শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টাবাগান চুয়াডাঙ্গায়

শাইখ সিরাজ

দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টাবাগান চুয়াডাঙ্গায়

গত ১০ বছরে ফল চাষ বাংলাদেশের কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বলতে গেলে ফল চাষিরা একরকম বিপ্ল­ব ঘটিয়ে দিয়েছে। বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০১৫ অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩.২৩ লাখ একর জমিতে মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে ৪৬.৯৭ লাখ মেট্রিক টন। তারা বলছে ফলের বার্ষিক উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.৭%। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী সারা দেশে ৭৩টি হর্টিকালচার সেন্টার থেকে প্রতি বছর মানসম্পন্ন চারা/কলম উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়। এসব সেন্টার থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৭.৫২ লাখ ফলের চারা ও ৬.৬৩ লাখ ফলের কলম উৎপাদন করা হয়েছে। কৃষিতথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। আর মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বের ২৮তম স্থানে রয়েছে। ব্যক্তিপর্যায়ে প্রচুর ফলদ চারা উৎপাদন হচ্ছে। চাষ হচ্ছে নানান ফলের। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও প্রতিদিনের খাবার হিসেবে ফল ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে। আর এ কারণে ফলকে লাভজনক কৃষি ফসল হিসেবেই দেখছেন সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা। সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ছোট্ট জেলা চুয়াডাঙ্গায় গিয়েছিলাম সেখানকার কৃষি কর্মকা- দেখতে। জেলাটির গ্রামে গ্রামে ফল ফসলের সমৃদ্ধি এখন বর্ণনাতীত। বছরের যে কোনো মৌসুমে বিস্তীর্ণ খেত থাকে ফসলে পূর্ণ। প্রত্যন্ত গ্রামগুলো এখনো পুরনো দিনের গ্রামীণ পরিবেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ছবির মতো সুন্দর সব দৃশ্যপট।

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ভগীরথপুরের মরাগাং নদীতীরে সাখাওয়াৎ হোসেন বাবুল গড়ে তুলেছেন বিশাল এক মাল্টাবাগান। সে বাগান দেখতে এক সকালে রওনা হলাম। সঙ্গে যথারীতি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর ধারক দল। নামে মরাগাং হলেও নদীটি কোনোমতেই মরা নয়। টলটলে স্বচ্ছ পানি নিয়ে বয়ে যাচ্ছে জীবনের স্পর্শ মেখে মাটির বুক ছুঁয়ে। মাল্টাবাগানটিতে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য মধ্য আকাশে।

বাংলাদেশে ফলে পূর্ণ এমন মাল্টাবাগান বিস্ময়করই বটে। এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। একেকটি গাছ মাল্টায় ঠাসা। সবুজ হলুদ মাল্টা জানান দিচ্ছে ফল উৎপাদনে নতুন এক সমৃদ্ধির কথা। বাংলাদেশে বিদেশি ফল মাল্টার অভিযাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। পিরোজপুরের অমলেশ রায়ের হাত ধরে রেবতি সিকদার, পঞ্চগড়ের উদ্যোগী কৃষক সালাহউদ্দিন, মেহেরপুরের মুজিবনগরের ইসমাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতিউরের মাল্টাবাগানের দৃশ্যপট ও সফলতার গল্প আমরা দেখেছি। এ ছাড়া সারা দেশেই কমবেশি মাল্টাবাগান গড়ে উঠেছে। এ সুবাদেই মাল্টা এখন কোনো অচেনা কিংবা বিদেশি ফল নয়। এটি চলে এসেছে আমাদের নিজস্ব ফলের তালিকায় এবং তা স্বাদে গন্ধে বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে আসা মাল্টার চেয়ে অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে বারি এক জাতের মাল্টা। যেটির পেছনে পয়সার মতো একটি আকৃতি রয়েছে। এ বাগানটি এর আগে আপনাদের দেখানো যে কোনো বাগানের চেয়ে সমৃদ্ধ ও বড়। ৪০ বিঘা জমিতে ৪ হাজার মাল্টা গাছ। প্রতিটি গাছই ফলে পূর্ণ।

বাবুল একজন সাধারণ সরকারি চাকরিজীবী। কৃষিতে তার অনুরাগ অনেক আগে থেকেই। তবে নিজেই কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তায় পরিণত হওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য এক অনুপ্রেরণা। তিনি জানালেন, শৈশব থেকে টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান দেখে কৃষির প্রতি তার গভীর আগ্রহ জম্মে । সাখাওয়াৎ হোসেন বাবুল এই বিশাল বাগান সাফল্যের সঙ্গে গড়ে তুলে এবার রীতিমতো বিশ্বাস পেয়ে গেছেন, বাংলাদেশ অল্প দিনেই মাল্টা আমদানি থেকে সরে এসে রপ্তানি শুরু করতে পারবে। বাবুল বাগানেই মাল্টার স্বাদ গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন। টকের লেশমাত্র নেই। মিষ্টতার কমবেশি আছে। কোনো কোনোটি তীব্র মিষ্টি, কোনোটি মিষ্টতায় একটু কম। তবে রসে পরিপূর্ণ মাল্টা। একেবারে গাছপাকা মাল্টার স্বাদই আলাদা। সাখাওয়াৎ হোসেন বাবুল গত বছর এ বাগান থেকে বিক্রি করেন দেড় শ মণ মাল্টা। এবার ফলন হয়েছে আরও বেশি। তার সঙ্গে কথা হয় বিনিয়োগ ও আয়ের নানা দিক নিয়ে। তিনি জানালেন, এ বছর যে ফলন এসেছে, আগামী বছর এমন ফলন এলে তার বিনিয়োগ উঠে এসে দেখবেন লাভের মুখ।

এমন উদ্যোক্তা কৃষকের হাত ধরেই বাংলাদেশে মাল্টাবাগান দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাবুল বললেন, বাগান সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তিনি নিজেও উদ্যোগী হয়েছেন। বাবুল এ বছর তার বাগানে ৫০ হাজার এই সুমিষ্ট মাল্টার কলম চারা করেছেন। চারাগুলোর বেশ চাহিদা। বাগানেই দেখা হলো মেহেরপুরের এক আগ্রহী উদ্যোক্তা শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি এসেছেন ৫০টি চারা কিনতে। তিনি বললেন, মাল্টা যেমন পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করবে তেমন এ থেকে লাভ পাওয়াও সহজ।

আজকের দিনে কৃষি উৎপাদনই শেষ কথা নয়, পরিকল্পিত বিপণন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাবুলের চার বছরের এই মাল্টাবাগানে বিপণনের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন হামিদুল হক। ইতিমধ্যে নতুন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে দেখেছেন বাজার সিন্ডিকেটের নানামুখী তৎপরতা।

শতভাগ প্রাকৃতিক ফল হিসেবেই মাল্টা বাজারজাত করার স্বপ্ন বাবুলের। তিনি নিজে এবং বিপণনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কখনো চান না, কৃত্রিম কোনো কিছু প্রয়োগ করে মাল্টার রং আকর্ষণীয় বা হলুদ করতে। আরও প্রাকৃতিক ও সতেজ বোঝাতে প্রতিটি মাল্টার সঙ্গে ডগা ও দুয়েকটি পাতাও পাড়া হয়। এভাবেই বাজারজাত করা হয়। এর বহুমুখী কার্যকারিতাও রয়েছে। বাবুলের মাল্টাবাগান সত্যিই এক বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। বাগানের পরিধি, ফলের প্রাচুর্য, সমৃদ্ধি সবকিছুই এক পরিবর্তিত কৃষির চেহারা আমাদের সামনে মেলে ধরে। এ বাগানটি শুধু সাখাওয়াৎ হোসেন বাবুলের জীবনের পরিবর্তনই করছে না, গোটা এলাকার কৃষিবৈচিত্র্যে এটি হয়ে উঠেছে এক উজ্জ্বল ক্ষেত্র। যেখান থেকে বহু মানুষই পাচ্ছে অনুপ্রেরণা।

বাবুলের বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আবদুর রহিম। ছেলের এই কৃষি উদ্যোগ শুরুর দিকে তার কাছে ভালো লাগেনি। কিন্তু এখন এই সমৃদ্ধ বাগান দেখে তারও মন জুড়িয়ে যায়।

আর মরাগাং পাড়ের এই সমৃদ্ধ মাল্টাবাগান জানান দেয় এ দেশে কৃষি পর্যটনের অমিত সম্ভাবনার কথা। যেমনটি উন্নত বিশ্বে দেখা যায়। মরাগাংয়ের সুন্দর প্রকৃতি ও বাবুলের মাল্টা বাগানের তাজা ফলে কৃষি পর্যটনের নতুন সূচনা হতে পারে এ দেশে। অন্য যে কোনো উদ্যোগের তুলনায় কৃষি উদ্যোগ ব্যতিক্রম এজন্য যে, এখানে প্রয়োজন হয় সর্বোচ্চ নিষ্ঠা আর মাটির প্রতি ভালোবাসা। শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়েই কৃষিতে সফলকাম হওয়া যায় না, যদি না তার সঙ্গে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকে। স্বল্প আয়ী একজন চাকরিজীবী হয়ে সাখাওয়াৎ হোসেন বাবুল যে সাহসিকতা নিয়ে এত বড় একটি মাল্টাবাগান গড়েছেন, তাতে সাফল্য আসত না, যদি তিনি এখানে নিবেদিতপ্রাণ না হতেন। আমি বিশ্বাস করি বাবুলের সাফল্য দেশের বহু উদ্যোক্তাকে সাহস আর উৎসাহ জোগাবে মাল্টাবাগান গড়ায়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর