বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইতিহাসের সেই কালো দিন

ফিরে দেখা : ৭ নভেম্বরের অন্য এক নৃশংসতার অনুসন্ধানে

ফখরে আলম

ফিরে দেখা : ৭ নভেম্বরের অন্য এক নৃশংসতার অনুসন্ধানে

১৫ অক্টোবর, ১৯৯৬। আমার এক বন্ধু স্বপন গল্পে গল্পে বললেন, তার আত্মীয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের বড় কর্মকর্তা মনিরুল আলমসহ চার কর্মকর্তাকে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর টিভি ভবনে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বিস্তারিত বলতে পারেন না। তবে অনুরোধ করেন বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার। মনিরুল আলমের স্ত্রীর ঠিকানা দেন, তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

আমি যশোর থেকে ঢাকা রওনা দিই। ঢাকা পৌঁছে বিষয়টি নিয়ে বাংলাবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসানের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনা সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।’ পরদিন, সকালে হাঁটতে হাঁটতে মোহাম্মদপুরে রাস্তা পার হয়ে মনিরুল আলমের বাড়ি পৌঁছাই। বাড়িতে তার স্ত্রী আনোয়ারা আলম, ছেলে  জাভেদ ছিলেন। তাদের কাছে পরিচয় দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই। আনোয়ারা আলম আমি যশোর থেকে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে এসেছি শুনে বিরক্ত বোধ করেন। তিনি বলেন, ‘২০ বছর পার হলো এ বিষয়ে তো কেউ আমার কাছে খবর নিতে আসেনি?’ তার কাছ থেকে জানা যায়, মনিরুল আলম সাংবাদিক ছিলেন। বিচিত্রা, মর্নিং নিউজে কাজ করেছেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ডিআইটি ভবনে এ দেশে টিভি নেটওয়ার্ক শুরুর দিন থেকে কাজ করার পাশাপাশি উদ্বোধনের দিনের প্রায় সব অনুষ্ঠান তিনিই প্রযোজনা করেছেন। তার কাছ থেকে আরও জানা গেল, ৭ নভেম্বর অফিস চলাকালে মনিরুল আলমের সঙ্গে আকমল খান, ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী ও এ এফ এম সিদ্দিক টিভি কর্মকর্তাদেরও হত্যা করা হয়।

প্রগতিশীল এই চার কর্মকর্তাকে টিভির একটি দুষ্টচক্র সেনাবাহিনীর সহায়তায় হত্যা করে। মনিরুল আলম টিভির উপ-মহাপরিচালক ছিলেন। মানুষের চাঁদে যাওয়ার দৃশ্য তিনিই কায়দা-কানুন করে টিভিতে দেখিয়েছেন। আনোয়ারা আলম কথা বলে ভারমুক্ত হলেন। বললেন, ‘টিভির কোথাও তার নাম নেই। ভাই! অনেক দুঃখকষ্ট করে তিনটি এতিম ছেলেকে মানুষ করেছি। কোনো আর্থিক সহায়তা পাইনি।’ আমি হাঁটতে হাঁটতে তাজমহল রোড থেকে বাংলাবাজার পত্রিকা অফিসে যাই। কী বিচিত্র সেলুকাস! সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, কোনো বিচার নেই। বড় বড় সাংবাদিকরা এ বিষয়ে নিশ্চুপ! আমি টিভি ভবনে গিয়ে বিষয়টির খোঁজখবর করি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। বাংলাবাজারের বার্তা সম্পাদক ফারুক ভাইকেও বলি। তিনি বললেন, ‘ডকুমেন্টস জোগাড় করেন।’ আমি অনেক চেষ্টার পর একটি চিঠি সংগ্রহ করি। টিভির তৎকালীন ডিজি আমিরুজ্জামান ১০ ফেব্র“য়ারি, ১৯৭৬ তারিখে মনিরুল আলমের স্ত্রীকে লিখেছেন, ‘আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।’ আমি চিঠিসহ এ বিষয়ে রিপোর্ট লিখে বার্তা সম্পাদকের কাছে জমা দিই। পরদিন ২০ অক্টোবর চিঠিসহ প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় ‘৭ নভেম্বরের ঘটনায় নিহত টিভি কর্মকর্তা মনিরুল আলমের স্ত্রী ও সন্তানরা বিচার চান।’ পরদিন সকালে অফিসে পৌঁছালে পত্রিকা ব্যবস্থাপক তোফায়েল ভাই আমাকে বললেন, ‘ফখরে ভাই! অফিস গরম। খবর আছে।’ আমি বোকার মতো ফারুক ভাইয়ের টেবিলের সামনে গিয়ে বসে  থাকি। তিনি জানান, ‘মতিউর রহমান চৌধুরীকে (সম্পাদক) তথ্যমন্ত্রী ফোন করেছেন। মনিরুল আলমের স্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। আপনার ভয় নেই।’ তারপর মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। মামলা পুনরুজ্জীবিত। আসামি আটক। মাসিক আর্থিক অনুদান। টিভিতে প্রথমবারের মতো ঘটনা প্রচার আরও কত কী। আমি বাড়ি ফিরি। ঈদে একটি প্যাকেট পাই মনিরুল আলমের স্ত্রী পাঠিয়েছেন। কী সুন্দর জামা। ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আপনি আমার ভাই। জামাটি বোন দিয়েছে।’

 

লেখক :  সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর