বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সংলাপ আজ ভেঙে গেলে রাজপথ না ভোটযুদ্ধ?

পীর হাবিবুর রহমান

সংলাপ আজ ভেঙে গেলে রাজপথ না ভোটযুদ্ধ?

সংবিধান না রাজপথ কোন পথে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান? এ প্রশ্ন দুয়ারে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত ঘুরছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে। দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাহেন্দ্রক্ষণে তাকিয়ে আছেন গণভবনের দিকে। এক কথায় দেশবাসীর দৃষ্টি এখন গণভবনে। আজ বুধবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের শেষ পর্ব ভেস্তে গেলে কোনো সমঝোতা না হলে রাজনীতি কি রাজপথের আন্দোলন না ভোটযুদ্ধে গড়াবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের দেওয়া চিঠিতে সংলাপের যে দরজা খুলে দিয়েছিলেন তাতে রাজনীতিতে চাঞ্চল্যই আসেনি, জনমনে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল তা এখন নিভতে বসেছে। সরকার সংবিধান থেকে একচুল না নড়ার নীতিতে অটল থেকে সংলাপ শেষ করতে যাচ্ছে। যে স্বস্তি এসেছিল সেখানে নতুন করে উদ্বেগের কালো ছায়া দেখা দিয়েছে। একের পর এক রাজনৈতিক সংলাপ শেখ হাসিনার উষ্ণ আতিথেয়তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আলাপ-আলোচনা আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে হলেও ভোটযুদ্ধ সামনে রেখে দুই পাল্লায় বিভক্ত রাজনৈতিক শক্তি এখন মুখোমুখি।

সর্বশেষ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম যেমন ড. কামালের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তেমনি হঠাৎ যুক্তফ্রন্টের নেতা বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে শরিকানা লাভ করতে যাচ্ছেন।

একদিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগনির্ভর মহাজোটের পাল্লা যেমন ভারী হচ্ছে, তেমনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শক্তিও বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনও যে ভোটযুদ্ধে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিনির্ভর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের পক্ষেই থাকবে এ কথা বলা যায়। তেমনি একদিন সরকারকে প্রবল ঝাঁকুনি দেওয়া হেফাজতে ইসলাম তাদের আধ্যাত্মিক নেতা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে সরকারবিরোধী সেই অবস্থান থেকে দীর্ঘদিনের পরিচর্যায় তাদের দাবি-দাওয়া পূরণে এখন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তাদের আনুগত্যই প্রকাশ করেননি, কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলেম-ওলামাদের সমাবেশ ঘটিয়ে সংবর্ধনাও দিয়েছেন। সেখানে শেখ হাসিনাকে তারা ‘কওমি জননী’ উপাধি দেন এবং তার মাতৃত্বসুলভ স্হেহচ্ছায়া আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি রাখার আবেদন জানান।

একদিন যারা অতিবিপ্ল­বী ও অতিপ্রগতির পথে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে শেখ হাসিনার ছাতার নিচে এসে আশ্রয় নিয়ে, হেফাজতে ইসলামকে নানান নেতিবাচক ভাষায় সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন, তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা বা রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় বা চিন্তাধারায় সমাজের নানা মতপথের মানুষকে যেমন ধারণ ও লালন করতে হয়, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতকেও মূল্য দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা মধ্যপন্থা নীতি থেকে একটি মডারেট মুসলিম দেশের যে বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে মাদ্রাসা শিক্ষা নিচ্ছে তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার পথে উদার নীতিই গ্রহণ করেছেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বিবেচনা করতে গিয়ে সংখ্যালঘু অতিবাম বা অতিবিপ্ল­বী ঘরের জনসমর্থনহীন আঁতেলদের চিন্তা-চেতনাকে আমলে নেননি। এ সংখ্যালঘু শক্তির আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বর ঘিরে যে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছিল, যে তা-ব ঘটিয়েছিল, সেদিন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি সম্পূর্ণরূপে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কঠোর হাতে সরকার সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যে রাজনৈতিক রণকৌশল গ্রহণ করেছিল, সেখানে হেফাজত নিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণে বিএনপি পরাজিত হলেও শেখ হাসিনা জয়ী হয়েছেন। ভোটযুদ্ধ সামনে রেখে হেফাজতে ইসলাম শেখ হাসিনার প্রতি সহানুভূতিই নয়, নির্বাচনে তাদের ভোট নৌকায় তুলে দিতে পারুক আর না পারুক অন্তত সরকারবিরোধী জনমত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির অনুকূলে তুলে দেওয়া কিংবা সরকারবিরোধী সভা-সমাবেশ, বক্তৃতাদান কিংবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথকে রুখেই দেননি, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। শোকরানা মাহফিলের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, সেই ৫ তারিখের প্রলয়ে অসংখ্য হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছেন বলে এতদিন যে প্রচার করা হয়েছিল কার্যত তা ছিল মিথ্যা ও গুজবনির্ভর। শেখ হাসিনা আলেমদের প্রতি সম্মান দেখালেও জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান তুলে ধরতে ভুল করেননি।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের সনদের সরকারি স্বীকৃতিদানে হেফাজতে ইসলাম শেখ হাসিনাকে মধ্যমণি করে শোকরানা মাহফিলের আয়োজন করে। কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার শিক্ষার্থী আলেম-ওলামাদের সঙ্গে যুক্ত হন শোকরানা মাহফিলে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার দাওরায়ে হাদিসকে ¯œাতকোত্তর স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাস করায় এ শোকরানা মাহফিল হয়। যদিও যেখানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিচের স্তর ছাড়া একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে স্বীকৃতি দেওয়ায় তারা অসংগতি দেখছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা কার্যত অবহেলিত গরিব ও এতিম সন্তানদের লেখাপড়ার মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এর শিক্ষার মান উন্নত ও আধুনিক ধারায় সম্পৃক্ত করার চ্যালেঞ্জটিই নিয়েছেন।

স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে প্রতিটি সরকার একের পর এক মাদ্রাসার যেমন সৃষ্টি হতে দিয়েছে, তেমনি জনপ্রতিনিধিরা অনুদান দিতেও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু একটি দেশের জম্ম গত নাগরিক ও সন্তান হিসেবে তারাও সমঅধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। মাদ্রাসা শিক্ষায় সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতি অতিবিপ্ল­বী ও প্রগতিশীলদের নাক ছিটকানো, দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা বাস্তবসম্মত।

আওয়ামী লীগ এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে নেতৃত্বই দেয়নি, লাখ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীন দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার নিয়ে পথ হেঁটেছিল, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অস্ত্রের জোরে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে অসাংবিধানিক শাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে ধর্মের রাজনীতি বিষ ছড়িয়েছিল। সেখান থেকে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সামরিক শাসন কবলমুক্ত বাংলাদেশ বেরিয়ে আসে। একুশ শতকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এটিই বাস্তবতা। ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও প্রতিহিংসার রাজনীতির রোষানলে ভঙ্গুর রূপ নিয়েছে। এখনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। প্রশাসনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী স্বাধীন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। কার্যকর প্রাণবন্ত রূপ নেয়নি সংসদ। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এ ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরে হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক উন্নত আধুনিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ সব দলের ওপর দায়িত্ব।

দুই ভারী পাল্লায় বিভক্ত রাজনীতির হিসাব-নিকাশে কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি এখন কোন পাল্লায় ওঠে তা দেখার অপেক্ষায়। শোনা যাচ্ছে, দলের মধ্যে মতবিরোধ আছে। এক পক্ষ চায় মহাজোটে যেতে, আরেক পক্ষ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। বাম গণতান্ত্রিক জোট কোনো পাল্লায় যাবে না তবে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনী তফসিল সমঝোতার আগে ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইছে।

বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট থেকে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য ঐক্যফ্রন্টে গেলেও বি চৌধুরীর বিকল্পধারা তার পুত্র মাহী বি চৌধুরীর ব্যবসা-বাণিজ্যের দিনলিপি সুখকর হওয়ায় এই ফাটল বলে বাতাসে নানা কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। এমনকি মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথন ফাঁস হওয়া নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাজনীতিতে দুবারের ডাকসু বিজয়ী জীবনের নানা পরতে পরতে ঘাত-প্রতিঘাত, জেল-জুলুম সয়ে আসা মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে রাজনীতিতে নাবালক মাহী বি চৌধুরী যেভাবে কথা বলেছেন, তাও অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করেছে।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে শাবাশ বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বি চৌধুরী যেখানে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে গণতন্ত্র ও সুশাসন দেওয়ার পরও উপস্থাপনার জোরে জনসাধারণের হৃদয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরিতে কঠিন ভূমিকা রেখেছিলেন, একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে নির্বাচন করে বিএনপি ও তাদের ভোটে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সেই বি চৌধুরী এখন কঠিন জামায়াতবিরোধী। সেনাশাসক জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বি চৌধুরী এখন শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় এতটাই আত্মহারা যে, ত্রিরত্ন বলে তাঁকে মূল্যায়ন করছেন। বলছেন, তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম গর্বের সঙ্গে যেমন নিচ্ছেন, তেমনি তার নেতা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষক বলছেন, যেটি তার দীর্ঘ বিএনপির রাজনীতির সময়কালে বলেননি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার ৩৮ বছরের রাজনীতিতে বড় সাফল্য এখানেই এনেছেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর যারা বঙ্গবন্ধুকে অবহেলা করেছিলেন, কটাক্ষ করেছিলেন, সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষতই করেননি, শেখ মুজিব বলে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে নাম নিতেন, সেই তাদেরকে তার ছাতার নিচেই আনেননি, বিএনপির রাজনীতিকে এমন করুণ পরিণতির দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়েছেন যে, বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা যাকে নির্বাচিত করেছেন দেশের সেই কৃতী সন্তান সংবিধানপ্রণেতা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন আপাদমস্তক মুজিব-অন্তঃপ্রাণ রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুই তাঁর রাজনীতির আদর্শ পুরুষ। ঐক্যফ্রন্টের অন্য নেতারাও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তাঁর ডাকে রাজনীতিতে নিজেদের তৈরি করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাদের মনপ্রাণজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুুজিবুর রহমানই বাস করেন। তারা হলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু ও ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা, সাবেক ডাকসু ভিপি এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিকরা একমত হয়েছেন সংবিধানের আলোকেই তারা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে, সংসদ বহাল থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। নির্বাচনকালীন সরকার রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পাবে না। প্রশাসন নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। সেনাবাহিনী ২০০১ সালের মতো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাবে না। বাকি ৯টি সংসদ নির্বাচনের মতো স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন হবে।

সোমবার এরশাদের জাতীয় পার্টিও অভিন্ন কণ্ঠে আলাপ-আলোচনা করেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনের বৈঠকে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রথম দিনের সংলাপে সাত দফা দাবি উত্থাপন করলেও সরকার অবাধ সভা-সমাবেশের অনুমতি, নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ, রাজনৈতিকভাবে আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি বিবেচনায় নিলেও কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এই বলে নাকচ করেছে যে, এটি সরকারের বিষয় নয়, আদালতের বিষয়। সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবিকে সংবিধানসম্মত নয় বলে নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়াকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় বলে তাদের দায়িত্বে নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নাম বলতে পারবেন কিনাÑ এই প্রশ্ন তুলে দিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও প্রধানমন্ত্রী সংলাপের দরজা বন্ধ করেননি। ২৪ ঘণ্টা আগে পাওয়া অনুমতি নিয়ে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করতে মঙ্গলবার ঐক্যফ্রন্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করেছে। তাদের নেতা-কর্মীদের আটকও চলছে। সমাবেশ থেকে নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনা ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন নয়। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। খালেদা জিয়াকেও মুক্তি দিতে হবে। তার আগে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে সংবিধানের আলোকে সমঝোতা ফর্মুলা বের করার বৈঠক করেন। ঐক্যফ্রন্ট এখন তিনটি দাবি নিয়ে দ্বিতীয় দফা সংলাপে বসতে যাচ্ছে। এ তিনটি দফা হচ্ছে সংসদ ভেঙে দেওয়া, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলার রায় স্থগিত এবং নির্বাচনকালীন সরকারে টেকনোক্র্যাট কোটায় ঐক্যফ্রন্টকে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়া। যদিও এর আগে এ তিনটি ব্যাপারে মহাজোট অভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। এমনকি সরকার থেকে চলমান সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছে, সেখানে বুধবারের দ্বিতীয় দফার সংলাপে ঐক্যফ্রন্টকে ছাড় দেবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ছাড় দিলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বর্তমান সরকারের টেকনোক্র্যাট কোটার মন্ত্রীদের পদত্যাগ করাতেন না। অর্থাৎ সরকার ঐক্যফ্রন্টের এ তিন দফাও সংবিধানের দোহাই দিয়ে মানছে না। খালেদা জিয়াকে প্যারোলে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে দিয়ে ও রায় স্থগিত করে তাকে মুক্তি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে না। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি সরকার কোনোমতেই গ্রহণ করবে না বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।

এদিকে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। সেখানে সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করার অনুরোধ জানিয়ে এসেছে। যদিও নির্বাচন কমিশন ৮ নভেম্বর বুধবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার ও ঐক্যফ্রন্ট যদি যৌথভাবে অনুরোধ না জানায় তাহলে নির্বাচন কমিশন কখনই তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। আর নির্বাচন পিছিয়ে একদিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঝুঁকি অন্যদিকে সরকারবিরোধী ঐক্যফ্রন্টকে গণআন্দোলন গড়ে তোলা বা নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার মতো সুযোগ যে দেবে না, সেটি চোখ বন্ধ করে বলা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিন দফায় সরকারের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ ভেঙে গেলে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটবে নাকি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে ডিসেম্বরের ভোটে অংশগ্রহণ করবে।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তেমনি ঐক্যফ্রন্টও মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে দেশের উন্নয়নের অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দুই মহাশক্তির ভোট লড়াই হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এমনি পরিস্থিতিতে গণআন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দাবি আদায়ের মতো আলামত এখন ঐক্যফ্রন্টের অনুকূলে নয়। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, এবার বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেবেন না। এ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত সরকার ঐক্যফ্রন্টের কাছে নত হয়ে সমঝোতায় না এলে ভোটযুদ্ধের চ্যালেঞ্জই গ্রহণই করবে। দেশের মানুষ এখন কার্যত নির্বাচনমুখী। বিএনপির প্রার্থীরাও ভোটের মাঠে নেমে গেছেন। শেখ হাসিনা দলীয় এবং আসন সমঝোতা অনেকটাই করে ফেলেছেন। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দুই শক্তির ভোট লড়াই কি অনিবার্য? ঐক্যফ্রন্ট করতে গিয়ে বিএনপি জামায়াতকেই ছেড়ে আসেনি, একুশের গ্রেনেড হামলার রায়ে দন্ডিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অনেক নেতা যাবজ্জীবন থেকে ফাঁসির রায়ে দন্ডিত হলেও ঐক্যফ্রন্ট এটিকে তাদের ইস্যু করেনি। তবে বিএনপি শক্তিনির্ভর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভোটযুদ্ধে এলেও আন্দোলনের একটি প্রবল ঝাঁকুনি দেবে আর সরকারও সেখানে হার্ডলাইন নেবে। বুধবার নাটকীয় সমঝোতা না ঘটলে শেষ পর্যন্ত ভোটের লড়াই কোন পথে গড়ায় সেটিই দেখার বিষয়।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর