শুক্রবার, ২ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র স্লোগান নয়, চর্চার বিষয়

নূরে আলম সিদ্দিকী

গণতন্ত্র স্লোগান নয়, চর্চার বিষয়

নির্বাচনটা যতই এগিয়ে আসছে, কাক্সিক্ষত পরিবেশটা তো তৈরি হচ্ছেই না, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবেশ ততই রং বদলাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে একে প্রচ-ভাবে রাজনৈতিক অশনিসংকেত হিসেবে প্রতিভাত হতেও দেখা যাচ্ছে। রক্তের চড়া দামে কেনা স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক দীর্ঘ পথপরিক্রমণে হেঁটে আসা প্রান্তিক জনতার জন্য আজকের এই রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশ ও পরিস্থিতি শুধু দুঃখজনকই নয়, নিদারুণ দুর্ভাগ্যজনক এবং অনভিপ্রেত। কারণ, আজকের এই রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দায়ী প্রান্তিক জনতা নয়, সমস্ত দায়দায়িত্ব যাদের স্কন্ধে বর্তাবে তারা রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক জঞ্জালবিমুক্ত একটি সমাজ গড়া যাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল, ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তারাই এই দুর্বিপাক সৃষ্টির কারিগর হয়ে উঠেছেন। এর মূল ও মুখ্য কারণ রাজনীতির ভিত্তি আজ আদর্শভিত্তিক নয়। দেশপ্রেম ও মানুষের কল্যাণ আজ রাজনীতির দিকনির্দেশনা তৈরি করে না। ক্ষমতায় আরোহণ, ক্ষমতার সিংহাসনে উপবেশন অথবা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ক্ষমতাকে আজীবন আঁকড়ে রাখার হীনমন্যতাই আজকের রাজনীতিকে এতখানি বিতর্কিত, প্রতিহিংসাপরায়ণ, অসহিষ্ণু, সর্বোপরি অস্থির করে তুলেছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ দেশের রাজনীতিতেও আদর্শের প্রবহমান ধারা কার্যকর ছিল। বাংলার রাজনীতির দিগন্তবিস্তৃত আকাশে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, টাঙ্গাইলের শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুর মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির মতো আলো বিকিরণ করেছেন। মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করেছেন, উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত করেছেন। উদ্যত উদ্গত উদ্ধত পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো বিকশিত করেছেন। তাঁদের রাজনৈতিক পথপরিক্রমণ শুধু বাংলাদেশকেই উজ্জীবিত করেনি, সমস্ত বিশ্বজনমতকে চমৎকৃত করেছে, বিস্মিত করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমণ যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার যে সুপরিকল্পিত ধারা তাঁরা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তা বাঙালি জাতিকে শুধু যে ঐক্যবদ্ধ করেছিল তাই নয়, তাদের আত্মপরিচয়ে উদ্দীপ্ত করেছিল এবং আন্দোলনে চলার পথে নির্ঘোষিত হয়েছিল আমি বাঙালি, আমি অজেয়। শোষণ-বঞ্চনা নির্যাতন-নিগ্রহ যত নিষ্ঠুর ও নির্মমই হোক না কেন, অজেয় অকুতোভয় বাঙালির বিজয় সাধনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শত ষড়যন্ত্র করেও পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক শাসকরা তা পারেনি। অশান্ত সমুদ্রে বাঙালি তার বিজয়যাত্রায় সংগ্রামের তরণিকে সাফল্যের সৈকতে ভিড়িয়েছে দক্ষ নাবিকের সূক্ষ্ম অভিযানের সফলতায়।

আদর্শের সর্বোচ্চ কলাকৌশলই হলো রাজনীতি। আদর্শবিবর্জিত রাজনীতি সাময়িকভাবে ক্ষমতার মুখ দেখালেও কালের স্রোতধারায় আঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হয়। এবং বাংলাদেশেই শুধু নয়, পাকিস্তান আমল থেকে ৬০ বছরের রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। সামরিক ও বেসামরিক চক্র তাদের কোটারি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই তাদের নীলনকশা তৈরি করে। এই নীলনকশার মূল লক্ষ্য ছিল, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রান্তিক জনতাকে বিতাড়িত করে তাদের কুটিল ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়াকেই কার্যকর রাখা। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে দুবার ঢাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

আবার এ বাঙালিই প্রত্যক্ষ করেছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নে কলকাতাসহ বাংলার দাঙ্গাবিধ্বস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অসহায়ভাবে ফেলে রেখে অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎক্ষণাৎ ঢাকায় ছুটে আসেননি। শেরেবাংলার কৃ-ষক প্রজা পার্টি ১৯৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর ব্যক্তি হিসেবে তখনকার বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের দল কৃষক প্রজা পার্টি অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে যায় এবং শেরেবাংলাও রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তাই রাজনৈতিক রশি টানাটানির এক প্রান্তে খাজা নাজিমউদ্দিন (জমিদার, ভূস্বামী ও খান বাহাদুরদের প্রতিনিধিত্ব করতেন), অন্যদিকে মুসলিম লীগের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান জনতার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ’৪৬-এর নির্বাচনেও তাঁর প্রচ- সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম ও সফল হন। পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক শক্তি জোটবদ্ধভাবে এতটাই শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে যে, তারাই শহীদ সাহেবকে পাকিস্তানে ঢুকতে না দেওয়ার নীলনকশা তৈরি করেছিল। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর প্রজ্ঞা, জনভিত্তি, সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার জোরে তাদের সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কলকাতা একটু স্বাভাবিকতা ফিরে পেলে তিনি সব বাধা-বিপত্তিকে নস্যাৎ করে ঢাকায় আসেন বটে, কিন্তু ক্ষমতায় বসতে পারেননি। পাঞ্জাব বিভক্ত হলে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সংসদে মুখ্যমন্ত্রী সরদার হায়াত খানের কোনো আস্থা ভোটের প্রয়োজন হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী রয়ে যান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আস্থা ভোটের প্রবর্তন করে কূটকৌশলে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পরাজিত করে নাজিমউদ্দিন সাহেবকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়।

ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে কথাটি সামনে আনতেই হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সত্যনিষ্ঠ একগুঁয়েমিও আস্থা ভোটে তাঁর পরাজয়ের অন্যতম কারণ। সিলেটবাসীর একটি মন্ত্রীর দাবি মেনে নিলে আস্থা ভোটে তাঁকে পরাজয়বরণ করতে হতো না। বরং তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হতেন। তাহলে হয়তো ইতিহাসের চাকা অন্যদিকেও ঘুরতে পারত। তবে ইতিহাস তার নিজের ভাষাতেই কথা বলে। রাজনৈতিক সুদূরপ্রসারী চিন্তার ধারক শহীদ সাহেব প্রথমে জিন্নাহ মুসলিম লীগ, পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করে স্বৈরাচারী মুসলিম লীগের রাজনীতির মোকাবিলা করেন। শেরেবাংলাকে সামনে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটানোর তিনিই মুখ্য কারিগর ও মহাননায়ক। তিনি এতই বাস্তববাদী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা ছিলেন যে, শেরেবাংলা যদিও রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন, তবু তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে শহীদ সাহেব ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই ‘দুই পা অগ্রসর হওয়ার জন্য এক পা পিছিয়ে আসা’র কৌশল অবলম্বন করেন এবং হক-ভাসানীকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করান।

আজকের নেতৃত্ব কি অনুধাবন করতে পারবেন সংগঠন তাঁর, বুদ্ধি তাঁর, নির্বাচনের মূল খরচের দায়িত্বও তাঁর; অথচ শেরেবাংলা ও মওলানা ভাসানীর নামটিকেই তিনি সম্মুখে নিয়ে এলেন! শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মানসিক ঔদার্যের এই বিশালতাই ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ভিত্তি ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য, আজকের রাজনীতিতে এই ঔদার্যের বিরাট আকাল।

বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিকে সঠিক ও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণের তাগিদেই উপরোক্ত আলোচনার উপস্থাপনা করতে হলো। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দল অনেক দিন ধরে কহর পাড়ছে, একটি সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য। সরকারের কাছে অনেকটা অনুনয়-বিনয়ের মতোই সব দলের বৈঠক আহ্বানের দাবিটি অবশেষে সরকার আমলে নিয়েছে এবং গতকাল ১ নভেম্বর একটি বৈঠক হয়েছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্ট জোরালোভাবে দাবিটি তুলে ধরেছে এবং ঐক্যফ্রন্টের নেতা দাবিটির প্রতি প্রতিটি সভায় প্রচ- গুরুত্বসহকারে উত্থাপন করছেন বলে তাকে ধন্যবাদ। বলতে দ্বিধা নেই, এই মোর্চা গঠন ও দাবি উত্থাপনে অনেকটাই বিলম্ব হয়ে গেছে। এই মোর্চার পেছনে দুর্জয় মনোবল নিয়ে জনগণ সংগঠিত হওয়ার আগেই শেখ হাসিনা নির্বাচনটি তাঁর নিজস্ব কৌশলে সেরে ফেলতে পারেন। যার ফলে সর্ব অনুমিত নির্বাচনের ফলাফল সাময়িকভাবে হলেও তাদের দাবিগুলোকে ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরিয়ে দেবে। এসব কারণেই দেশজোড়া সমগ্র জনতার হৃদয়ে দুশ্চিন্তার মেঘ একেবারে সরে যায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লে­ষকরা ভাবছেন, শেষ পর্যন্ত এই সংলাপটি ব্যর্থ হয়ে দেশ একটি মহাদুর্যোগের কবলে না পড়ে যায়, একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি না উদ্ভব হয়! অন্যদিকে ২ নভেম্বর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টও সরকারি দলের সঙ্গে সংলাপ করছে। যে কোনো যৌথ সংলাপের পেছনেই মানুষ আশার আলো খুঁজতে চেষ্টা করে।

