সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইলেকশনের রসায়ন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বৃত্তান্ত

গোলাম মাওলা রনি

ইলেকশনের রসায়ন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বৃত্তান্ত

সম্প্রতি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যারা কি না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অনেক ভালোবাসেন। তাদের সঙ্গে চা-চক্রে বসে দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলাম একাদশ সংসদ নির্বাচনের খুঁটিনাটি বিষয়াদি নিয়ে। কর্মকর্তারা সরকারের প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ এবং অন্তঃপ্রাণ। তারা ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা এবং মাঠপর্যায়ের হালহকিকত সম্পর্কে অনেকটা নির্ভুলভাবেই অবগত রয়েছেন। প্রতিটি সংসদীয় আসনের চালচিত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অবস্থান, ভোটার সংখ্যা এবং ভোটারদের মন-মানসিকতা সম্পর্কে তাদের বেশ পটু বলেই মনে হলো। তারা সবাই আগামী নির্বাচনে সরকারকে সাহায্য করতে চান। কিন্তু কীভাবে সেটা সবার জন্য মঙ্গলজনক এবং কার্যকর হতে পারে তা নিয়ে তারা বহুজনের সঙ্গে বহুবার পরামর্শ করেছেন। বিভিন্ন দলের ঝানু ঝানু রজনীতিবিদ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক প্রভৃতি শ্রেণিপেশার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তারা আরও কনফিউজড হয়ে গিয়েছেন। কারণ কেউই তাদের প্রকৃত ঘটনা বুঝাতে পারছিলেন না বা তারা বুঝতে পারছিলেন না।

আমার সঙ্গে যখন কর্মকর্তাদের বৈঠক হলো তখন আমি প্রথমেই তাদের যাবতীয় কথাবার্তা শুনে নিলাম। তাদের প্রশ্ন, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা এবং পরিকল্পনার ব্যাপারে যথাসম্ভব জানতে চেষ্টা করলাম। আলোচনার একপর্যায়ে আমি যখন প্রশ্ন করলাম যে, তারা এযাবৎকালে কয়টি সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, ভোট গণনা করছেন অথবা গণনা দৃশ্য দাঁড়িয়ে থেকে অবলম্বন করেছেন! তারা কি ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি, ভোটের দিনের সার্বিক পরিস্থিতি, ভোটকেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পদ্ধতি এবং উপজেলা পর্যায়ে ভোটের ফলাফল ঘোষণার পদ্ধতি সরজমিন দেখেছেন কিনা? আমার প্রশ্ন শুনে তাদের চোখ কপালে উঠল এবং অনেকটা বিব্রত হয়ে জবাব দিলেন যে, কোনো ব্যাপারেই তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই তবে কর্মজীবনে তারা বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করেছেন বটে কিন্তু ভোটের মাঠের নির্বাচনপূর্ব বাস্তব অবস্থা, ভোটের দিনের ঘটনা, ফলাফল ঘোষণা, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রার্থী ও প্রতীকের প্রভাব নিয়ে সমন্বিতভাবে কোনো কাজ তো দূরের কথা চিন্তাও করেননি। কারণ সঠিকভাবে চিন্তা করার জন্য যে তথ্যউপাত্ত, অভিজ্ঞতা এবং চাহিদাপত্র দরকার তা তাদের কোনোকালেই হয়ে ওঠেনি।

আমি কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা ও বুদ্ধিমত্তা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। তাদের বেশ দক্ষ, মেধাবী এবং কৌশলী বলেই মনে হলো। তারা তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আনুকূল্য এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কীভাবে ভোটের মাঠে কার্যকর হতে পারে তা নিয়েই মূলত চিন্তাভাবনা করছিলেন। আমার দৃষ্টিকোণ, মতামত এবং সুপারিশকে আমি উপদেশ আকারে না দিয়ে বরং আমি আমার নির্বাচনী এলাকার বাস্তব চিত্রটি এমনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম যেখান থেকে বুদ্ধিমান কর্মকর্তারা তাদের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। একটি সংসদ নির্বাচনে সাধারণত প্রতীক এবং প্রার্থীর প্রভাব থাকে ফিফটি ফিফটি। অর্থাৎ কোনো এলাকায় কোনো রাজনৈতিক দলের যদি পর্যাপ্ত জনপ্রিয়তা না থাকে এবং সেখানকার তৃণমূলে সংগঠন এবং সুদক্ষ কর্মী বাহিনী না থাকে তা হলে দক্ষ-অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় প্রার্থীরাও ভোটের মাঠে ফেল করেন। অন্যদিকে প্রার্থী যদি যোগ্য না হন বিশেষ করে তিনি যদি চলতি সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং চরিত্রহীনতার বদনামিতে কুখ্যাতি অর্জন করেন তবে দলের শতভাগ জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও সেই প্রার্থী ফেল করে বসেন।

উপরোক্ত অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত প্রথমেই তাদের দলীয় সংসদ সদস্যদের কুকর্ম ও সুকর্মের খতিয়ানগুলো নির্ভুলভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এক্ষেত্রে কোনো ভুল হলে সেটা কাটিয়ে ওঠা একেবারেই অসম্ভব। একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাঠে ভোটাররা খুবই অপমাণবোধ করেন দুটো কারণে। প্রথমত, তারা যাকে ঘৃণা করেন অপছন্দ করেন এবং নেতা হিসেবে মেনে নিতে অস্বস্তিবোধ করেন এমন কাউকে দলীয় প্রতীক দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দিলে। দ্বিতীয়ত, কোনো জনপ্রিয় এবং গণমুখী প্রার্থীকে যদি দল মনোনয়ন না দেয় তবে কর্মী-সমর্থকদের একটি বিরাট অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন এবং জিদ করে প্রতিপক্ষের প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেন। প্রার্থী নির্বাচন করার আগে ভোটারদের মন-মানসিকতা, শ্রেণি, পেশা, বয়স এবং জেন্ডার বা লিঙ্গ বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। শিক্ষিত লোকেরা সব সময় শিক্ষিত ও মার্জিত প্রার্থী পছন্দ করেন। তরুণ ভোটাররা সব সময় অপেক্ষাকৃত তরুণ অথবা তারুণ্যে ভরপুর প্রার্থী খোঁজেন। নারীরা সুদর্শন প্রার্থীকে ভোট দেন এবং বয়স্ক ও ধর্মপ্রাণ নরনারীরা নম্র-ভদ্র ও ধার্মিক প্রার্থীকে সমর্থন করেন। চরিত্রহীন, মদ্যপ ও লম্পট প্রার্থীরা সাধারণ নারী ভোট আকৃষ্ট করতে পারেন না। এ অবস্থার কারণে প্রতিটি সংসদীয় আসনে প্রতিটি নির্বাচনের সময় ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচনী রসায়ন সৃষ্টি হয়।

ভোটাররা সাধারণত উদার, মুক্তহস্তে খরচ ও দান-খয়রাতে অভ্যস্ত প্রার্থী খোঁজেন। নম্র ও ভদ্র, কর্কশ শক্ত ব্যবহার করেন না এবং ভালো পারিবারিক ঐতিহ্য ধারণ করেন এসব প্রার্থীকে সবাই লুফে নেন। প্রার্থী নিজে যদি মন্দ স্বভাবের লোক হন এবং তার নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যদি গণ অসন্তোষ থাকে তবে তাকে নিয়ে কোনো দল ভোটযুদ্ধে গেলে নিশ্চিতভাবে পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হবে। নির্বাচনের মাঠে জাতীয় উন্নয়ন সাধারণত ফ্যাক্টর হয় না। ভোটাররা সব সময় স্থানীয় উন্নয়নের দিকে নজর দেন। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন সরকারের ভালো কাজগুলোর কথা নির্বাচনের মাঠে কেউ শুনতে চান না। তারা সরকারের মন্দ কাজ, গুজব এবং কুৎসা শুনতে বেশি পছন্দ করেন। ফলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দিতে আসার জন্য ভালো কর্ম, উন্নয়ন, সুনাম-সুখ্যাতির চেয়ে মন্দকর্ম, বদনামি, গুজব ইত্যাদির ব্যাপারে অধিক যতœশীল ও সতর্ক হতে হবে। তা না হলে ফলাফল বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব।

আমার উপরোক্ত কথাগুলো শোনার পর কর্মকর্তারা সহাস্যে বললেন, ওগুলো তো কমন নীতিকথা সবাই জানেন। আমরা জানতে চাই ভোটের ফলাফল কীভাবে অনুকূলে রাখা যায় বা আনা যায়। আমি তাদের কথাগুলোর মমার্থ বুঝলাম এবং এ ব্যাপারে আমার মতামত জানাতে গিয়ে বললাম যে, যদি কোথাও সত্যিকার অর্থে ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়, ভোটাররা উপস্থিত হন এবং ভোট প্রদান করে সেখানে ভোটের ফলাফল পাল্টানো সম্ভব নয়। উদাহরণ দিতে গিয়ে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা বললাম। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণীরা যখন বুঝলেন যে, তাদের জন্য চরম বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর এবং অপমানজনক একজন প্রার্থী দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ভোটে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত হতে যাচ্ছেন তখন তারা সর্বোচ্চ দলীয় শক্তি, কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর আনুকূল্য নিয়েও বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গণমত চাপা দিতে পারলেন না। পরবর্তীতে যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তখন নজিরবিহীনভাবে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি এবং বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্মিলিতভাবে তৎপরতা দেখিয়েও ভোটের ফলাফল পাল্টে দিতে পারেনি। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপের সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে।

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাধারণ প্রশ্ন সহজেই এসে যায় আর তা হলো দেশে দেশে ভোট র‌্যাগিং ব্যালট ছিনতাই, ফলাফল পাল্টে দেওয়া অথবা বিনা ভোটের নির্বাচন, ছলচাতুরীর নির্বাচন, ইভিএম পদ্ধতির মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি ইত্যাদির যে কাহিনীগুলো রচিত হয় তা আসলে কীভাবে ঘটে! অনেকে আবার আমাদের দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় হাঁ-না ভোট, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের জাতীয় নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ কুখ্যাত মাগুরা ও তেজগাঁও সংসদ উপনির্বাচনের জাল-জালিয়াতি, ভোট চুরি এবং ফল জালিয়াতির তেলেসমাতির কাহিনীর উদাহরণ টেনে বলেন- ওগুলো তাহলে কীভাবে হলো অথবা আগামী দিনে ওগুলো যে হবে না তা বুঝব কী করে? অথবা আগামীতে একইভাবে একই কর্ম সাধন লাভের মন্ত্রগুলো কী? এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে আমাদের উচিত উল্লি­খিত উপাখ্যানগুলোর অন্তর্নিহিত সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সমীকরণ তুলে ধরা। প্রথমত, যখন ঘটনাগুলো ঘটেছিল তখন ক্ষমতাসীনরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং তারা চেয়েছিলেন যে, তাদের ইচ্ছেমতো পছন্দের প্রার্থীকে পাস করিয়ে আনবেন। তারা গণতন্ত্রের ‘গ’ এবং বিরোধী দলের ‘ব’ অক্ষরগুলোকে বরদাশত করতে চাচ্ছিলেন না বা বাধ্য ছিলেন না। তারা জনগণকে তাদের খেলনা পুতুল অথবা হুকুমের চাকর মনে করতে পেরেছিলেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতা যে তাদের একান্ত নিজস্ব এখতিয়ার তা তারা বিশ্বাস করে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর আস্থাশীল হতে পেরেছিলেন এবং জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বোপরি তারা দেশি-বিদেশি কৌশলগত শক্তিসমূহের সাহায্য, সহযোগিতা নিশ্চিত করেছিলেন অনেক কিছু বিনিময়ে।   এ ছাড়া সময় ও সুযোগ এবং পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে ছিল।

জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যদি ইচ্ছেমাফিক করার খায়েশ থাকে তবে প্রথমেই দরকার পড়বে একটি কর্তৃত্ববাদী এবং তাঁবেদারি মনোভাবসম্পন্ন শাসকগোষ্ঠীর। তাদের প্রথম কাজ হবে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে দেওয়া। বিরোধী রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, সিভিল সোসাইটি, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের মধ্যে ভয়ভীতি, আতঙ্ক, সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি করা। তাদের আত্মবিশ্বাস, আভিজাত্য, আত্মাভিমান, গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনগত অধিকার ভেঙেচুরে খান খান করে ধুলায় মিশিয়ে দিতে হবে। মানুষের বিশ্বাস বোধ, কর্ম উদ্যোগ, সৃজনশীলতা, বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ করার ক্ষমতার ওপর জুলুম, অত্যাচার, সন্ত্রাস, অবিচার-অনাচার এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বড় বড় জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিতে হবে। জনগণ যখন মনে করবে যে, তাদের পালাবার কোনো পথ নেই ভাগবার কোনো জায়গা নেই এবং আশ্রয়স্থলও নেই তখন তারা শাসকের সব কুকর্মকে সুকর্মরূপে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় কোনো নির্বাচন হলে সেখানে জনগণ থাকে না। অথবা গেলেও তারা যাবে শাসককুলের ইচ্ছা পূরণের রাবার স্ট্যাম্প অথবা হাতিয়ার রূপে। এসব ক্ষেত্রে ভোটার, ব্যালট, ভোটকেন্দ্র এবং ফলাফলের মধ্যে কোনো সমন্বয় বা আন্তসংযোগ থাকে না। ফলে ভোটার না হলেও শতভাগ উপস্থিতি দেখানো যায় যে স্থান থেকে ইচ্ছা অর্থাৎ ভোট কেন্দ্র, উপজেলা নির্বাচন অফিস অথবা রাজধানী থেকে পছন্দমাফিক পূর্ব নির্ধারিত ফলাফল বিনাবাধায় ঘোষণা করা যায়।

উল্লি­খিত অবস্থার ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশের তিনশটি সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে গড়ে পাঁচশ করে ভোট কেন্দ্র রয়েছে। এই হিসাবে সারা দেশে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ পঞ্চাশ হাজার। প্রতিটি কেন্দ্রে যদি গড়ে পাঁচশ করে ভোটের কক্ষ বা বুথ থাকে তবে মোট বুথের সংখ্যা হবে সাড়ে সাত লাখ। প্রতিটি কেন্দ্রে গড়ে পাঁচ হাজার ভোটার ভোট দেন এবং সেই ভোট গ্রহণ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এবং গণনার জন্য প্রতি কেন্দ্রে প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের একেকজনের কমপক্ষে পঁচিশ-ত্রিশজন এজেন্ট এবং কর্মী উপস্থিত থাকেন সার্বক্ষণিকভাবে। অন্যদিকে পুলিশ থাকেন দু-তিনজন। আনসার, চকিদার, দফাদার থাকেন পাঁচ-ছয়জন এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকেন দশ-বারোজন যাদের বেশিরভাগই স্থানীয় পর্যায়ের স্কুল শিক্ষক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী।

ভোটের দিন সকাল থেকে রাত অবধি প্রতিটি ভোট কেন্দ্র একেকটি স্বতন্ত্র জীবন্ত আগ্নেয়গিরির রূপ লাভ করে। একটি ভোট কেন্দ্রের সঙ্গে আরেকটি ভোট কেন্দ্রের কোনো যোগাযোগ থাকে না। তবে কোনো ভোট কেন্দ্রে গন্ডগোল হলে তা মুহূর্তের মধ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রাম-শহর, ভোট কেন্দ্র, জনপদ ও ঘরবাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। সকাল থেকে বিকাল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোটাররা সারিবদ্ধভাবে ভোট দেয় এবং বিকাল থেকে তারা দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সংশ্লি­ষ্ট কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল শোনার জন্য। কোনো কেন্দ্রে যদি পাঁচ হাজার ভোটার হয় তবে বিকাল বেলা ছেলে-বুড়ো মিলে প্রায় সমসংখ্যক লোক ভোট কেন্দ্রে গিজ গিজ করতে থাকে সেখানে পান থেকে সামান্য চুন খসলে দাঙ্গা ফ্যাসাদ মারামারি শুরু হয়ে যায়। ভোট গ্রহণ শেষ হলে প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার এবং প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টদের যৌথ তদারকিতে প্রকাশ্যে ভোট গণণা শুরু হয়। বাইরে হাজারো মানুষের কোলাহল এবং ভিতরে পরস্পর বিরোধী প্রার্থীদের এজেন্টদের তৎপরতা এবং বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থকদের মারমার কাটকাট রব উপস্থিত নির্বাচন কর্মকর্তাদের পরিস্থিতির কাছে সম্পূর্ণভাবে অসহায় করে তুলে।

ফলে তারা ইচ্ছে করলেও শক্তিশালী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেন না। প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে একটি রেজাল্ট শিট স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তা স্থানীয়ভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়। এরপর ডাকযোগে একটি কপি নির্বাচন কমিশন অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি কপি উপজেলা নির্বাচন অফিসে প্রেরণ করা হয় এবং এজেন্টদের কাছে রেজাল্ট শিটের কপি থাকে। নির্বাচনী কেন্দ্রে যেমন সারা দিন বহু পক্ষের উৎসুক ও উত্তেজিত জনতা ভিড় করে থাকেন তদ্রুপ বিকাল থেকে উপজেলা নির্বাচনে কর্মরত প্রধান নির্বাচনকর্তা যথা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ভিড় করতে থাকে। কখনো কখনো এই ভিড়ে দশ-বারো হাজার থেকে শুরু করে লক্ষাধিক লোকের সমাগম পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র থেকে আসা ভোটের ফলাফল শুনে এবং একটির সঙ্গে অপরটির যোগ করে সংশ্লিøষ্ট উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট ভোটের সমীকরণ করতে থাকে। সব কেন্দ্রের ফলাফল পাওয়ার পর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সব প্রার্থীর এজেন্টদের উপস্থিতিতে রেজাল্ট শিট তৈরি করেন এবং ফলাফল ঘোষণা করে তা জেলা নির্বাচন অফিসে প্রেরণ করেন যেখান থেকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী প্রার্থী এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

আমাদের দেশে প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার উল্লি­খিত আচার-অনুষ্ঠান যদি একবার জমে ওঠে তাহলে তা ব্যাহত করার সাধ্য কারও নেই। একটি জাতীয় নির্বাচনে বা পরপর কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ার পরও কোনো অনিয়ম এদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় স্থায়ী কলঙ্ক হিসেবে পরবর্তী নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। উল্টো পরবর্তীতে যখনই সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ আসে তখনই অনিয়মের জায়গার নিয়ম, অশান্তির স্থলে শান্তি এবং বেদনার স্থলে আনন্দ জায়গা করে নেয়। নির্বাচনের এক মাস আগে থেকেই পুরো নির্বাচনী মাঠ গরম হয়ে ওঠে। চারদিকে উৎসবের আমেজ, প্রার্থীদের তৎপরতার নানা উত্তেজনাকর কর্মকা-, ক্ষেত্রবিশেষে মারামারি, বিচার শালিস ইত্যাদির কারণে পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, কেউ সিল পেটানো, ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ইচ্ছামতো ফলাফল নিজের পক্ষে ঘোষণা ইত্যাদি অপতৎপরতার কথা কল্পনাও করতে পারে না। পৃথিবীর সব যুদ্ধ কিংবা সব প্রতিযোগিতার মধ্যে নির্বাচনী মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো সবচেয়ে রূঢ়, সবচেয়ে কঠিন এবং সবচেয়ে নির্মম যেখানে পিতা-মাতাকে ছাড় দেয় না পুত্র-কন্যারা। স্ত্রী ভুলে যায় স্বামীকে আর স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বী যদি স্ত্রী হয় তাহলে তো কথাই নেই পুরো পরিস্থিতি হাশরের ময়দানের মতো হয়ে যায় অর্থাৎ কেউ কাউকে চেনে না।

আমি উল্লি­খিত বিষয়সমূহের সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং আমার নির্বাচনী এলাকার চালচিত্র যখন কর্মকর্তাদের বলছিলাম তখন তারা অত্যন্ত মনোযোগসহকারে আমার কথা শুনছিলেন। কিন্তু সব কথা শোনার পর কেন যেন তাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তাদের কপালে অস্বস্তির বলিরেখা স্পষ্ট হলো। তাদের কেউ কেউ অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন উফ্! এই যদি অবস্থা হয় তাহলে শেষমেশ কী হবে তা তো কেউই আগ বাড়িয়ে বলতে পারবেন না।

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর