মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

উম্মতে মুহাম্মাদীর দায়িত্ব ও ফজিলত

শায়খুল হাদিস মুফতি মনসূরুল হক

দীনের দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত এ উম্মতের একক বৈশিষ্ট্য। এর কারণ হলো, আখেরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী আসবে না। ঈসা (আ.) যদিও আসবেন, কিন্তু তিনি আমাদের নবীর শরিয়তই অনুসরণ করবেন। নবী হিসেবে তাঁর নিজের কিতাব প্রতিষ্ঠা করবেন না। কাজেই এখন যদি প্রত্যেকে নিজের ইমান-আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকে অন্য ভাইয়ের ইমান-আমল, কলমা-নামাজ ঠিক আছে কিনা- এসব খেয়াল না করে; তাহলে মুসলমানদের মাঝে আর দীন ইসলাম কিছুতেই টিকে থাকবে না। এ কারণেই আল কোরআনে আল্লাহ বলেছেন,

‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদের পাঠানো হয়েছে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য।’ সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০। নবীজি বলেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাক্য হলেও পৌঁছে দাও’। বুখারি।

আম্বিয়া (আ.)-এর মেহনত কী ছিল?

শিরকমুক্ত ইমান ও বিদাতমুক্ত সহি আমলের সুসংরক্ষণের জন্য আল্লাহতায়ালা নবী-রসুলদের তিনটি মেহনত দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন- ১. তাবলিগ ২. তালিম ৩. তাজকিয়া। সূরা বাকারা আয়াত ১২৯, ১৫১; সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৪; সূরা জুমুয়া, আয়াত ২।

তাবলিগ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো উম্মতকে এ কথা পরিপূর্ণ বোঝানো যে, দীন ছাড়া দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবির কোনো রাস্তা নেই। এ কথাটা পুরো দুনিয়ার মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়াকে ‘তাবলিগ’ বলা হয়।

তালিম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাবলিগের পরে যে লোক ইমান-আমল, কলমা-নামাজ, কোরআন স্বল্পমেয়াদে বা দীর্ঘমেয়াদে শিখতে চায়; তাকে ওইসব শিখিয়ে দেওয়া। এ কথাটাকে বলা হয় তালিম।

তাজকিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অন্তরের ১০টি রোগের চিকিৎসা করা এবং ১০টি ভালো গুণ অর্জন করা। অন্তরের রোগ যেমন, হিংসা, লোভ, লৌকিকতা, অহংকার ইত্যাদি। আর অন্তরের গুণ যেমন সবর, শোকর, ইখলাস ইত্যাদি। তালিম দ্বারা আমলের দেহ বা শরীর তৈরি হয়। আল্লাহতায়ালার সুহবত দ্বারা যখন অন্তরের মধ্যে ইখলাস তৈরি হয়, তখন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত তথা যাবতীয় আমলের দেহে ‘রুহ’ তৈরি হয়। তখন এ আমলগুলো আল্লাহর দরবারে সহজেই কবুল হবে। সুতরাং ‘তাজকিয়ার’ সার কথা হলো, অন্তর পরিশুদ্ধ করা।

কওমি মাদ্রাসাগুলো কেন জরুরি?

আম্বিয়া (আ.)-এর এ তিন মেহনতকে সঠিক ধারায় প্রবহমান রাখার জন্য আমাদের এ কওমি মাদ্রাসাগুলোর অস্তিত্ব অত্যন্ত জরুরি। এ কওমি মাদ্রাসাগুলো হলো দীনের কিল্লা। যত দিন এ কিল্লাগুলো সহি ধারায় টিকে থাকবে তত দিন সোয়া লাখ পয়গম্বরের মেহনত তাবলিগ, তালিম, তাজকিয়া টিকে থাকবে।

আল্লাহতায়ালা এ মাদ্রাসাগুলো তৈরি করিয়েছেন এখান থেকে নায়েবে নবী পয়দা করার জন্য। নায়েব বলা হয় যে আসলের অনুপস্থিতিতে তার কাজগুলো চালিয়ে নেয়। অমুসলিমদের চিন্তাধারায় রচিত কিংবা তাদের দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিদের তৈরি সিলেবাস-সংবলিত কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ‘নায়েবে নবী’ তৈরি হবে না। বরং এ নায়েব তৈরি হবে একমাত্র কওমি মাদ্রাসাগুলোয়। তাই যে এলাকায় কোনো কওমি মাদ্রাসা থাকে সেখানে বদ্-দীন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আর যে এলাকায় কোনো কওমি মাদ্রাসা থাকে না, সে এলাকায় বদ্-দীনের সয়লাব হয়ে যায়।

মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাবলিগের এ মেহনতকে তাজা ও বেগবান করেছেন। তিনি নিশ্চয় কোনো স্কুল-কলেজ থেকে পড়ে আসেননি; বরং তিনি হলেন ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’-এর সন্তান।

কাজেই আমাদের জনসাধারণের করণীয় হলো, সঠিক নায়েবে নবী তৈরির এ মারকাজগুলোর সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ও এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হক্কানি ওলামায়ে কিরামের সহযোগিতায় আত্মনিবেদিত হওয়া।

মনে রাখতে হবে, এ সহযোগিতা মূলত নিজের স্বার্থে, নিজের ইমান-আমল হেফাজতের উদ্দেশ্যে। কেননা, এ সহযোগিতার মাধ্যমে যখন এ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকবে, তখন আম্বিয়া (আ.)-এর নায়েব তৈরি হবে। তালিম, তাবলিগ ও তাজকিয়ার তিন মেহনতও টিকে থাকবে। জনসাধারণ শিরকমুক্ত ইমান ও বিদাতমুক্ত আমলের মাধ্যমে জান্নাতের পথে অগ্রসর হতে পারবে।

হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) একদিন ওয়াজে বললেন, ‘তোমরা মনে কর; আমরা দু-চার টাকা সাহায্য করি বলে হুজুররা চলতে পারে, আমরা যদি সাহায্য বন্ধ করে দিই তাহলে হুজুররা আর চলতে পারবে না! তোমাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ হুজুররা তোমাদের মতোই কর্মক্ষম সুস্থ মানুষ। খেত-খামার, কাজকর্ম করে তারা চলতে পারবে, খেতে পারবে। তোমরা সাহায্য না করলে তারা না খেয়ে থাকবে; তোমাদের এ ধারণা ভুল। বরং তোমরা এটা চিন্তা কর যে, যদি এ হুজুররা না থাকে, তোমাদের পেছনে দীনি মেহনত না করে, তালিম-তারবিয়াত, ওয়াজ মাহফিলে তোমাদের না বোঝায় তাহলে আগামী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে তোমাদের সন্তানদের কী অবস্থা হবে! তাদের মাঝে দীনের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তখন কারও ছেলে ইহুদি, কারও ছেলে খ্রিস্টান, কারও ছেলে কাদিয়ানি, কারও ছেলে হিন্দু-বৌদ্ধ হয়ে যাবে। এ কথা ভালোভাবে লিখে রাখো।’

সুতরাং ওলামায়ে কিরাম ও কওমি মাদ্রাসার সহযোগিতার ক্ষেত্রে মূলত নিজেদের ইমান ও আমলের সুসংরক্ষণের হেফাজতের চিন্তাধারাই নিজের মাঝে লালন করতে হবে এবং এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এ কওমি ও দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলো এবং এর মধ্যে যারা পড়ায় আমাদের তাদের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। যদি এদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, দীনি কোনো বিষয়ে এসব ওলামায়ে কিরামের বিরোধী শিবিরে অবস্থান করি, তাহলে আমার দীন-ইমানের কোনো গ্যারান্টি নেই; যে কোনো মুহূর্তে বেইমান হয়ে যাব।

বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতে যে ফিতনা চলছে, কিছু ভাই বুঝে-না বুঝে ওলামায়ে কিরামের বিরোধী শিবিরে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, ওলামায়ে কিরামের গিবত করছেন এবং ওলামায়ে কিরাম দীনি বিষয়ে মাওলানা সাদের অজ্ঞতা, ধৃষ্টতা ও ‘শরিয়ত-বিরোধী’ বিচ্ছিন্ন মতের কারণে এবং দাওয়াত ও তাবলিগের স্বীকৃত তিন মুরব্বির কর্মপন্থা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে যে আপত্তি তুলেছেন, সে আপত্তিকে তারা দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের সঙ্গে ‘অসহযোগিতা’ মনে করছেন।

অথচ পূর্ববর্তী তিন মুরবি মাওলানা ইলিয়াস (রহ.), মাওলানা ইউসুফ (রহ.), মাওলানা ইনামুল হাসান (রহ.)-এর আমলে তাদের বিরুদ্ধে ওলামায়ে কিরামের কোনো আপত্তি ছিল না; বরং এ কাজের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এর পৃষ্ঠপোষকতা ওলামায়ে কিরাম করেছেন। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) নিজে আলেম ছিলেন। তিনি মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি (রহ.), মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.)-এর সুহবত ও মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর প্রত্যক্ষ পরামর্শে চলতেন। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) নিজেই বলেছেন, ‘এ কাজের বরকত মূলত হজরত [থানভি (রহ.)]-এর দোয়ারই ফসল।’ বিস্তারিত দেখুন সাইয়্যেদ আবুল হাসান নদভি (রহ.) কৃত ‘মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) আওর উনকি দীনি দাওয়াত’, পৃষ্ঠা ৫৭, ৮০, ১১৪, ১১৫, ১২৬-১২৭; তাজদিদে তালিম ও তাবলিগ, পৃষ্ঠা ১৭৩।

তিন মুরব্বি নিজেরা প্রত্যেকে মজবুত আলেম ছিলেন। ইমানওয়ালা ছিলেন। পদ-পদবি চাইতেন না বরং পদের থেকে অনেক দূরে থাকতেন। তাদের কাজের ওপর কেউ আপত্তি করেছেন; এমন কোনো প্রমাণ নেই। এখন চতুর্থ মুরব্বির (?) সময় ওলামায়ে কিরাম সম্মিলিতভাবে কেন আপত্তি করল? এ আপত্তির পেছনে ওলামায়ে কিরামের স্বার্থ কেবল এতটুকুই যে, তারা আম্বিয়া (আ.)-এর ওয়ারিশ বা উত্তরসূরি হিসেবে নববী কাজ তাবলিগ, তালিম ও তাজকিয়ার সঠিক ধারা উম্মতের সামনে ধরে রাখার ব্যাপারে আল্লাহ ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত। কাজেই কেউ যদি কোরআন-হাদিসের তালিমের বিকৃত ব্যাখ্যা করে, তাবলিগের স্বতঃসিদ্ধ পথ ও পন্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেই নিজেকে আমির দাবি করে, মাদ্রাসা ও তাজকিয়ার জন্য হক্কানি পীর-মাশায়েখের খানকাহকে ‘আঘাত’ করে, তবে তার বিভ্রান্তি থেকে জনসাধারণের ইমান ও আমল হেফাজত করা ওলামায়ে কিরামের দায়িত্ব হয়ে যায়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘এ (ওহির) ইলমকে ধারণ করবে প্রত্যেক উত্তরসূরির বিশ্বস্ত শ্রেণি (ওলামায়ে কিরাম), তাঁরা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতিসাধন, বাতিলপন্থিদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও অজ্ঞ লোকদের অপব্যাখ্যা থেকে ইলমকে রক্ষা করবে।’ মুকাদ্দামায়ে আত তামহিদ লি ইবনে আবদিল বার।

সুতরাং দীনের স্বার্থে কোনো অতিরঞ্জনকারী, বাতিলপন্থি কিংবা অজ্ঞ লোকের বিভ্রান্তি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা কখনই গিবতের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা ওলামায়ে কিরামের দায়িত্ব, যে দায়িত্ব স্বয়ং রসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দিয়েছেন।

মাওলানা সাদের ওপরে ওলামায়ে কিরাম ঠিক এ দায়িত্ববোধ থেকেই আপত্তি তুলেছেন! ওলামায়ে কিরাম তাবলিগের বিরোধিতা আগেও করেননি; এখনো করছেন না। তারা বিরোধিতা করছেন বিভ্রান্ত মাওলানা সাদের।

মাওলানা সাদের বিভ্রান্তিগুলো মৌলিকভাবে তিন ধরনের :

এক : ‘তাফসির র্বি-রায়’ তথা কোরআন-সুন্নাহর মনগড়া তাফসির।

দুই : তাবলিগের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তাবলিগ ছাড়া দীনের বাকি শাখাগুলোকে তথা ইলম শেখার মাদ্রাসা আর আত্মশুদ্ধি শেখার খানকাহর অবমাননা।

তিন : তাবলিগের মেহনতে পূর্ববর্তী তিন মুরব্বির বিপরীতে নতুন ধারার প্রচলন।

প্রথম বিষয় : ‘তাফসির র্বি-রায়’ তথা কোরআন-সুন্নাহর মনগড়া তাফসির।

যেমন ক. তিনি আল্লাহর হাতে হেদায়াত থাকাটা অস্বীকার করে বলেন, যদি আল্লাহর হাতে হেদায়াত থাকত তাহলে নবীদের পাঠানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কাজেই হেদায়াত আল্লাহর হাতে নেই (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ দেখুন নবীজি তাঁর প্রিয় চাচা আবু তালিবকে তার মৃত্যুর সময় কলমা পড়াতে কত চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘আপনি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করতে পারবেন না বরং একমাত্র আল্লাহ যাকে চান তাকেই হেদায়াত দেবেন।’ (সূরা কাসাস, আয়াত ২৮, ৫৬)।

খ. তিনি আরও বলেন, কোরআন শরিফ অর্থ বুঝে পড়া ওয়াজিব। কেউ অর্থ না বুঝে পড়লে তার গুনাহ হবে। আজ পর্যন্ত ১৪০০ বছরের মধ্যে কোনো আলেম কখনো এমন কথা বলেননি। বরং হাদিসে স্পষ্ট এসেছে, সূরা বাকারার শুরুতে যে ‘আলিফ, লাম, মিম’ আছে, তা পড়লে ৩০ নেকি হবে। অথচ সব মুফাস্সিরই এ কথা লিখেছেন যে, আলিফ, লাম, মিমের অর্থ আল্লাহতায়ালা ছাড়া কেউ জানে না!

দ্বিতীয় বিষয় : তিনি তাবলিগের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তাবলিগ ছাড়া দীনের বাকি শাখাগুলোকে তথা ইলম  শেখার মাদ্রাসা আর আত্মশুদ্ধি শেখার খানকাহর অবমাননা করেছেন।

যেমন ক. তিনি মাদ্রাসার ওলামাদের ব্যাপারে বলেছেন, যেসব আলেম বেতন নিয়ে দীনের খেদমত করেন, বেশ্যা মহিলারা তাদের আগে বেহেশতে যাবে।

অথচ চার মাজহাবের ইমামরা ফতোয়া দিয়েছেন, ওলামাদের বেতন নেওয়া জায়েজ। এটা তাদের ইলমের মূল্য নয়, বরং তারা যে আটকা পড়ে আছেন; অন্য কামাই-রোজগারের সুযোগ পাচ্ছেন না; সেজন্য তাদের এই বেতন দেওয়া।

ওলামাদের বেতন দেওয়ার এ সিলসিলা তো দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর জমানায় শুরু হয়েছে। তাহলে হজরত ওমর ফারুক (রা.) কি ভুল করলেন? আর অন্য সাহাবায়ে কিরামও তা সমর্থন করলেন?

মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)ও মেওয়াত এলাকায় কয়েকজন কোরআনের শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি নিজে তাদের নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থা করতেন! যদি বেতন নেওয়া-দেওয়া হারাম হয় তাহলে  ইলিয়াস (রহ.) কি ভুল করে গেছেন?

খ. তিনি খানকাহগুলোর অবমাননা করেছেন এই বলে যে, চিল্লা দেওয়ার পরে যে আত্মশুদ্ধি করার জন্য খানকায় গিয়ে কোনো পীর খোঁজে সে জাহেল, সে তাবলিগ বোঝেনি।

আচ্ছা কেউ কি বলতে পারবে যে, চিল্লা দিলে অন্তরের আত্মশুদ্ধি হয়ে যায়! যদি তাই হতো, তবে মাওলানা সাদের অনুসারীরা বর্তমানে ওলামায়ে কিরামের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের দোষচর্চায় লিপ্ত হতো না! ২০ বছর ৩০ বছর ‘আল্লাহ থেকে হয়’ এ বয়ান করে ‘কওমি মাদ্রাসাগুলো চাঁদা দিয়ে আমরাই বাঁচিয়ে রেখেছি’ এমন শিরকি ও স্ববিরোধী কথা বলার দুঃসাহস হতো না। ওলামায়ে কিরামের সম্মিলিত ফতোয়াকে ‘ঠাকুরমার ঝুলির গল্প’ বলারও ধৃষ্টতা হতো না...!

তৃতীয় বিষয় : মাওলানা সাদ তাবলিগের মধ্যে এমন কিছু ধারা চালু করেছেন যা আগের মুরব্বিরা করে যাননি।

যেমন ক. আগের মুরব্বিরা বলতেন, তোমরা ‘ফাজায়েলে আমাল’ পড়। এ কিতাবটি দুনিয়ার কত ভাষায় যে তরজমা হয়েছে এক আল্লাহ ভালো জানেন। তিনি কিছু আলেম দিয়ে ‘মুনতাখাব হাদিস’ তৈরি করে সব সময়ই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফাজায়েলে আমালকে বাদ দিয়ে মুনতাখাব হাদিস চালু করতে।

খ. আগে ছিল দাওয়াত, তালিম, দৈনিক আড়াই ঘণ্টার মেহনত, প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে মেহনত করার পদ্ধতি। তিনি তা পাল্টে দিয়ে বলেন যে, ‘না, বরং তোমরা মসজিদে তালিম করবে আর রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যাবে তাদের দাওয়াত দিয়ে মসজিদে নিয়ে আসবে। যাকে বলা হয় ‘ইস্তিকবাল’।

মাওলানা সাদের রুজু [বক্তব্য প্রত্যাহার] প্রসঙ্গ :

শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘রুজু’ গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়ার জন্য আবশ্যক হলো, ভুল প্রকাশ্যে হলে প্রকাশ্যে আর গোপনে হলে গোপনে প্রতিটি ভুল স্বীকারকরত সঠিক বিষয়টি সুস্পষ্ট শব্দে ব্যক্ত করে দেওয়া। সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসিয়ত করে বলেন, ‘তুমি প্রকাশ্যে [গুনাহ] হলে প্রকাশ্যে [তওবা কর], গোপনে [গুনাহ] হলে গোপনে [তওবা কর]।’ তাবারানি কাবির, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ।

মাওলানা সাদের ব্যাপারে বলা হয়, তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের কাছে রুজু করেছেন। এ কথাটি সঠিক নয়। তার এ রুজু গ্রহণযোগ্য বিবেচিত নয়। কেননা, প্রথমত দারুল উলুম দেওবন্দের কাছে কিছু বিষয়ে রুজু করলেও আম মজমার মধ্যে প্রকাশ্যে তিনি এখনো সুস্পষ্ট শব্দে রুজু করেননি। অথচ তিনি বিতর্কিত বক্তব্যগুলো দিয়েছেন বিভিন্ন ইজতেমার হাজারো লোকসমাগমে। দ্বিতীয়ত তিনি তার সব বিতর্কিত বক্তব্য থেকে রুজু করেননি; বরং কেবল দু-একটি বক্তব্য রুজু করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দ কেবল মূসা (আ.)-এর ঘটনার ব্যাপারে তার রুজু গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেছে। অন্যান্য বিতর্কিত বিষয়ে দেওবন্দ তার আপত্তি পূর্ববৎ বহাল রেখেছে। তৃতীয়ত দেওবন্দের কাছে তার প্রেরিত সর্বশেষ রুজুনামার পরও তার অনেক বিতর্কিত বক্তব্য পাওয়া গেছে। এ কারণেই দারুল উলুম দেওবন্দ ১৩ জুমাদাল উলা ১৪৩৯ হিজরি মোতাবেক ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে মাওলানা সাদ সম্পর্কে তাদের সর্বশেষ অবস্থান তুলে ধরেছেন এভাবে... ‘শুধু দারুল উলুমের দায়িত্বশীলগণই নন; বরং অন্যান্য হক্কানি ওলামায়ে কিরামের মাঝেও মাওলানার (সাদ) সামগ্রিক চিন্তার ব্যাপারে প্রচ- রকমের অনাস্থা রয়েছে। মাওলানার এ অনর্থক ইজতিহাদ দেখে মনে হয় যে, আল্লাহ না করুন, তিনি এমন এক নতুন দল তৈরির দিকে চলেছেন, যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বিশেষ করে নিজেদের আকাবিরদের থেকে ভিন্ন রকমের হবে! আল্লাহতায়ালা আমাদের পূর্বসূরিদের পথে অটল রাখুন।’ দ্রষ্টব্য.

www.darululoom-deoband.com কাজেই যত দিন মাওলানা সাদের থেকে সঠিক অর্থে ‘রুজু’ না পাওয়া যাবে, তত দিন তাকে অনুসরণীয় মনে করা নিঃসন্দেহে গোমরাহি হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর অটল ও অবিচল রাখুন।

লেখক : শায়খুল হাদিস ও প্রধান মুফতি

জামি’আ রহমানিয়া আরাবিয়া

 মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

 

 

সর্বশেষ খবর