পাকিস্তান অর্জনের অব্যবহিত পরই জনগণকে আন্দোলনের পথেই হাঁটতে হয়। সেই হাঁটার যেন শেষ নেই, কোনো পরিসমাপ্তি নেই। তবু আমি নিঃশঙ্কচিত্তে জিন্নাহ সাহেবকে ধন্যবাদ প্রদান করব, তিনি ১৪০০ মাইলের ব্যবধান সমন্বিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই আমাদের পক্ষে বাংলাদেশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। আমরা যদি বিশাল ভারতের অঙ্গ বা অংশ হিসেবে রয়ে যেতাম, তাহলে সেখান থেকে ছুটে এসে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। জিন্নাহ সাহেব যখন পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রামে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, তখন ভারতীয় কংগ্রেসের সুচতুর নেতৃত্ব তাকে ভারত বিভক্ত না করার জন্য নানারকম চাপ প্রয়োগ করেছেন, প্রলোভনও দেখিয়েছেন। এমনকি গান্ধীজি কংগ্রেস জাতীয় কমিটিকে পরামর্শও দিয়েছিলেন, জিন্নাহ সাহেবকে অবিভক্ত ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রস্তাব করার জন্য। কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী পরিষদ ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে কংগ্রেস কার্যনির্বাহী পরিষদের একটি অংশ গান্ধীজির এই প্রস্তাবটিকে প্রত্যাখ্যান করে। জওহর লাল নেহরু কৌশলী নেতা হিসেবে গান্ধীজির সঙ্গে দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও সরাসরি গান্ধীজির বিরোধিতা না করে যে দূরদৃষ্টির পরিচয় দেন, তাই তাঁকে ভারতীয় কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতৃত্বের আসনে প্রতিস্থাপিত করে। শুধু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীই নন, তাঁকে আমৃত্যু ওই গৌরবের আসনটিতে অধিষ্ঠিত রাখে। আমাদের এখনকার রাজনীতিতে এই সৌজন্যবোধের কৌশলটি একেবারেই অনুপস্থিত; বরং ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রচ-ভাবে উদগ্র ও উচ্চকণ্ঠ। ফলে সহিষ্ণুতা, দূরদর্শিতা ও সহমর্মিতার মানসিকতা রাজনীতি থেকে একদমই নির্বাসিত। আজকের রাজনীতির মূল কথাই হলো তোরা যে যা বলিস ভাই, ক্ষমতা আমার চাই। খালেদা জিয়া, তাঁর দল ও অনুসারীদের একই চিন্তা। বাংলাদেশ যেন তাদের এজমালি সম্পত্তি এবং খালেদা জিয়াই তার প্রথম এবং আজীবনের মোতওয়াল্লি। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ভাবছেন, তাঁর পিতা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে দুর্দমনীয় আন্দোলন সৃষ্টি করে বাংলাদেশ অর্জন করেছিলেন, এখানে অন্য কারও ক্ষমতায় থাকা বা আসা অনধিকারচর্চার মতোই একটি বিষয়। খালেদা জিয়ার স্বামী ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের ভিতর দিয়ে এমনিতেই বাংলার মসনদকে অনেকদিন দখল করে রেখেছিলেন। এমনকি খালেদা জিয়া নিজেও অনভিপ্রেতভাবেই এই ক্ষমতাকে বহুদিন ভোগদখল করেছেন। আর কত? আর কেন? এই বিতর্কের আবর্তেই বাংলাদেশের রাজনীতি রয়ে গেল! আফসোস! স্বাধীনতাযুদ্ধে যাদের সরাসরি অংশগ্রহণই নেই, সেই দুই ভদ্রমহিলাই আজ বাংলাদেশের দুটি মহলের দন্ডমুন্ডের একক অধিকর্তা! কী হৃদয়বিদারক বিচিত্র এই পরিস্থিতি! এ দুই নেত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে টুঁশব্দটি করার সাধ্য কারও নেই। করতে গেলে গর্তে পড়তে হবে। অথচ পাকিস্তানের রাজনীতিতে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মহীরুহসম ব্যক্তিত্ব, মওলানা ভাসানীর মতো নেতা মাঠ সরগরম করতেন, তার মধ্য থেকেও শেখ মুজিবের মতো তরুণ নেতা আপন গৌরবে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ অবস্থানে প্রতিস্থাপিত হয়েছিলেন। আজ সেই আবহ নিঃশেষিত। এর কারণ প্রায় সবাই রাজনীতিতে আদর্শের চর্চার চেয়ে মোসাহেবি ও অর্চনাকে করণীয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ভারতে সংসদীয় রাজনীতি রাষ্ট্রে এবং সংগঠনে শুধু বিরাজমানই নয়, মাটির গভীরে শিকড় গেড়েছে বলেই ভারত পৃথিবীর বুকে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে হিমাচলের মতো মাথা উঁচু করে দন্ডায়মান। সেখানেও রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, জঘন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে মুসলিম নিধনের উম্ম ত্ততা চলে, নির্বাচনের প্রাক্কালে ককটেল ফোটে, বোমার প্রচ- শব্দে কানে তালা লেগে যায়। তবু গণতন্ত্র সেখানে থেমে যায় না, বরং সমুদ্রের স্রোতধারার মতো আপন মহিমায় সামনের দিকে ধেয়ে চলে। সামরিক শাসনের অভিশাপ সেখানে নেমে আসে না, সামরিক ছাউনিতে সেনাব্যক্তিত্বের ঔরসে সৃষ্ট কোনো দল দেশ শাসনের অধিকার পায় না। একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও ব্যক্তির আধিপত্যের ঔদ্ধত্য প্রদর্শিত হয় না। তাই সেখানে শত ঘাত ও প্রতিঘাতে গণতন্ত্র তার আপন শক্তিতে এগিয়ে চলে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে সংগঠনে, সংসদে রাজনৈতিক পরিম-লের কোথাও যৌথ নেতৃত্ব বা সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের লেশমাত্র পরিলক্ষিত হয় না। ক্ষমতাসীন দলে তো বটেই, বিরোধী দলেরও প্রায় সবকটিতেই একজন ব্যক্তিকেই যে কোনো সিদ্ধান্তের সর্বময় কর্তা হিসেবে প্রতিভাত হতে দেখা যায়। কোথাও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসারও কোনো উদ্যোগ নেই। অবলীলাক্রমে এই ব্যবস্থা চলছে। মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতেও চলবে। সংগঠনেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, সেই সংগঠন ক্ষমতাসীন হলে সরকার বা কেবিনেট যাই বলেন, সেখানে গণতন্ত্র কি অলৌকিকভাবে আসমান থেকে আসবে? গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দুর্নীতিও প্রচ-ভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। যখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম, তখন এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতে দিইনি। তাতে আমার জীবনে ব্যক্তিগতভাবে অনেক মূল্য দিতে হলেও অবস্থাটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পেরেছি। রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কারণ শিল্পপতি হওয়া নয়, রাজনীতির আবহটাই রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে আমাকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করেছে।

সরকার তো দূরে থাক, আজকের বিরোধী জোট বা দলগুলোর দিকে তাকালে ব্যক্তি আধিপত্যের করুণ চিত্রটিই প্রতিভাত হয়। জোটের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট দল যারা থাকেন, তারা মতামত প্রদানের চাইতে জোটে জুড়ে থাকায়ই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে একটা ব্যতিক্রম আমার চোখে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর চিত্রটি একটু ভিন্ন। সেখানে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় বটে, কিন্তু নির্বাচিত নেতৃত্বের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বা সমালোচনা করার কোনো সুযোগ নেই।

এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেশটি মোসাহেব পরিবেষ্টিত হয়েই শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিবেশে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এর একটিই প্রতিকার প্রতিটি সংগঠনে প্রত্যেক দায়িত্বশীল নেতাকে তার সংগঠনকে বুঝতে হবে, আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং দলের আদর্শকে উপলব্ধি করে কর্মসূচি প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার এটিই যথাযথ উপায় ও অবলম্বন। রাজনীতিতে একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত; সেই প্লেটো-অ্যারিস্টটলের যুগ থেকেই মনীষীরা বার বার বলে আসছেন অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। এতে ঝুঁকি আছে, সেই ঝুঁকিটাকে নিয়েই এগোতে হবে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা

সর্বশেষ খবর