শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

আখেরি চাহার শোম্বা ও মহব্বতে রসুল (সা.)

মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান : সিনিয়র পেশ ইমাম

পৃথিবীর রীতি অনুযায়ী কোনো রাজদূত স্বীয় কর্তব্যকর্মে অসামান্য কৃতিত্ব লাভ করতে পারলে দেশের রাজা সম্মান প্রদানার্থে তাকে রাজধানীতে ডেকে পাঠান। রাজদূতও কর্তব্য শেষে আপন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থাও ঠিক এ রকমই ছিল। মহাপ্রস্থানের প্রায় ছয় মাস আগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে এতটুকু আভাস দেওয়া হয়, আপনার প্রস্থানকাল নিকটবর্তী হয়ে আসছে। আল্ল­াহ বলেন, ‘আপনার জন্য পরকাল ইহকাল অপেক্ষা উত্তম।’ সূরা দোহা, আয়াত ৪। হজরত ফাতিমা (রা.) বলেন, রসুলুল্ল­াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন গোপনে আমাকে ডেকে বললেন, ‘হজরত জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর একবার আমার কাছে কোরআন মাজিদ পেশ করেন। কিন্তু এ বছর দুবার পেশ করেছেন। এতে আমার মন বলছে, পৃথিবী থেকে আমার চলে যাওয়ার সময় খুব নিকটে।’ দশম হিজরির রমজান মাসে এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর ফাতিমা (রা.)-কে তিনি এ কথা বলেছিলেন এবং সে সময়ই তিনি মহাপ্রস্থানের আয়োজন শুরু করেন। সাধারণত তিনি প্রতি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফে বসতেন কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। অতঃপর বিদায় হজের সময় সূরা নাসর নাজিল হয় এবং সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত যেখানে বলা হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য পবিত্র দীন ইসলামকে পূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের প্রতি আপন নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে দীন হিসেবে তোমাদের জন্য পছন্দ করলাম।’ উপরোক্ত সূরা ও আয়াত অবতীর্ণ করার মাধ্যমেও আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায়ের সময় নিকটবর্তী হওয়ার আভাস দিয়েছেন। তবে এবারকার আভাস পূর্বাপেক্ষা অনেকটা স্পষ্টতর।

তাই তিনি বিদায় হজের খুতবায় বলেছিলেন, ‘সম্ভবত তোমাদের সঙ্গে এ বছরের পর আমার সাক্ষাৎ নাও হতে পারে।’ হজের কার্যাবলি শেষ করে মদিনায় ফিরে আসার পর সব কাজেই যেন তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। পরম প্রিয়ের আহ্বান পেয়ে তাঁর মন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠল। বিদায়কাল আসন্ন তাই তিনি একদিন ওহুদ প্রান্তরে শহীদদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন এবং এরূপ করুণভাবে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন, যেভাবে কোনো অন্তিম শয্যাশয়ী স্বীয় প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করে। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই তাঁর সাহাবাদের উদ্দেশে অন্তিম উপদেশ, নসিহত ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করে তাদের সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর অবিচল থাকার তাকিদ প্রদান করেন।

অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, যেদিন তাঁর অসুস্থতার সূচনা হয় সে দিনটি ছিল একাদশ হিজরির সফর মাসের শেষ বুধবার। যে দিবসটিকে ফারসি ভাষায় আখেরি চাহার শোম্বা বলা হয়। হজরত মায়মুনার ঘরে সফর মাসের শেষ বুধবার দিন রসুলুল্ল­াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতা আরম্ভ হয় এবং তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মোট ১৩ অথবা ১৪ দিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছা ও অন্য বিবিদের পরামর্শের ভিত্তিতে শেষ সপ্তাহের সেবা-যত্নের দায়িত্ব হজরত আয়েশা (রা.) গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সোমবার হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষে স্থানান্তরিত হন এবং পরবর্তী সোমবার তাঁর কক্ষেই তাঁর ইন্তেকাল হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের হৃদয়-বিদারক সংবাদ কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবায়ে কিরাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। হজরত ওসমান (রা.) অনেকটা বেহুঁশ অবস্থায় দেয়ালের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে বসেছিলেন। মানসিক যন্ত্রণায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছিলেন না। হজরত আলী (রা.) কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ও অন্য বিবিগণ যে কী পরিমাণ ব্যথিত হয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। হজরত ওমর (রা.)-এর অবস্থা ছিল এই যে, তিনি তরবারি উত্তোলনপূর্বক দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলেন, যে ব্যক্তি বলবে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুনিয়ায় বেঁচে নেই আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। একপর্যায়ে হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) সাহাবায়ে কিরামের উদ্দেশে মর্মস্পর্শী ও নাতিদীর্ঘ এক খুতবায় বহু বিষয়ের সঙ্গে কোরআনুল কারিমের সেই আয়াতখানাও উল্লেখ করলেন যেখানে বলা হয়েছে, ‘আর মুহাম্মদ একজন রসুল বই তো নয় তার আগেও বহু রসুল অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাহলে তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাৎপসরণ করবে? বস্তুত কেউ যদি পশ্চাৎপসরণ করে তাতে আল্ল­াহর কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না।’ এ আয়াত শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে চেতনা ফিরে আসে।

সর্বশেষ খবর