রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

খাশোগি হত্যাকান্ড : সভ্যতার আবরণে অস্ত্র ব্যবসার স্বরূপ

তুষার কণা খোন্দকার

খাশোগি হত্যাকান্ড : সভ্যতার আবরণে অস্ত্র ব্যবসার স্বরূপ

এ বছর অক্টোবর মাসজুড়ে বিশ্বের সবকটি গণমাধ্যমে সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে। জামাল খাশোগি সাদামাটা সামান্য সাংবাদিক ছিলেন না। সৌদি আরবে কোনো সাধারণ মাপের সাংবাদিক রাজপরিবারের মনোপুত নয় এমন খবর প্রকাশের দুঃসাহস দেখাতে পারে না। তারা সবাই জানে, সৌদি রাজপরিবার যার ওপর নাখোশ হয় তাকে হয় প্রকাশ্যে হত্যা করে কিংবা গোপনে গায়েব করে ফেলে। মুশকিল বেধেছে, জামাল খাশোগির পারিবারিক পরিচয় এবং কর্মজীবন দুটির কোনোটিই ফেলনা নয়। খাশোগিরা কয়েক প্রজম্ম  সৌদি রাজপরিবারের যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ধনী পরিবার বলে আমেরিকা এবং ইউরোপেও তাদের বিশেষ কদর আছে। জামাল খাশোগির জম্ম  সৌদি আরবের মদিনা শহরে। উনার দাদা মোহাম্মদ খাশোগি পেশায় ডাক্তার ছিলেন। খাশোগিদের আদি নিবাস তুরস্ক। একজন আরবীয় মহিলাকে বিয়ে করে মোহাম্মদ খাশোগি সৌদি আরবের বাসিন্দা হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠার পরে ডা. মোহাম্মদ খাশোগি বাদশাহ ইবনে সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। জামাল খাশোগি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের কাছে অপরিচিত হলেও আদনান খাশোগির কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। জামাল খাশোগির চাচা সৌদি আরবের ধনাঢ্য অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগি আশির দশকে ইরান-কন্ট্রা অস্ত্র কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আশির দশকে জামাল খাশোগির চাচা আদনান খাশোগির সম্পদের পরিমাণ সাড়ে চার বিলিয়ন বলে পত্রপত্রিকায় উল্লে­খ করা হতো। সে সময় পত্রিকার পাতায় ইরান-কন্ট্রা অস্ত্র কেলেঙ্কারির খবর ফলাও করে ছাপা হতো। আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনালড রিগান ইরানের ওপর অস্ত্র বিক্রির নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। সে অবস্থায় আরবের অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাসোগির মধ্যস্থতায় ইসরাইল আমেরিকা থেকে অস্ত্র আমদানি করে ইরানে পাঠানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। অস্ত্র ব্যবসা থেকে পাওয়া অর্থের এক অংশ গিয়েছিল নিকারাগুয়ায় কন্ট্রা বিদ্রোহীদের কাছে। আমেরিকার সরাসরি মদদে সে সময় নিকারাগুয়ায় কন্ট্রা বিদ্রোহীরা সে দেশের বৈধ স্যান্ডানিস্টা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মত্ত ছিল। সেই কারণে আমেরিকার ইতিহাসে এই কেলেঙ্কারির নাম ইরান-কন্ট্রা অস্ত্র কেলেঙ্কারি। জামাল খাশোগির পরিবারের আরও সদস্যকে আমরা নানা ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে চিনি। ব্রিটেনের রাজপরিবারের প্রিন্স চার্লসের প্রথম স্ত্রী লেডি ডায়ানার প্রেমিক ডোডি ফায়েদ ছিলেন জামাল খাশোগির চাচাতো ভাই। প্যারিসে সড়ক দুর্ঘটনায় উনারা দুজন একসঙ্গে মারা গেছেন। 

 

জামাল খাশোগির ছাত্রজীবন আমেরিকায় কেটেছে। ছাত্রজীবন শেষে তিনি নিজ দেশ সৌদি আরবে ফিরে গিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এক সময় তিনি সৌদি আরবের গোয়েন্দা দফতরের পদস্থ কর্মকর্তার চাকরিও করেছেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন এবং ওসামা বিন লাদেনের উত্থান নিয়ে তিনি এক সময় প্রচুর রিপোর্ট লিখেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার করতে শুরু করলে সৌদি কর্তৃপক্ষ জামাল খাশোগির ওপর নাখোশ হয়ে ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। ওখানে খাশোগি ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখতেন। সৌদি আরব নাখোশ হতে পারে এমন বিষয় এড়িয়ে গিয়ে তিনি যদি আলাভোলা নানান কথা লিখে ওয়াশিংটন পোস্টের পাতা ভরে ফেলতেন তাহলে সৌদি বাদশাহদের মতো প্রায় শতায়ু হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুর সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু সেটি না করে তিনি সৌদি আরবের মহাক্ষমতাধর প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজ্য পরিচালনার নীতির সমালোচনা করতে শুরু করেছিলেন। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা করার মানে মাথার ওপর আজরাইলের ছায়া ঘনিয়ে আনা এটি জামাল খাশোগির অজানা ছিল না। কিন্তু তবুও তিনি সাহসের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিলেন। জামাল খাশোগি রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াননি কিংবা তিনি সমাজ সংস্কারক ছিলেন না। জামাল খাশোগি সৌদি আরবকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন এমন ভাবার কোনো কারণ দেখি না। তিনি তার লেখায় সৌদি আরবের সমাজ ব্যবস্থা কিংবা শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করেননি। তিনি সমালোচনা করেছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের যিনি ও দেশের প্রভাবশালী ধনীদের একের পর এক বন্দী করে হোটেলে আটকে রেখে টাকা আদায় করেছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বারবার খবর প্রচারিত হয়েছে। বংশানুক্রমে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত একটি পরিবারের সন্তান হয়ে তিনি কী ভরসায় ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনায় এত সোচ্চার হলেন সেটি একটি প্রশ্ন।

আমার ধারণা, জামাল খাশোগি পশ্চিমা দুনিয়ার গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের গল্প-গাঁথায় বিশ্বাস করেছিলেন। খাশোগির বিশ্বাস বোধহয় তার কাল হয়েছিল। পশ্চিমা সভ্যতার ওপর বিশ্বাস রাখতে গিয়ে তিনি ধোঁকা খেয়ে বেঘোরে প্রাণ হারালেন। তিনি ভেবেছিলেন, ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাশোগির গায়ে হাত তুলতে সৌদি আরব দশবার চিন্তা করবে। জামাল খাশোগিকে হত্যা কিংবা গুম করলে মানবতার ধারক বাহক, গণতন্ত্রের ঝা-াবাহী আমেরিকা এবং তার ইউরোপীয় দোসররা সৌদি আরবকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। এই ভয়ে সৌদি আরব জামাল খাশোগির জানের ওপর হাত দেবে না। আহারে আফসোস! জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড নিয়ে দুনিয়ার মঞ্চে কী ভয়ানক ভন্ডামির নাটক মঞ্চস্থ হলো দুনিয়াবাসী সেটি দিব্যি দেখতে পেল। জামাল খাশোগি মারা গিয়ে সেটি দেখার সুখ থেকে বঞ্চিত হলেন।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনাব ট্রাম্প পেশাদার পলিটিশিয়ান নন। কাজেই তিনি কথামালার কচকচির ঝামেলায় না গিয়ে প্রথম দিন খবরটা শুনে সোজাসাপটা বলে বসলেন, জামাল খাশোগি আমেরিকার নাগরিক নয়। কাজেই আমেরিকা একজন সৌদি নাগরিকের হত্যাকান্ড নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াবে কেন? বড় কথা, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স আমেরিকার জানি বন্ধু। তার নেতৃত্বে সৌদি আরব আমেরিকার কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে। এই সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার মূূল্যের অস্ত্র বেচতে পারলে আমেরিকার সরকার, আমেরিকার প্রাইভেট সেক্টর এবং আমেরিকার আপামর জনসাধারণ বেসুমার লাভবান হবে। এর ফলে আমেরিকায় লক্ষাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা এমন সুযোগ হাতছাড়া করব কেন? তিনি বলেছেন, জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড নিয়ে আমেরিকা সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করলে রাশিয়া, চীন কিংবা ইউরোপ ওদেশে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ লুফে নেবে। ট্রাম্পের এমন সরব ঘোষণায় আমি কোনো দোষ দেখি না। নির্বাচনের আগেই  ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকা ফার্সট। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে তিনি নতুন কিছু বলবেন কেন! ট্রাম্পের জায়গায় রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাট কোনো পেশাদার পলিটিশিয়ান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বসা থাকলে সে তার কথাগুলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি গুরুগম্ভীর শব্দের ভিয়েনে চুবিয়ে রসালো করে দুনিয়াকে ক্রমাগত খাওয়াতে থাকত। আদতে অস্ত্র বিক্রির কাজটি বেশ চুপিসারে সেরে ফেলতে যতদিন সময় দরকার ততদিন পর্যন্ত নিত্যনতুন টালবাহানা করে জামাল খাশোগির হত্যাকা- তদন্ত করে দেখার অভিনয় করত। আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা কত বেশি মানবদরদি সেই খবর গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার হতে থাকত। আসলে জামাল খাশোগির হত্যাকা- নিয়ে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা এখন যা করছে কোনো পেশাদার রাজনীতিক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বসা থাকলে তখনো একই ঘটনা ঘটত। পেশাদার রাজনীতিক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার পদ্ধতি ভিন্ন হতো।

জামাল খাশোগির হত্যাকা- আরেকটি কারণে দুনিয়ার নজর কেড়েছে। কোনো দেশের দূতাবাস যে ভয়ঙ্কর নরহত্যার জায়গা হতে পারে এমনটি দুনিয়াবাসী স্বাভাবিক বলে ধারণা করে না। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি তা নয় তবে এটি খুবই বিরল। বিশেষ করে দূতাবাসের ভিতরে এমন পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকান্ড কূটনৈতিক স্থাপনার স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে কূটনৈতিক স্থাপনার স্বাধীনতা একটি স্বীকৃত সত্য। সৌদি আরব তার ইস্তাম্বুল দূতাবাসের ভিতরে একজন মানুষকে হত্যা করে আন্তর্জাতিক রীতির গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। অক্টোবর মাসের ২ তারিখে সৌদি গোয়েন্দা বাহিনীর ১৫ সদস্য সৌদি দূতাবাসে জামাল খাশোগিকে যখন হত্যা করছিল তখন সৌদি রাষ্ট্রদূত তাদের দূতাবাসের ভিতরে কাজটি করতে নিষেধ করেছিলেন। জবাবে খুনিরা বলেছে ‘ইউ শাট ইউর বিগ মাউথ’ যার রেকর্ড তুরস্কের হাতে আছে। রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে কোনো কাজ হয়নি কারণ যারা এই হত্যাকা- ঘটাচ্ছিল তারা রাষ্ট্রদূতের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী।

পেট্রোডলার খরচ করে সৌদি আরব আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে সেই অস্ত্র দিয়ে ইয়েমেনে নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে খাদ্যের অভাবে শিশুরা এখন জীবন্ত কঙ্কাল। কয়েক মাস আগে সৌদি আরবের বোমার আঘাতে স্কুলগামী বাস পুড়ে গেলে তাতে ৪০ শিশু জীবন্ত পুড়ে মারা গেছে। এসব নৃশংস ঘটনা আমেরিকা কিংবা ইউরোপের সৌদি নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। আমেরিকা এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এসব শব্দ কত মূল্যহীন সেটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়ের দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়। জামাল খাশোগির মৃত্যু নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ভন্ডামি নতুন কিছু নয়। সৌদি আরবের পকেটে যতক্ষণ পেট্রোডলার আছে আমেরিকা এবং ইউরোপ ততক্ষণ সৌদি আরবের সঙ্গে মাখামাখি করতেই থাকবে। জামাল খাশোগি মরে গিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার মানবতার স্বরূপ বিশ্ববাসীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল।

জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড এবং হত্যা-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা দুনিয়ার ভূমিকা থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের একটি জরুরি বিষয় শেখার আছে। আমাদের দেশের যেসব রাজনীতিক রাজনৈতিক সংকটের সময় দেশবাসীর মতামতকে পায়ে ঠেলে পশ্চিমা প্রভুদের মতামতের মুখ চেয়ে থাকেন তাদের জন্য এটি একটি সাবধান বাণী। সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনের তারিখ যত ঘনিয়ে আসবে রাজনীতির আঙিনায় পশ্চিমা প্রভুদের দাপাদাপি তত বাড়তে থাকবে। পশ্চিমা প্রভুরা যেচে পড়ে আমাদের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য হরেক পদের প্রেসক্রিপশন লিখতে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, দেশে কোনো সংকট সৃষ্টি হলে আপনারা স্বাধীনভাবে আপনাদের সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনো বিদেশি প্রেসক্রিপশন বিশ্বাস করলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির মতো ধোঁকা খেয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর