রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কিছু কাহিনী কিছু সংলাপ

নঈম নিজাম

কিছু কাহিনী কিছু সংলাপ

সময়টা ২০০১ সালের নির্বাচনের আগের। হঠাৎ দেখলাম এটিএন বাংলা অফিসে হাওয়া ভবনের লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এ সময়ে বার্তা বিভাগের দায়িত্ব আমাকে দিলেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান। দায়িত্ব নিয়েই শুনতে পেলাম মাহী বি. চৌধুরী একটি নির্বাচনী অনুষ্ঠান তৈরি করছেন। এ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালীন সময়ের খুন, লুটপাট তুলে ধরা হবে। থাকছে ভয়ঙ্কর সব বর্ণনার ভিজুয়াল। একদিন মাহী বি. চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো অফিসে। খোঁজখবর নিতেই তিনি বললেন, অসাধারণ একটি অনুষ্ঠান করছি। বাংলাদেশ কেঁপে উঠবে এবার। কী কী আছে এতে, তিনি বললেন, অপেক্ষা করুন। তবে জানালেন, তার নির্মিত অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করবেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি শুধু খ্যাতিমান চিকিৎসক নন, জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও উপস্থাপক। আর আমার চোখে মাহী বি. চৌধুরী স্মার্ট একজন মানুষ। তার চলনে-বলনে আলাদা একটা স্টাইল আছে। আর আশির দশকের শুরু ও সত্তরের শেষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বি. চৌধুরীর স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান সাড়া জাগিয়েছিল সারা দেশে। ধরেই নিলাম, অনুষ্ঠানটি দর্শক গ্রহণ করবে। বার্তা বিভাগের মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। কারিগরি দিক থেকে এটিএন বাংলার কোনো অবস্থানই ছিল না। কীভাবে খবর তৈরি করে এডিটের পর ইন্টারনেটে ব্যাংকক পাঠাব সেই চিন্তায় আমি তখন অস্থির। প্রতিদিন কারিগরি বিষয় নিয়ে বসি এ বিষয়ে দক্ষ সহকর্মীদের সঙ্গে। সংবাদ পড়ানোর পর এডিট করে পল্টন পাঠিয়ে দিই। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিসেট ব্যবহার করে পাঠানো হয় ব্যাংকক। থাইকম সাটেলাইটে আতিয়ার সাহেব রিসিভ করে সম্প্রচার করেন এটিএনবাংলার দর্শকদের জন্য। ভয়ঙ্কর এক টেনশন নিয়ে এটিএনবাংলা নিউজের যাত্রা শুরু করলাম। এর মাঝে মাহী চৌধুরীর অনুষ্ঠান নিয়ে এটিএন অফিসে ফিসফাঁস। একজন ভিডিও এডিটর আমাকে জানালেন, এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার হলে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ হয়ে যাবে। আগামী নির্বাচনে জয়লাভ কঠিন হবে। মাহফুজ ভাইয়ের কাছে বললাম বিষয়টি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক। বাস্তবে এটিএনের চরম আর্থিক খারাপ সময় তখন। মাহফুজ ভাই বললেন, মাহী আগাম টাকা দিয়েছে। টাকা খরচও হয়ে গেছে। এক কাজ করুন আওয়ামী লীগকে বলুন ভালো অনুষ্ঠান করে দিতে। তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য কোনো অর্থ নেব না। বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ, সরকারের পাঁচ বছরের সাফল্য নিয়ে সম্প্রচারের মতো কোনো অনুষ্ঠান নেই। এমনকি এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাও নেই।

যোগাযোগ করলাম, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তিনি আমার কাছে পাঠালেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও সাবেক সচিব আজিজুর রহমানকে। তারা দুজনই চাকরি থেকে মাত্র এলপিআরে গেছেন। দুই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এলেন, বললেন, কোনো একটা কিছু ম্যানেজ করতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর শাসনকালে এমন চিন্তা কারও মাথায় আসেনি। অথচ হাওয়া ভবন থেকে মাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে নিখুঁত পরিকল্পনা হয়েছে। শাবাশ বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের বিপরীতে তবুও কিছু একটা করা দরকার। তাদের নিয়ে গেলাম মাহফুজ ভাইয়ের কাছে। তিনি বললেন, আপনারা ভালো অনুষ্ঠান করুন। আমি বিএনপির চেয়ে বেশি সময় দেব। কোনো পয়সা নেব না। বিএনপি চাংক নিয়েছে টাকা দিয়ে। মাহফুজ ভাইয়ের রুম থেকে বের হয়ে ফোন দিলাম সৈয়দ বোরহান কবীরকে। বিটিভিতে তার পরিপ্রেক্ষিত তখন সুপার হিট। বোরহানকে বললাম, তোর অফিসে আসছি দুজন অতিথি নিয়ে। খাওয়ার তৈরি রাখ। দুই সচিব মাহমুদ আলী ও আজিজুর রহমানকে নিয়ে গেলাম বোরহানের অফিসে। বিস্তারিত বললাম তাকে। বোরহান সব শুনলেন। এবার বললাম, অনুষ্ঠান করে দিতে মাহী বি. চৌধুরীর শাবাশ বাংলাদেশের বিপক্ষে। কোনো টাকা পয়সা পাবে না। আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে করে দাও। বোরহান বলল, এত অল্প সময়ে কী করে সম্ভব? আমি বললাম, সম্ভব একজনের পক্ষে। তার নাম বোরহান কবীর। সঙ্গে আছি আমি। বোরহান আবার বলল, মাহী চৌধুরী অনেক দিন থেকে পরিকল্পনা নিয়ে করছে। অনেক প্রস্তুতি। তার বাবা উপস্থাপক। আমরা কাকে নেব? বললাম, শমী কায়সারকে দিয়ে আমরা উপস্থাপনা করব। ভালো কাউন্টার হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্ল­াহ কায়সারের সন্তান। তার মা পাঁচ বছর এমপি ছিলেন। পারিবারিক দায়িত্ব এই কাজ করা। সঙ্গে সঙ্গে শমীকে ফোন দিয়ে বললাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে তোমার খালু ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে হবে। শমী বলল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য যা দরকার তাই করব। বোরহানকে ফোন দিলাম। কথা চূড়ান্ত হলো। কাজও শুরু হয়ে গেল। শাবাশ বাংলাদেশের বিপরীতে জয় বাংলার জয়। মাহী চৌধুরীর শাবাশ বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে বিশাল বাজেট। আমাদের কোনো বাজেট নেই। মাহমুদ আলী ও আজিজুর রহমান স্বস্তি নিয়ে ফিরে গেলেন। সব অগ্রগতি জানালেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আমাকে বার্তা পাঠালেন, কোনো সমস্যা হলে জানাতে।

না কোনো সমস্যা হয়নি জয় বাংলার জয় নির্মাণ ও সম্প্রচারে। শেষ দিন শুধু শাবাশ বাংলাদেশ ছিল ৩০ মিনিট। জয় বাংলার জয় ছিল এক ঘণ্টা। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে বিএনপি আপত্তি জানিয়েছিল। সেই আপত্তি ছিল এটিএন বাংলার বিপক্ষে। এর রেশও ছিল অনেক। কারণ দর্শক শাবাশ বাংলাদেশ মনে রেখেছে। ডকুমেন্টারিগুলো বীভৎস হলেও নির্মাণ মান ছিল অতুলনীয়। জয় বাংলার জয় সেভাবে গ্রহণ করেনি। এই কারণে এটিএনের বিরুদ্ধে একটি গ্র“প সমালোচনাও করে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রথম কর্মিসভা ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন এটিএন বাংলার রিপোর্টার মনিউর রহমান ও ক্যামেরাম্যান রিপন অথবা সেন্টু। তারা ফোন করে বললেন, ওখানকার অবস্থা ভালো নয়। অনেক নেতাকে লাঞ্ছিত করছে কর্মীরা।

গালাগাল চলছে গণহারে। আক্রমণকারীদের চোখ এটিএনের ক্যামরার দিকেও। কারওয়ান বাজার অফিস থেকে অনুষ্ঠানস্থলে গেলাম। বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের মধ্যে আমার অতি ঘনিষ্ঠজনরাও আছেন। তাদের বললাম, এটিএন বাংলার ক্যামরার দিকে চোখ দেওয়া যাবে না। আগামী পাঁচ বছর এটিএনই হবে আওয়ামী লীগের পক্ষে সবচেয়ে বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠান। তারা মনিউরের সামনেই বলল, এত কিছু বুঝি না। আপনি বলেছেন, কিছু করব না। নির্বাচন শেষে মাহী চৌধুরীর সঙ্গে বারবার দেখা হতো এটিএনবাংলা অফিসে। খুবই আন্তরিক মানুষ। ভালো বক্তৃতা দেন। ভালো কথা বলেন। এর মাঝে বাবার ছেড়ে দেওয়া আসনে এমপি হয়েছিলেন। ইতিবাচক রাজনীতির পক্ষে ছিল তার বক্তৃতা। একবার তার আসনে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সফরকে ঘিরে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় বিএনপির সঙ্গে। দীর্ঘ ফলাফলে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বঙ্গভবন ছাড়তে হয়। সেই এক ইতিহাস। এই ইতিহাস সবার জানা। তবে অজানার আরেকটি অংশ ২০১৪ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগে এক বন্ধুর অনুরোধে মাহী চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু অনুরোধ করেন মাহী চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চান। নোয়াখালী চাটখিলের এমপি ইব্রাহিমের অফিসে সেই বন্ধু ও মাহী বি. চৌধুরীর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় নির্বাচনে অংশ নিতে। ৮টি আসন দেওয়া হবে বিকল্পধারা ভোটে গেলে। প্রয়োজনে আসন বাড়তে পারে বিএনপির সংস্কারপন্থি সাবেক এমপিদের আনতে পারলে। সরকার বিকল্পধারাকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দেখতে চায়। আড়াই ঘণ্টা বৈঠক শেষে দুজন বের হলেন। ইব্রাহিম ও আমার দিকে তাকিয়ে আমাদের সেই বন্ধু জানালেন, মাহী চৌধুরীর সঙ্গে সংলাপের ফলাফল শূন্য। মাহী আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বিকল্পধারা ভোটে গেল না। বিরোধিতা করল ভোটের। পরোক্ষভাবে থাকল বিএনপির আন্দোলনের পক্ষে।

সংলাপের নানারকম ইতিহাস আছে। সেদিন দেখা হলো জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে। তিনি বললেন, সংলাপে কী হবে? যাচ্ছি চা খেতে। পরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলে নেব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। স্পষ্ট কথা শুনে ভালোই লাগল। দেশে এখন সংলাপের রাজনীতি চলছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই এই সংলাপ। সংলাপের রাজনীতিকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। রাজনীতিতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন থেকে আমাদের রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি চলছে। রাজনীতিবিদদের মাঝে রয়েছে দূরত্ব। কেউ কারও সামাজিক অনুষ্ঠানে যান না। এমনকি বিয়েশাদি, জম্ম  দিন, নাতির সুন্নতে খতনা, মারা যাওয়ার পর জানাজা অনুষ্ঠানেও যোগ দেন না। বিভাজনের রাজনীতি আমাদের গ্রাস করে নিয়েছে। সমস্যা সংকট বেড়েছে পদে পদে। ক্ষমতার রাজনীতি দূরত্ব বাড়িয়েছে পরস্পরের। এ অবস্থার উন্নতি দরকার জাতীয় স্বার্থেই। আমরা ইতিবাচক একটি রাজনীতি দেখতে চাই। নির্বাচনের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে চাই। নির্বাচন হবে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। এখানে দূরত্ব রেখে সম্ভব নয়। কারণ ভোটের মাঠে শান্তি স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার জায়গাটুকু হলো নিজের ভোট দেওয়ার অধিকার। এ অধিকার ধরে রাখতেই দরকার আলাপ-আলোচনার। আর আলোচনার বাইরে কিছু থাকলে তা হলো সহিংস্রতা। আমরা সেই পরিবেশ আর দেখতে চাই না। পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি পরিবেশ চাই। ভোটের অনুকূলে পরিবেশ চাই। আর এ কারণেই দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর খোলামেলা কথা বলার। মিডিয়া তার দায়িত্ব পালন করবে। এখানে উদারনীতি মনোভাব ও পরিবেশ তৈরি না হলেই সমস্যা।

এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের একটি উক্তি রয়েছে। জেফারসন বলেছেন, ‘জনগণের ইচ্ছাই যে কোনো সরকারের একমাত্র বৈধ ভিত্তি, আর আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করা।’ সেই জায়গাটুকু সবাই ভুলে যান। এ কারণে বিএনপির শাসনকালে সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্লেট চুরির মামলা হয়। আর আওয়ামী লীগের সময় এহছানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ভ্যানিটি ব্যাগ ও মাটি চুরি আর জাফরুল্ল­াহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে হয় মাছ চুরির মামলা। বিএনপির আমলে সোহেল তাজের মতো ভদ্রলোককে রাজপথে পেটায় পুলিশ। এই রাজনীতি কেউই আর দেখতে চায় না। আলাপে-সংলাপে রাজনীতির               স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক। কথা না বলে থাকার কোনো মানে হয় না।   

            লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর