সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রূপকথার ফিনিক্স পাখি ও বাংলাদেশ

অপূর্ব আজাদ

রূপকথার ফিনিক্স পাখির কাহিনী অনেকেরই জানা। ভস্ম থেকে উড়াল দেওয়ার সামর্থ্য দেখিয়েছে সে অলৌকিক পাখি। বাংলাদেশকেও তুলনা করা যায় ফিনিক্স পাখির সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে             ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। প্রায় চার যুগ আগে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল শূন্য হাতে। পুরো দেশটিই ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। চারদিকে নাই নাই নাই। দেশের ১ কোটিরও বেশি মানুষ ছিল গৃহহারা। পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে ১ কোটিরও বেশি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল শরণার্থী হিসেবে। তাদের বাড়িঘর হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল নতুবা সব কিছু লুটপাট করে নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস। রাস্তাঘাটের শতকরা ৯৫ ভাগ ছিল বিধ্বস্ত। সেতু কালভার্টের বেশির ভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জুড়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী লুণ্ঠন চালিয়েছে বাংলাদেশে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের লুটের টাকা-সোনা-দানা পাচার করেছে পাকিস্তানে। বলা যায় ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে নির্দয়ভাবে হেরেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এটি ছিল  পাকিস্তানের দুই মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্যও অপমানজনক ঘটনা। তবে তারা গর্ব ভরেই বলত বাংলাদেশ বেশিদিন টিকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ইহুদি কূটনীতিক কিসিঞ্জার তো বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে বলতেন তলাবিহীন ঝুড়ি। প্রায় চার যুগের ব্যবধানে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশগুলোর একটি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসি ২০৩০ সালের বিশ্ব সম্পর্কে আশার কথা শুনিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ২০৩০ সাল নাগাদ যেসব দেশের অর্থনীতির আকার দ্রুত বাড়বে সেই তালিকায় বাংলাদেশ সবার ওপরে। পূর্বাভাসে বাংলাদেশকে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও উদীয়মান ৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে বেশি হারে বাড়বে। বর্তমানে বিশ্বে জিডিপির আকার বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪২তম। ২০৩০ সালে ১৬ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ উঠে আসবে ২৬তম স্থানে। ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশকে ২০৩০ সালে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। এই সাফল্য অর্জিত হবে ২০১৮ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এক যুগে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে থাকবে এমন সম্ভাবনার কারণে। এইচএসবিসি তাদের পূর্বাভাসটি প্রস্তুত করেছে ৭৫টি দেশের জনশক্তির আকার, মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় নেওয়া পদক্ষেপ, সংশ্লি­ষ্ট দেশগুলোর রাজনীতি, বাজার উš§ুক্তকরণের প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের পারঙ্গমতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে। এইচএসবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ১২ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৬ ধাপ এগিয়ে ২৬তম অবস্থানে আসবে। আর মালয়েশিয়া ৫ ধাপ এগিয়ে ৩৪ থেকে-২৯-এ উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ ২০৩৮ সাল নাগাদ এসব দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে থাকবে বাংলাদেশের পেছনে। অপরদিকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ অর্থনীতিতেও আসবে পরিবর্তন। ২০৩০ সালে বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীন বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ স্থানে পৌঁছাবে। শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়তে নামবে। সপ্তম অবস্থান থেকে তৃতীয় অবস্থানে চলে আসবে ভারত।              তৃতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে চলে যাবে জাপান। জার্মানি চতুর্থ অবস্থান থেকে পঞ্চম স্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। স্মর্তব্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের ডিজিপির আকার ছিল ২২ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা বা ২৭০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মধ্য আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। নিজের মাথা থেকে সরিয়ে ফেলেছে শত শত বছর ধরে বয়ে বেড়ানো দরিদ্র দেশের লজ্জা। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দরিদ্রের হার শূন্যে নামিয়ে আনা। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৭ অর্থাৎ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের গভর্নর জেনারেলের ভূমিকা পালন করত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতরা। উপ-সচিব পর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার দৃশ্যমান কর্ণধারদের ওপরও ছড়ি ঘোরাত। বাংলাদেশে ওয়ান- ইলেভেনের জংলি শাসন কায়েম হয়েছিল পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের পৃষ্ঠপোষকতায়। লুটপাট আর দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো ছাড়া সে সরকারের অর্জন ছিল শূন্য। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকার স্বাধীনভাবে পথ চলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর গাত্রদাহের শিকার হয়। দুর্নীতির দোহাই দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক বরাদ্দ দেওয়া ঋণ স্থগিত ঘোষণা করে। এ অন্যায়ের কাছে মাথানত করার বদলে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পদ্মা সেতুতে একই সঙ্গে রেলপথ বসানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। সে প্রকল্প এখন বাস্তবায়নের পথে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী ট্যানেল, মেট্রো রেল নির্মাণের পথে অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশ তার সামর্থ্যরে প্রকাশ ঘটিয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। এইচএসবিসির পূর্বাভাসে বাংলাদেশের সম্ভাবনার যে কথা বলা হয়েছে তাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা খুবই জরুরি। এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে।

            লেখক : প্রকৌশলী।

সর্বশেষ খবর