সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কী ঘটছে ভারতে?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

কী ঘটছে ভারতে?

রাফায়েল পাকে ডোবার ভয়েই মাঝরাতে তড়িঘড়ি ভারতের অন্যতম তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে কব্জা করার চেষ্টা শুরু করল নরেন্দ্র মোদির সরকার। সিবিআই খুব শিগগিরই রাফায়েল দুর্নীতির তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছিল। সংস্থার ডিরেক্টর অলোক বর্মা তার প্রাথমিক কাজকর্মও শুরু করে দিয়েছিলেন। সে কারণেই রাফায়েল আতঙ্কে কম্পমান মোদি সরকার আর কালবিলম্ব না করেই মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঠিক সার্জিকাল স্ট্রাইকের ধাঁচে অভিযান চালিয়ে সিবিআইর খোলনলচে বদলে ফেলেছে। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অধিকর্তা অলোক বর্মা এবং তার সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়া স্পেশাল ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানাকে। তাদের দুজনকেই বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বদলি করা হয়েছে অলোক ঘনিষ্ঠ অফিসারদেরও।

ভোরের আলো ফোটার আগেই নতুন ডিরেক্টর হিসেবে বসানো হয়েছে যুগ্ম অধিকর্তা এম নাগেশ্বর রাওকে।  সংশ্লি­ষ্ট মহল মনে করছে, রাফায়েল দুর্নীতি নিয়ে সক্রিয় হওয়ার জন্যই তড়িঘড়ি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অলোক বর্মাকে। সম্প্রতি রাফায়েল চুক্তি নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। রাফায়েল আতঙ্ক এতটাই গ্রাস করেছে মোদি সরকারকে যে, সিবিআই প্রধানকে সরাতে সংবিধান ও আইনকানুনেরও তোয়াক্কা করেনি প্রধানমন্ত্রীর দফতর। লোকপাল আইন অনুযায়ী সিবিআই প্রধানকে নিয়োগ, বদলি বা বরখাস্ত করতে হলে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সম্মতি প্রয়োজন। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টও রাজনৈতিক চাপ থেকে সিবিআইকে রক্ষাকবচ দিতে সংস্থার প্রধানের কাজের মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু এসবের কোনো কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সিবিআইর শীর্ষ কর্তাদের। মধ্যরাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এই তৎপরতার কথা জানতে পারেনি কাকপক্ষীও।

অলোক বর্মা তাকে অপসারণের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর বেঞ্চে আবেদন করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, রাতারাতি তাকে সরানোর সিদ্ধান্ত সিবিআইয়ের ওপর রাজনৈতিক            হস্তক্ষেপের শামিল। উচ্চ পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থার কোনো কোনো তদন্ত সরকারের বাঞ্ছিত পথে নাও যেতে পারে। সেই আশঙ্কায়ই সিবিআইর ডিটেক্টরকে সরানো হয়েছে বলে শীর্ষ আদালতে জানিয়েছেন অলোক বর্মার আইনজীবী। উল্লে­খ্য, সিবিআই প্রধানের পদটি সাংবিধানিক পদ। সেখানে নিয়োগ বা বরখাস্ত হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে করা যায় না। তবে নরেন্দ্র মোদি সরকার সে সবের তোয়াক্কাই করেনি। মঙ্গলবার মাঝরাতের এই অপারেশনে সিবিআইয়ের দুই সেনাপতিকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বদলি করা হয়েছে ১৩ জন অফিসারকে। তাদের মধ্যে একজনকে পাঠানো হয়েছে আন্দামানে। সিবিআইয়ের অন্তর্কলহ থামাতে মোদি সরকারের এই সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রথমত, অলোক বর্মাকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত আইনসম্মত কিনা। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করতেই তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কিনা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাফায়েল তদন্ত নিয়ে নাড়াচাড়ার অভিযোগও। এই সমস্ত অভিযোগের উত্তর একমাত্র যিনি দিতে পারেন, সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যথারীতি মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন। সিবিআইয়েও দুই কর্তার বিরোধ শুরু হয়েছিল এক বছর আগে। এক বছর চুপচাপ বসে থাকার পর হঠাৎ মোদি প্রশাসন হঠাৎ কেন এত তৎপরতা শুরু করল, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। দুবাইয়ের মৎস্য ব্যবসায়ী মঈন কুরেশির মামলার তদন্তে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগে বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে এফআইআর জারি করে সিবিআই। তারই ঘনিষ্ঠ এক অফিসার দেবেন্দ্র কুমারকে গ্রেফতারও করা হয়। তিনি আপাতত সিবিআই হেফাজতেই রয়েছেন। আস্থানা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। বরং সিবিআই অধিকর্তা বর্মাই উৎকোচ নিয়েছেন। দিল্লি­ হাই কোর্টে দুজনই পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনার দুই শীর্ষ অফিসারকে সরিয়ে নতুন বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের সুপারিশ করেন। তিনি স্বউদ্যোগেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা, তাও খুব স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে খুবই তৎপর ছিলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার নিয়োগ কমিটি বৈঠকে বসে দুই অফিসারকে সরিয়ে আইজি পদমর্যাদার এম নাগেশ্বর রাওকে অধিকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাত ১টায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়োগ সংক্রান্ত অফিসাররা কাগজপত্র তৈরি করেন। রাত ২টার সময় পুলিশ প্রহরাসহ নাগেশ্বর যান সিবিআই দফতরে। গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। অলোক বর্মা ও রাকেশ আস্থানাকে ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ জারি করা হয়। বর্মা ও আস্থানাদের অফিস তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এই অভিযান যে মূলত বর্মাকে সরানোর লক্ষ্যেই, তার প্রমাণ মেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আস্থানার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তকারী অফিসার এস কে বক্সিকে জনস্বার্থে আন্দামানে বদলি করে দেওয়া হয়। ওই তদন্তকারী দলের অতিরিক্ত এসপি এস এস গুরমকে জব্বলপুর, ডিআইজি এম কে সিনহাকে নাগপুরে বদলি করে তদন্তকারী দলটাই ভেঙে দেওয়া হয়।

এসপি সতীশ ডাগর ও ডিআইজি তরুণ গৌবাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন তদন্তকারী দল। বর্মার ঘনিষ্ঠ ও আস্থানার বিরোধী বলে পরিচিত শর্মাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজীব গান্ধী হত্যা মামলা দেখাশোনার দায়িত্বে। এক রাতে পরপর এতগুলো রদবদল যে নতুন ডিরেক্টরের মাথা থেকে বের হয়নি, তা মোটামুটি স্পষ্টই। বুধবার সকালে বর্মা সিবিআই দফতরে এলেও ঢুকতে পারেননি। তার অফিসে তল্ল­াশিও হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সিবিআইয়ের দুই কর্তার গোষ্ঠীলড়াই সংস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। দুজনেই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চলেছেন যা সংস্থার মর্যাদার ক্ষতি করছে। কেন্দ্রের যাবতীয় অভিযোগ বর্মার বিরুদ্ধেই।

রাফায়েল তদন্ত যাতে মাথাচাড়া না দেয়, সে কারণেই মধ্যরাতে আইন ভেঙে সিবিআইয়ের ডিরেক্টর অলোক বর্মাকে সরিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই ভাষাতেই নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তার অভিযোগ, রাফায়েল দুর্নীতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন অলোক বর্মা। এই দুর্নীতি নিয়ে প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করতে চাইছিলেন তিনি। সে কারণেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অলোক বর্মাকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যুইট করেন রাহুল। সেখানে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বার্তা স্পষ্ট। রাফায়েলের ধারে কাছে যিনি আসবেন, তাকে সরানো হবে, শেষ করে দেওয়া হবে। দেশ আর সংবিধান বিপদে।

কংগ্রেসের যুক্তি, সিবিআই অধিকর্তা পদে নিয়োগের নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে গঠিত কমিটি ওই পদে নিয়োগ করে। একমাত্র তাদেরই অধিকার আছে পদাধিকারীকে সরানো বা বদলি করার। কিন্তু সরকার সে নিয়মের তোয়াক্কা করেনি। রাহুল ট্যুইটে বলেন, ‘মিস্টার ৫৬ আইন ভেঙে প্রধান বিচারপতি আর বিরোধী দলের নেতাকে পাশ কাটিয়েছেন। মিস্টার মোদি রাফায়েল মারাত্মক বিমান, যার চমৎকার র‌্যাডার আছে। আপনি পালাতে পারেন, কিন্তু লুকোতে পারবেন না।’ কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি বলেছেন, অলোক বর্মা যখন সিবিআই প্রধানের পদে আসেন, তখন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই একাধিক অভিযোগ ছিল। এদিকে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি অলোক বর্মার সঙ্গে বিরোধীদের যোগসাজশের পাল্টা অভিযোগ এনেছেন।

বিজেপি নেতাদের ভূরি ভূরি বেনিয়ম আড়াল করতে এবং তাদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সিবিআইয়ের শীর্ষ কর্তাদের যোগসাজশ ঢাকতেই মধ্যরাতে তড়িঘড়ি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের ডিরেক্টর অলোক বর্মাকে। রাফায়েল চুক্তির বিশাল কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতেই নরেন্দ্র মোদি মধ্যরাতে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। এক ট্যুইট বার্তায় এই অভিযোগ করেছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।

গভীর রাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটি অলোক বর্মা ও স্পেশাল ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গুজরাট ক্যাডারের আইপিএস রাকেশ আস্থানাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল মোদি সরকার। তখনই আস্থানার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। বিরোধী দলগুলো সিবিআইয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেছে।

ইয়েচুরি বলেছেন, বেআইনি প্রক্রিয়ায় সরানো রয়েছে সিবিআই প্রধানকে। পছন্দের যে অফিসারকে স্পেশাল ডিরেক্টর পদে বসিয়েছিল, তাকে বাঁচাতেই এই সিদ্ধান্ত। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এই আধিকারিকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আড়াল করতেই তড়িঘড়ি এই পদক্ষেপ। তিনি বলেন, সিবিআই যাতে খাঁচাবন্দী তোতা না হয় তার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সংস্থার প্রধানকে রক্ষাকবচ দিয়েছিল। সরকারের মর্জির শিকার যাতে হতে না হয় সে জন্য সিবিআই প্রধানের মেয়াদ দুই বছরের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানা হয়নি। তার প্রশ্ন, কীসের ভয়ে তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে দেওয়া হলো সিবিআই প্রধানকে? মধ্যরাতের অপারেশনে সিবিআইয়ের নতুন ডিরেক্টর হয়েছেন এম নাগেশ্বর রাও। কিন্তু দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগেই দুর্নীতি বিতর্ক ছুঁয়ে গিয়েছে তাকে। আর সেই দুর্নীতির সঙ্গে যোগ রয়েছে কলকাতারও। সল্টলেকের সিএ ব্লকের ৩৯ নম্বর বাড়িটিতে রয়েছে নাগেশ্বরের স্ত্রীর সংস্থা এঞ্জেলা মার্কেন্টাইলস প্রাইভেট লিমিটেড। দীর্ঘদিন ধরেই ইডি এবং আয়কর বিভাগের নজর রয়েছে এ সংস্থাটির ওপর। দুটি কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং আয়কর দফতরের অভিযোগ এই সংস্থাটি আসলে একটি শিখন্ডী সংস্থা। ভুয়ো লেনদেনের মাধ্যমে টাকা পাচার চলে এই ধরনের সংস্থা থেকে। এরকম শিখন্ডী সংস্থার বিরুদ্ধে নোট বাতিলের সময় কলকাতাসহ দেশের নানা প্রান্তে অভিযান চালায় ইডি ও আয়কর দফতর।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর