বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র বনাম দলতন্ত্র

জাকারিয়া চৌধুরী

গণতন্ত্র বনাম দলতন্ত্র

মানুষ রাজনৈতিক দল গঠন করে কোনো একটি আদর্শকে ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। দল যখন আদর্শচ্যুত হয়ে ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে পড়ে, নেতারা দেশ ও জনগণের চেয়ে দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখেন, তখন সেই দল ও সংঘবদ্ধ অপরাধী বা মাফিয়া চক্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আমাদের দেশের ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করে যে, আমরা এক অশুভ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও প্রথার কাছে বন্দী হয়ে পড়েছি। স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অটল নির্ভীক ও দূরদর্শী নেতৃত্বে অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা আমাদের এনে দিয়েছিল জনকল্যাণকর এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপূর্ব সুযোগ। আর একশ্রেণির লোকের জন্য এই ছিল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ আদায়ের জন্য দুর্নীতির মহাসুযোগ যা ক্রমে দুর্নীতির মহোৎসবে পরিণত হয় এবং জনগণের ভাগ্যে থাকে উচ্ছিষ্ট। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দুর্নীতির অদমনীয় বিস্তার দেখে তাই তো বঙ্গবন্ধু এক জনসভায় দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে তোমরা সোনার মানুষ দেও আমি তোমাদেরকে সোনার বাংলাদেশ গড়ে দেব।’ নৈতিকতাবিবর্জিত রাজনীতি দিয়ে কখনো ন্যায়ের শাসন এবং জনজীবনের সার্বিক ও সুদৃঢ় উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। রাজনীতি কি পেশা, না নেশা, না ব্রত? রাজনীতি পেশাও নয়, নেশাও নয়, রাজনীতি সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল এক সামাজিক ব্রত। রাজনীতিতে আসা তারই সাজে যে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সমাজের জন্য অবদান রাখতে চায়। সেই লোকের অভাব নেই আমাদের দেশে তবে তাদের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে বিগত দিনের বিষাক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ড। তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের মুক্তি নেই। রাজনীতিতে লাগামহীন দুর্নীতির কারণে বছরের পর বছর ধরে দেশে গড়ে উঠেছে এক দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতি।

আজ আমি মনে করি, রাজনীতি থেকে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাবিদার যারা হবেন তাদের মধ্য থেকে যদি দুর্নীতি হটানো যায় তাহলে ব্যবসার ক্ষেত্র থেকেও দুর্নীতি দূরীভূত হবে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রথম টার্গেট হওয়া উচিত রাজনীতিবিদ, প্রকৃত ব্যবসায়ী নয়। কারণ রাজনীতিবিদরা সমাজের মাথা, তাদের ওপর ন্যস্ত থাকে দেশের শাসনভার। মাথায় পচন ধরলে তা ছড়িয়ে পড়ে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন যেসব ব্যবসায়ী তাদের কথা আলাদা। দুর্নীতির এক বড় উৎস হলো বিদেশি বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যারা লোভনীয় সরকারি কন্ট্রাক্ট বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে বাগিয়ে নিয়ে নিম্ন মানের পণ্য ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে লাভবান হয়। ঘুষের বখরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ ও আমলারা ভাগ করে নেয়। দেশের উন্নয়ন ভীষণভাবে হয় ক্ষতিগ্রস্ত। যেসব বৈদেশিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজেরা লাভবান হতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

যে কটি কারণে আমাদের দেশের রাজনীতি কলুষিত ও গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে নিম্নে উল্লিখিত কারণগুলো প্রধান :

১। দলতন্ত্র : গণতন্ত্রের নামে দলতন্ত্র এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন তা দলীয় স্বৈরতন্ত্রে রূপ নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের দাপটে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। আবার বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় আসীন হয় তখন ক্ষমতাচ্যুত দলের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হন। এ এক অসহনীয় ও অশুভ পরিস্থিতির দিকে দেশকে নিয়ে গেছেন দলবাজ রাজনীতিবিদরা। একপর্যায়ে গিয়ে তা গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করতে পারে, যেমনটি হয়েছিল ২০০৬ সালে নির্বাচনের প্রশ্ন নিয়ে। নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে আমরা সেই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব-সন্দেহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি এখনো। এ দ্বন্দ্ব একপর্যায়ে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে আমাদের সংঘাত ও সংঘর্ষের পথে নিয়ে গিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলতে পারে। আশা করি আমাদের রাজনীতিবিদরা শেষ পর্যন্ত সেই পথ পরিহার করে সমঝোতা, সম্প্রীতি ও শান্তির পথে আমাদের উদীয়মান দেশকে নিয়ে যাবেন। তা ছাড়া দলতন্ত্রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এমন পর্যায়ে গেছে যে সমাজের প্রতিটি পেশা ও প্রতিষ্ঠানে তার কালো থাবা ক্রমেই জাতিকে বিভক্ত করে পেশাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও স্বচ্ছতাকে দারুণভাবে খর্ব করে দিয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শ্রমিক, আমলা, উলেমা, কোর্ট-কাচারি ইত্যাদি হেন জায়গা নেই যেখানে অঙ্গদলের নাম করে প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের প্রতিযোগিতায় আমরা মত্ত হই না। একনায়কত্বের অধীনে one pary system বা একদলীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার ও দল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বহুদলীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার ও দল দুটি আলাদা সত্তা। সরকার চলে সংবিধান ও আইনের অধীনে। ক্ষমতাসীন দল নির্বাহী ক্ষমতার বলে সংবিধান ও আইনবিরোধী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে না। অথচ আমাদের দেশে সাংবিধানিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এমনকি বিচার বিভাগও দলীয়করণের প্রভাবে পড়ে নিজস্ব স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে দেশকে অপশাসনের পথে নিয়ে যাচ্ছে, জাতির মধ্যে বিদ্বেষ ও বিভাজন সৃষ্টি করছে। বিভাজন এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে এখন বিএনপি ঘরানার ছেলের সঙ্গে আওয়ামী ঘরানার মেয়ের বিয়ে কিংবা বিএনপি ঘরানার মেয়ের সঙ্গে আওয়ামী ঘরানার ছেলের বিবাহবন্ধনও আর হবে না। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে দেখা-সাক্ষাৎ হলে দুই দলের নেতাদের মধ্যে কুশল বিনিময়ে কোনো আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায় না। আমরা কি তাহলে জাতি না হয়ে বিবাদ-বিদ্বেষে জড়িত উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ব?

২। ক্যাডার রাজনীতি : কোনো গণতান্ত্রিক দলে ক্যাডার বাহিনী থাকতে পারে না। অথচ আমাদের রাজনীতিতে ছাত্র ও যুব সংগঠনের নাম করে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী তৈরি করে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করা হয়। অনেক সময় যা খুনাখুনির পর্যায়ে চলে যায়। নির্বাচনের সময় কোনো কোনো ভোট কেন্দ্র জবরদখল করে অস্ত্রের জোরে ভোট ছিনিয়ে নেওয়া হয়। প্রতিপক্ষের ভোটারদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। সাধারণ ভোটাররা মুক্তমনে ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

৩। প্রতীকী রাজনীতি : আমাদের মতো দেশে কোটি কোটি লোক নিরক্ষর থাকার কারণে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয় দলীয় প্রার্থীকে চিহ্নিত করার কারণে। নিরক্ষরতাশূন্য উন্নত কোনো দেশে ভোটাভুটির বেলায় এ ধরনের প্রতীকের প্রচলন নেই। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে এই প্রতীকী প্রথা প্রকৃত প্রার্থী নির্ণয়ের পথে এক বড় বাধা। নির্বাচনের সময় আমরা ব্যক্তির মূল্যায়ন না করে প্রতীকের মোহে মত্ত হয়ে পড়ি। প্রতীক নিয়ে দলের মধ্যে মনোনয়ন বাণিজ্য প্রসার লাভ করে। এ প্রথা উঠিয়ে দিয়ে ইউনিয়ন বা উপজেলা নির্বাচনে অতীতে যেমন ব্যক্তিগত প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা হতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেলায়ও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত হবে। তবেই নির্বাচনী প্রার্থীর প্রকৃত মূল্যায়ন কিছুটা হলেও হবে। মার্কার মোহে ভোটাররা মোহগ্রস্ত থাকবে না এবং দলীয় সহিংসতাও লোপ পাবে। শুধু দলীয় মার্কা নয়, আমাদের দেশে দলীয় পতাকা বা সংগীতেরও প্রচলন আছে যা অতিদলীয় উম্ম ত্ততায় অনেক সময় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে মানুষকে জাতীয় পরিচয় ও জাতীয় প্রেমের চেয়ে দলীয় পরিচয় ও দলীয় প্রেমের দিকে ধাবিত করে।

৪। ধনতন্ত্র না গণতন্ত্র : টাকার জোরে যারা প্রভাবশালী লোকদের মাথা কিনে, সন্ত্রাসী ক্যাডার লালন-পালন করে এবং প্রচারমাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয় তারা আর যাই হোক জনপ্রতিনিধি হতে পারে না। কোনো ব্যবসায়ী যখন টাকার জোরে জনপ্রতিনিধি হন, তখন তিনি জনস্বার্থের চেয়ে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি দাম দেন। গণতন্ত্র যদি অতিমাত্রায় দলনির্ভর হয়ে পড়ে, তাহলে দলকে ঘিরে কায়েমি স্বার্থ মাথা চাড়া দেয় যা গণতন্ত্র ও চিন্তার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে।

যদি বর্তমান জগতের গণতন্ত্রচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু মত অবাস্তব মনে হয় তবু আমি বলব দলভিত্তিক নির্বাচন না করে এলাকা ও ব্যক্তিভিত্তিক নির্বাচন করলে কেমন হয়? দলের দায়িত্ব হবে দলীয় আদর্শের আলোকে আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা মেনিফেস্টো আকারে নির্বাচনের প্রাক্কালে উপস্থাপন করা। নির্বাচনের পর জয়ী সদস্যরা নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্য থেকে একটি দলকে বেছে নেবে এবং যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে সেই দল সরকার গঠন করবে। আর যদি কোনো দল বা ফোরামই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করে তাহলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে। নির্বাচনী ফলাফলের সরকারি ঘোষণার পর একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা করতে হবে।

এখনকার গণতান্ত্রিক ধারায় দলীয় সিদ্ধান্ত তা যৌক্তিক-অযৌক্তিক, নৈতিক-অনৈতিক, সুবিবেচিত-অবিবেচিত যাই হোক না কেন দলীয় সদস্যকে তা বিবেকবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়! এ পন্থায় বিবেকসম্মত রাজনীতির বিকাশ কি হতে পারে? বিবেকবিবর্জিত রাজনীতির কারণেই আজ পৃথিবীব্যাপী এত অন্যায়, অবিচার ও অনাচার। রাজনীতি ও ব্যবসায় নাকি বিবেকের কোনো স্থান নেই। ক্ষমতার জন্য, মুনাফার জন্য সবকিছুই নাকি জায়েজ। তাই তো বলা হয়, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই!’

আমাদের মনে রাখা উচিত কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধানেই দলের বা দলীয় রাজনীতির কোনো উল্লেখ থাকে না। নির্বাচনী এলাকার সর্বসাধারণের স্বাধীন ও মুক্ত ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার কথা যিনি এলাকার জনসাধারণের কাছে দায়বদ্ধ ও তাদের প্রতি অনুগত থাকেন। অথচ বাস্তবে দলীয় গণতান্ত্রিক চর্চায় সেই প্রতিনিধি নিজ এলাকার জনসাধারণের চেয়ে দলের প্রতি বেশি অনুগত থাকেন ও দলের নেতৃত্বকে খুশি রাখার কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন। এমনকি পরিচিতির বেলায়ও বলা হয় অমুক পার্টির এমপি, বলা হয় না অমুক এলাকার এমপি। ফলে আবরাহাম লিঙ্কনের ভাষায় মুখে বলি overnment by the people, for the people, of the people কিন্তু বাস্তবে পাই Government by the Party, for the Party, of the Party। আর জনগণ ক্ষমতার উৎস না হয়ে, হয়ে পড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। আমাদের দেশে এমনকি দলীয় মনোনয়নদানের ব্যাপারেও স্থানীয় মতামতের চেয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বেশি প্রাধান্য পায়। স্থানীয় জনমত যাচাই ও গ্রহণ করার ব্যাপারে দলের গঠনতন্ত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে অনেক সময় চাঁদাবাজি ও তোষামোদির জোরে মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়া হয়। এ ধরনের বিকৃত গণতন্ত্র বা পরোক্ষ গণতন্ত্রচর্চার বদলে direct democracy বা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রচর্চা করা এখন সময়ের দাবি। ফ্লোর ক্রসিং করলে এমপি সংসদের সদস্যপদ হারান, অথচ পাঁচ বছর ধরে এলাকার দিকে কোনো নজর না দিলেও কিংবা এলাকায় না গেলেও তার সদস্যপদ যায় না! সংসদ সদস্যদের সবাই নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন ও শান্তি রক্ষার ব্যাপারে যদি মনোযোগী হন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অনেক ত্বরান্বিত হবে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অতীতে তা হয়নি, তবে আগামীতে তা হবে বলে কি আশা করা যায়? এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিকে অবস্থাবিশেষে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা ভোটদাতাদের দেওয়া উচিত। এজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা খুবই প্রয়োজন।

গণতন্ত্রের কয়েকটি স্তম্ভের মধ্যে একটি প্রয়োজনীয় স্তম্ভ হলো তৃণপর্যায়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন। দুঃখের বিষয় হলো সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব আমার পরামর্শে কিনা জানি না প্রশাসন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য যখন উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করতে গেলেন তখন সব কটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের দাবিদার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, ইসলামের দাবিদার জামায়াতে ইসলামী শুধু বিরোধিতাই করেনি, তারা আন্দোলন করে উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করারও চেষ্টা করল। উপজেলা পদ্ধতির প্রতি জনগণের সমর্থন ও আগ্রহের কারণে আন্দোলন ভেস্তে গেল। তখন সব দলই তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোয় এ প্রথা অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হলো। তবে ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রের দাবিদার দুই দলই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ক্ষমতা খর্ব করে ইউএনও ও এমপির ওপর ন্যস্ত করল এবং উপজেলা পর্যায়ে বিচারব্যবস্থা উঠিয়ে নিল। এমপি ও মন্ত্রী সাহেবরা ক্ষমতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভাগ বসাক, তা চান না। সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয়ভাবে কুক্ষিগত করে রাখতে চান। এ ব্যাপারে ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে Holiday-তে আমার লিখিত নিবন্ধ Blue Print for A Good Government-এ আমি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, পার্লামেন্টে নির্বাচিত আমাদের দেশের এমপিরা কখনই উপজেলা পদ্ধতি মেনে নিতে চাইবেন না। গোটা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমেই কেন্দ্রীভূত ও কুক্ষিগত হয়ে সমাজব্যবস্থা মানবিক না হয়ে দানবিক রূপ নিচ্ছে। মানব ভবিষ্যৎ হুমকির পথে এগিয়ে যাচ্ছে সতর্কীকরণ সত্ত্বেও।

বিচার বিভাগ : গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে প্রয়োজন বিচার বিভাগের সংবিধান-প্রদত্ত স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা যা আমাদের প্রায় ৫০ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

গণতন্ত্রের সুফল পেতে হলে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেশকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী ইউনিয়ন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে যার যার দায়িত্ব পালন করতে পারলেই গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে; অন্যথায় নয়।

আগামী সংসদ নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্যভাবে হয় তা যেন শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য না হয়, তা যেন হয় কিছুটা হলেও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য। তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন লাখ লাখ শহীদের স্বপ্ন এবং ১৭ কোটি মানুষের আশা পূরণ হবে; অন্যথায় আমরা জাতি হিসেবে অন্ধকার পথে হাঁটা দেব। রেফারি স্বয়ং যদি বিতর্কিত হন তাহলে যেমন খেলার ফলাফল দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না তেমনি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যারা, তারা যদি বিতর্কিত হন, নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে নির্বাচনের ফলাফল গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে রাজনীতির প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা জাগে, সমাজে অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫০ বছর হতে চলল, আমরা এখনো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও হানাহানি থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলার মানুষ স্বভাবতই নির্বাচন ও গণতন্ত্রমুখী। আমরা কখনো ভাত-কাপড়ের আন্দোলন করিনি, অতীতের সব আন্দোলন হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নিয়ে। বাঙালির পেটে ভাত থাকুক না থাকুক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হলে সে গর্জে ওঠে। আমাদের বেছে নিতে হবে আমরা রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্রীড়াঙ্গনের নিয়মনীতি মেনে চলব, না রণাঙ্গনের নিয়মনীতি মেনে চলব।

সব কথার শেষ কথা আমাদের বুঝতে হবে গণতন্ত্র শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট প্রক্রিয়া নয়, গণতন্ত্র মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির ব্যাপার যা চর্চা করতে সময় লাগে। দেরিতে হলেও আমরা যেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি। গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শত বাধা সত্ত্বেও অব্যাহত থাক এটাই জাতি কামনা করে।

                লেখক : সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর