বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্যারিসে প্রত্যাবর্তন

আতাউর রহমান

প্যারিসে প্রত্যাবর্তন

ঘটনাটা ঘটেছিল সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবেই। সময়টা ১৯৯৫ সাল। আমি তখন উত্তরাঞ্চল, রাজশাহীর পোস্টমাস্টার জেনারেল। একদিন রাজশাহী এয়ারপোর্টে গেছি কাউকে বিদায় জানাতে। সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ ঘটল বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। তিনিও ছিলেন সেদিনের বিমানের যাত্রী। তা আমি সুযোগ পেয়ে তার সঙ্গে ফরাসি ভাষায় কিছু কথাবার্তা বলে আমার ফরাসি ভাষার বিদ্যাটা খানিকটা ঝালাই করে নিলাম। তিনি প্রশংসাসূচক মন্তব্য করতেই আমি সহাস্যে বলে উঠলাম, ‘ইওর এক্সেলেন্সি, আমি ভাষাটা শিখেছি প্রায় দুই দশক আগে ফ্রান্সে ফরাসি ডাক সংস্থার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে। আমি শুনেছি, অ্যাদ্দিনে ফরাসি ডাক সংস্থা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আমি যদি আপনার সানুগ্রহে আবার আপনার দেশে যেতে পারতাম তাহলে ওটা দেখে এসে আমার দেশে কাজে লাগাতে চেষ্টা করতাম।’ তাতেই কাজ হলো; অচিরেই তিন সপ্তাহের জন্য আমার প্যারিসে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

প্রসঙ্গত গল্পটা মনে পড়ে গেল। শুক্রবারে গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজের সময় ইমাম সাহেব বলেছিলেন, ‘তকদিরে থাকলেই হয়, নতুবা হয় না’। এটা শুনে গ্রামের একজন গরিব লোক বিয়েবাড়িতে গিয়ে বাড়ির পাশে কচু খেতে শুয়ে রইল; ভাবল তকদিরে থাকলে তাকে ওখান থেকে ডেকে নিয়ে খাইয়ে দেবে। তো দেখে যে খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ, তাকে কেউ ডাকছে না। তখন সে জোরে গলাখাঁকারি দিতেই লোকজন তাকে লক্ষ্য করে ডেকে নিয়ে আচ্ছাসে খইয়ে দিল। পরের শুক্রবারেও ইমাম সাহেব একই ওয়াজ করাকালে সে উঠে দাঁড়িয়ে আপত্তি জানাল, ‘হুজুর! তকদিরে থাকলে হয় বটে; তবে গলাখাঁকারি দিতে হয়।’ আমার বেলায়ও তাই ঘটল, গলাখাঁকারিতেই কাজ হলো।

সে যাই হোক। সরকারি চাকরিতে উৎকর্ষ সাধন ও পদোন্নতির জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। দুর্মুখরা অবশ্য বলেন যে, নরসুন্দর তথা নাপিত নাকি একসময় নর-নারীর ফোঁড়া ভালো কাটতে পারত এবং রোগীও আরোগ্য লাভ করত। কিন্তু তাকে যখন প্রশিক্ষণ দিয়ে মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরা সম্পর্কে শিখিয়ে দেওয়া হলো, তখন সে ভয়ে আর ফোঁড়া কাটতে পারে না। আর আমার এক দুর্মুখ অধস্তন সহকর্মী একাডেমিতে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে এসে বলেছিল, ‘স্যার! এত দিনে শিখলাম কীভাবে ফলস টিএ বিল প্রস্তুত করতে হয়।’ কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে আমলে সরাসরি নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বেলায় বিদেশে প্রশিক্ষণের একটা ভূমিকা থাকত, অন্তত তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক টিভি ও ফ্রিজ এবং ক্ষেত্রবিশেষ মোটরগাড়ি সে মাধ্যমে আসত। হাল আমলের ব্যাপারটা আমি অতটা জানি না।

১৯৭৮ সালের জানুয়ারির কোনো এক শীতার্ত সকালে প্লে­নে ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি হয়ে প্যারিসের ওরলি এয়ারপোর্টে আমি ও আমার এক সহকর্মী বন্ধু যখন পৌঁছেছিলাম, তখন ফরাসি ভাষার সমগ্র শব্দভান্ডারের মধ্যে আমাদের সংগ্রহে ছিল মাত্র দুটো শব্দ ‘বজুখ’ (শুভদিন বা সুপ্রভাত) ও ‘মেখ্সি’ (ধন্যবাদ) এবং তাও ভুল উচ্চারণে। সে যাত্রা ফ্রান্সে আমাদের মোট অবস্থানকাল ছিল সাড়ে সাত মাস সাড়ে তিন মাস প্যারিসের ২০০ মাইল দূরবর্তী ভিসি (Vichy) শহরে ভাষা শিক্ষার্থে ও চার মাস প্যারিসে প্রশিক্ষণার্থে।

ভিসির স্মৃতি আজও অবধি আমি ভুলিনি। তৎকালে মাত্র ৩৫ হাজার অধিবাসী অধ্যুষিত ওই ছোট্ট ছবির মতো তক্তকে-ঝকঝকে পর্যটক-মুখরিত শহরটির পাশ দিয়ে স্বদেশের নদীর মতোই একটি ছোট্ট পাহাড়ি নদী ‘লা আলিয়েখ’  কুলুকুলু রবে হৃদয়ের কী এক অপূর্ব গান গাইতে গাইতে কী জানি কোথায় ছুটে চলত। ভিসি একটা ঐতিহাসিক স্থান এবং স্বাস্থ্যনিবাসও বটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ফ্রান্স দখল করলে প্রেসিডেন্ট দ্যগল ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান আর হিটলার ফরাসি মার্শাল পেতার অধীনে ভিসিতে একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া ভিসির বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার ও স্পার খ্যাতি সে আমলেও ছিল পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত।

আর ভিসি তথা ফ্রান্সের লোকদের কুকুরপ্রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই বিভিন্ন প্রজাতির এক বা একাধিক পোষা কুকুর পরিদৃষ্ট হতো এবং সেগুলোর পরিচর্যা ও আদর-আপ্যায়নের বহর দেখে আমাদের রীতিমতো ঈর্ষা হতো। ওখানকার এক ভদ্রলোক আমাকে একবার ওদের কুকুরপ্রীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘দেখুন! এখনকার এই বিশ্বাসঘাতকতার দুনিয়ায় কুকুরই হচ্ছে মানুষের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু।’ তার এ কথাটা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে গেল সেদিন ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর পাতায় সহযোগী কলামিস্টের ‘একটি ক্ষুধার্ত কুকুরের অনন্য মহানুভবতা’ শীর্ষক নিবন্ধটি পাঠ করে। ওখানে তিনি বর্ণনা করেছেন, খোদ রাজধানীর সচিবালয়ের পাশে রাস্তায় চিত হয়ে শায়িত পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসহায় ক্ষুধার্ত লোকটির বুকের ওপর রক্ষিত বিরিয়ানির প্যাকেট প্রাণান্ত প্রচেষ্টায়ও সে যখন হাত বুকের ওপর নিয়ে বিরিয়ানি খেতে পারছিল না এবং পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী পথচারীদের কেউ তার দিকে তাকাচ্ছিলও না, তখন রাস্তার একটি কুকুর তার পাশে বসে বোধকরি মানুষের সাহায্যের আশায় করুণ সুরে কান্না শুরু করে দিল। কী সকরুণ দৃশ্য! কী রূঢ় বাস্তবতার প্রতিফলন।

যাকগে সে কথা। আমাদের কাছে ভিসিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠানটি। যেটাকে সংক্ষেপে বলা হতো ‘কাবিলাম’ (CAVILAM=Centre Audio-Visual de Langues Sloderne), ওটা ছিল যেন সত্যিকার অর্থে বিশ্ব-মিলন কেন্দ্র। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ, যথা মিসর, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া, উগান্ডা, জাপান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে আমরা ফরাসি সরকারের বৃত্তিধারী বিভিন্ন পেশার লোক ওখানে হাতে-কলমে ফরাসি ভাষা শিখছিলাম প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচ দিন। সতীর্থ সবার কথা আলাদাভাবে লিখতে হলে সাতকাহন হয়ে যাবে। তবে কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় সতীর্থ ইরাকের অধ্যাপক ফুয়াদ সাল্লুম, জীববিজ্ঞানী কায়েস আবদেল রহমান ও আণবিক বিজ্ঞানী হাসান আল-হাসান আর লিবিয়ার গাদ্দাফিবিরোধী বিপ্লবের সময় লিবিয়ার আমলা সাইদ আল-সাইদের কথা আমার মনে পড়ে প্রশ্ন জাগে ‘বন্ধুরা! তোমরা কেমন আছো? কোথায় আছো? বেঁচে আছো তো?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ইয়েমেন থেকে আগত কাবিলামে সতীর্থ সুদর্শনা নাবিলা আলী আহমদের কথাও মনে আছে একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা ছিল খুব কঠিন ব্যাপার। কারণ সে ইংরেজি প্রায় জানতই না, আর ফরাসি ভাষাটা তো সবে আমরা শিখছিলাম। সে মিস না মিসেস আমরা কিছুই জানতাম না। তো একদিন ক্লাসে সে আমার পাশের চেয়ারটায় বসেছে।

আমি কৌতূহল চরিতার্থে তাকে ইংরেজিতে বললাম ‘হু ইজ আলী আহমেদ?’ অর্থাৎ আমি জানতে চেয়েছিলাম তার নামের শেষাংশে জড়ানো মি. আলী আহমেদ তার পিতা না স্বামী। তার বলার কথা ছিল ‘মাই ফাদার’, কিন্তু সে অনেক কষ্টে বলে উঠল, ‘ইওর ফাদার’!  আমার পক্ষে তখন হাসি সংবরণ করা খুব কষ্টকরই ছিল এবং পরবর্তীতে আমার সহকর্মী-বন্ধু এটা শুনে ফোড়ন কেটেছিলেন, ‘সে বোধকরি বলতে চেয়েছিল ইওর ফাদার-ইন-ল; ইন-ল টুকু উহ্য থেকে গেছে, এই আর কি! দুর্ভাগ্যবশত আমার এই সহকর্মী-বন্ধুটি সম্প্রতি এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন আর কাবিলামে আমাদের আগে থেকেই পড়ত হাসনাত নামের একজন বাংলাদেশি ছাত্রী। মেয়েটি ফ্রান্সের ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে একাকী ধুঁকে মরছিল, ওর ত্রিসীমানায় কোনো বাঙালি ছিল না, যার সঙ্গে সে দুদ- মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে। তো আমরা যেদিন কাবিলামে ভর্তি হলাম আমাদের পরিচয় জানতে পেরে সে বাসস্থানে ফিরে গিয়ে তার কৃষ্ণাঙ্গী রুমমেটকে নাকি বলছিল, ‘ভিসিতে আজ আমার সবচাইতে আনন্দের দিন। দুজন বাংলাদেশি এসেছেন যাদের সঙ্গে আমি মনের সুখে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারব।’ পরবর্তীতে হাসনাতের রুমমেট থেকে কথাটা জানতে পেরে আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল স্বদেশে সংঘটিত একটি মজার ঘটনা

আমাদের বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার যখন মহকুমা, তখন গুটিকয় উঠতি বয়সের ছেলে শহরের এক বাড়িতে নারিকেল চুরি করতে গেছে। একজন উঠেছে গাছে আর অন্যরা নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। হঠাৎ গাছে আরোহী ছেলেটি গৃহস্বামী জেগে উঠেছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি করে নামতে গিয়ে পা পিছলে একেবারে পপাত ধরণিতল। সেই সঙ্গে সে ব্যথাও পেয়েছে প্রচুর। আর ব্যথা পেলে মানুষের কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তার সাথীরা তাকে কাঁদতে দেবে কেন? কাঁদলে যে বিপদ হতে পারে। তাই ওরা হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরেছে। সে অনেক কষ্টে মুখের ওপর থেকে হাতগুলো সরিয়ে ফিস্ফিস্ করে বলল, ‘আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও; আমি কাঁদব।’ হা-হা-হা!

অবশেষে ভিসিতে হোটেল সিলভিয়ার মালিক আমাদের ল্যান্ডলেডি মাদাম দাও-এর কথা লিখতেই হয়। তিন কুলে কেউ নেই এমন একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধা যিনি নিজেও হোটেলের এক রুমেই অবস্থান করে কমন কিচেনে পাক করে খান, তাকে দেখে স্বদেশে রেখে যাওয়া আমার নিজের মায়ের কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ে গিয়েছিল। সিলভিয়ায় অবস্থানকারী প্রায় সবাই ছিল কাবিলামের শিক্ষার্থী এবং সবাই তাকে ‘মা’মি’ বলে সম্বোধন করছে দেখে আমিও মা’মি ডাকতে শুরু করে দিলাম। কিছুদিনের মধ্যে মাদাম দাও যে সত্যিকারভাবেই তাঁর স্হেহের উষ্ণ পরশ দিয়ে আমার মায়ের সাময়িক শূন্য আসনটা দখল করে নেবেন তা কে জানত। আমি অনেক সময় অযাচিতভাবে তাকে ছোটখাটো ব্যাপারে সাহায্য করতাম বিধায় তিনি বলতেন ‘ভুজেত আঁ বোঁ মুসলমাঁ’; অর্থাৎ ‘আপনি হচ্ছেন একজন ভালো মুসলমান।’ পরম পরিতাপের বিষয়, বছর কয়েক পরে লন্ডন থেকে ফ্রান্সে সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়ে ভিসিতে মাদাম দাওকে দেখতে গিয়ে পাইনি, তদ্দিনে তিনি ইহলোকের মায়া সাঙ্গ করে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। তাকে শেষবারের মতো দেখার আমার ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে গেল।

লেখক : রম্য লেখক

ডাক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর