেশি করেছে। মুসলিমদের মধ্যে সকলে যে আইসিস নয়, বা আইসিসের সমর্থক নয়, তা কী করে জানবে সাধারণ মানুষ? মুসলিমদের মধ্যে সকলে যে বোকো হারাম নয়, আল কায়দা নয়, আল-শাবাব নয়, তালিবান নয়, লস্কর এ জাংভি নয় তা কী করে জানবে? গায়ে তো আর লেখা থাকে না, কে সন্ত্রাসী, কে শান্তিপ্রিয়! অল্প কিছু বামপন্থি এবং আদর্শবাদী উদারনীতিক ছাড়া মুসলমানকে কোনও হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক কেউই যেন শান্তিপ্রিয় মানুষ বলে বিশ্বাস করতে পারছে না।

এটা ঠিক, মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রবণতা আজকাল বেশি। অন্য সব দেশে অন্য সব ধর্ম নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি এক সময় ছিল। কিন্তু সব দেশেই সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি হয়েছে, ধর্ম এখন যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মুসলমানের দেশগুলোয় রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার ব্যাপারে গড়িমসি চলছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, নারীর সমানাধিকার এসব যে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হয়, তা অনেক মুসলমানই জানে না। জানে না বলেই আধুনিক পৃথিবীতে মুসলমানদের ঠাঁই হয়েও হচ্ছে না। সৌদি আরবের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সম্পর্ক টিকে আছে শুধু তেল আর অস্ত্র কেনাবেচার সম্পর্কের ওপর। আরব দেশগুলোয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, বাকস্বাধীনতার যে কোনও স্থান নেই, তা সকলেই দেখছে। যে মানুষই ধর্ম বা শাসকের সমালোচনা করে, তাকেই হয় জেলে যেতে হয়, নয়তো নির্বাসনে যেতে হয়, নয়তো খুন হয়ে যেতে হয়। মুসলমানেরা সকলে মিলে এর চেয়ে ভালো কোনও দেশ গড়ে তুলতে পারেনি। মুসলমানদের দেশ থেকে মুসলমানরাই পালিয়ে বাঁচতে চায়। ইউরোপ আমেরিকাকে দিনভর গালাগালি করলেও ওই দেশগুলোই মুসলমানদের সত্যিকার নিরাপত্তা আর গণতান্ত্রিক অধিকার দিচ্ছে। তারপরও বিশ্বাসঘাতকতা দেখছি। প্যারিসে, নিসে, বার্লিনে, ব্রাসেলসে, স্টকহোমে, লন্ডনে, নিউইয়র্কে দেখছি মুসলিমদের সন্ত্রাস। নিরীহ মানুষদের মেরে কি আদৌ মুসলমানদের বা ইসলামের কোনও লাভ হয়েছে বা হচ্ছে?

মুসলমানের প্রতি মানুষের যে তীব্র ঘৃণা, তা দূর করার দায়িত্ব মুসলমানকেই নিতে হবে। মুসলমানরা সবাই অসহায় নয়, দরিদ্র নয়। অনেকের হাতে অঢেল টাকা। মানুষের সেবার জন্য মুসলমানকে এগিয়ে আসতে হবে। মানবাধিকারের পক্ষে, নারীর সমানাধিকারের পক্ষে মুসলমানকে দাঁড়াতে হবে। মুসলমানদের শিক্ষিত হতে হবে। আধুনিক হতে হবে। মন থেকে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা সম্পূর্ণ দূর করে তাদের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়াতে হবে। তাদের হাতে হাত রেখে একসাথে চলতে হবে। যে সন্ত্রাস বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা করেছে, এতে কোথাও শান্তি আসেনি, শুধু অশান্তি আর অসন্তোষই এসেছে। বিরামহীন যুদ্ধ এসেছে। অমুসলিম যত মরেছে, তার চেয়ে বেশি মরেছে মুসলমান। মুসলমানরা মুসলমানদের প্রতিও উদারতা দেখায় না। সিরিয়ার শরণার্থীদের কোনও মুসলিম দেশ আশ্রয় দেয়নি, দিয়েছে খ্রিস্টানদের দেশ।

নিজের ঘৃণা দূর করতে পারলে অন্যের ঘৃণাও দূর হবে। সন্ত্রাস বন্ধ করলে অন্যরাও সন্ত্রাস বন্ধ করবে। আজ পিটসবুর্গের মুসলমানদের এই উদারতা অন্যান্য দেশের মুসলিমদেরও প্রেরণা দিক উদার হতে। ভারতের মুসলমানরা এগিয়ে আসুক দরিদ্র আর দুর্দশাগ্রস্ত হিন্দুদের সাহায্যে। পাকিস্তানের মুসলমানরা পাকিস্তানের খ্রিস্টানদের শুধু হত্যাই করেছে, হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে এবার দরদি হোক। বাংলাদেশের মুসলমানরা হিন্দুদের ভাঙা ঘরবাড়ি গড়ে দিক, এমন উদারতা দেখাক, একটি হিন্দুকেও যেন আর দেশ ত্যাগ না করতে হয়। সৌদি আরব  অমুসলিমদের মন্দির গির্জা বানাবার অনুমতি দিক, উদার হোক আরও। আর বোমা নয়, চাপাতি নয়, এবার সাহায্য আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক মুসলমানরা। জগৎ দেখুক। মুসলমানরা আল্লাহু আকবর বলে মানুষকে মারতে নয়, মানুষকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে জানে। বিশ্বাস ভাঙতে খুব সময় লাগে, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে অনেক বছর লাগে। কিন্তু বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে দিতে হবে। শুধু অন্যকে সাহায্য করলেই বিশ্বাস ফিরবে না, নিজেকেও মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, এর জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা।

বাংলাদেশে হুজুরদের ওয়াজ দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিধর্মীকে ঘৃণা আর হত্যা করার জন্য মুসলমানদের ইন্ধন জোগানো হচ্ছে। এসব ওয়াজ বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। যুবকদের জংগি বানাবার সব আয়োজন বহাল থাকবে, আর জংগি হওয়ার পর ওদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলতে হবে এ কোনও সুস্থ শাসকের পদ্ধতি হতে পারে না। মন্দের উৎসটা বন্ধ করলে ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা করার মতো নৃশংসতার দরকার হয় না।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর