বৃহস্পতিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কৈশোর থেকেই প্রয়োজন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা

ফাতিমা পারভীন

কৈশোর থেকেই প্রয়োজন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা

ধর্মীয়, সামাজিক বিভিন্ন কারণে কৈশোরকালে ছেলেমেয়েরা স্বভাবতই লাজুক, অন্তরমুখী ও মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল থাকে। তাদের দৈনন্দিন চাহিদার ব্যাপারে অভিভাবকরা সচেতন থাকলেও তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ তুলনামূলক কম পাচ্ছে। গ্রামের মায়েদের হাসপাতালের প্রতি এক ধরনের বিরূপ মনোভাব রয়েছে। ফলে গর্ভবতী মা ও শিশুরা শুরুতেই পুষ্টিহীনতায় ভোগেন। এসব নারী একইসঙ্গে সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মূলত গর্ভাবস্থায় দরিদ্র ও গ্রামীণ নারীদের মাত্র ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান আর মাত্র ১৮ শতাংশ নারী দক্ষ ধাত্রীসেবা পান। দরিদ্র নারীদের মৃত্যুহারও বেশি। অসুস্থ হলে বহু নারী চিকিৎসা নামক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন নারীবিরোধী প্রথার কারণে। আবার চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসকের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ। দেশের হাসপাতালগুলোয় নেই নারীবান্ধব পরিবেশ। সরকারের হিসাব অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৯৯৪। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে ২ হাজার ৮০৭ জন নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশের মোট চিকিৎসকের ৪১ শতাংশের পদ শূন্য রয়েছে।

আমাদের দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্জন নেই। এ অবস্থায় নজরদারি, জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সারা দেশে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের অবস্থান চরম প্রতিকূলতায়। তার পরও বেঁচে আছে নারী। শুধু যে গ্রামীণ বধূরাই এ সমস্যার মোকাবিলা করেন তা কিন্তু নয়, শহরের নারীরাও অভিন্ন প্রতিকূলতার শিকার। শহরে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর বসবাসের দালানগুলোয় দেখা যায় অল্প জায়গায় সংকুচিত পরিবেশে তারা বসবাস করছেন। গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত গড়ে উঠেছে অল্প জায়গায়। নারীর স্বাস্থ্যবিধির পরিবেশ বজায় রেখে কোনো প্রতিষ্ঠানই আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ পুষ্টিতে পিছিয়ে। পুষ্টি খাতের দুরবস্থা উত্তরণে আরও অনেক কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পুষ্টি কার্যক্রমের সমন্বয় শক্তিশালী করার পাশাপাশি মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপরোচকেও শক্তিশালী করতে হবে। আর এ সেক্টরের প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নজরদারিও জরুরি। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির প্রোগ্রাম থেকে জানা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ৪৩ শতাংশ বয়স অনুযায়ী লম্বা হয় না। ৪১ শতাংশ শিশুর বয়সের চেয়ে ওজন কম। বাংলাদেশে প্রচুর পুষ্টিযুক্ত খাবার পাওয়া গেলেও সেগুলো দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তাই দরিদ্র মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এখনো এ দেশের ৩৩ শতাংশ শিশু পুষ্টিহীনতা নিয়ে জম্ম  গ্রহণ করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এ দেশের স্বাস্থ্যসেবার কয়েকটি ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছে; যা বিশ্বের কাছে উদাহরণ দেওয়ার মতো। তবে শতভাগ সাফল্য পেতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সাফল্য ব্যাপক হলেও আজও গ্রামীণ নারীরা সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্যপ্রবাহের অভাবে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্যজ্ঞানের ক্ষেত্রে সীমিত অবস্থানে রয়েছে।  ঋতুুস্রাব নিয়ে এখনো সমাজে নানা ধরনের কুসংস্কার ও ট্যাবু আছে। একটি বিশেষ জরিপে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ ছাত্রী ঋতুুস্রাবের কারণে গড়ে মাসে তিন দিন স্কুলে যেতে পারে না। অন্যদিকে ৩৮ শতাংশ কিশোরী ও এবং ৪৮ শতাংশ বয়স্ক নারীকে ঋতুস্রাবের সময় ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। সমাজে এখনো ঋতুস্রাবের বিষয়টি লুকিয়ে রাখার বিষয় হয়ে আছে। তাই ৪৯ শতাংশ নারী ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহার করা কাপড় শুকানোর জন্য ঘরের অন্ধকার বা গোপন স্থান বেছে নেয়। ঋতুস্রাবের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মতো তথ্য পাওয়া আমাদের দেশে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য না জানার কারণে জীবনে প্রথমবার ঋতুস্রাবের সময় অনেক কিশোরী ভয় পায়। ঋতুস্রাবের সময় স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা না থাকলে নারী ও কিশোরী নানা সংক্রমণের শিকার হয়। সংক্রমণ দীর্ঘদিনের হলে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা থেকে বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।

তাই প্রতিটি হাসপাতালে কিশোরীদের জন্য আলাদা একটি কর্নার রাখা প্রয়োজন। আবার দেখা যায় অধিকাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায় কোনো না কোনো কারণে। তাই যে পর্যন্ত না বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে সে পর্যন্ত অন্তত বয়সোপযোগী জম্ম  নিরোধক বড়ি থাকা দরকার। তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী উপযুক্ত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা কী হতে পারে, কোন সময় থেকে সেই শিক্ষা দিতে হবে সে বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।  বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।  দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে দেশ আজ নিম্ন মধ্য আয়ের কাতারে ঠাঁই করে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দেশ। হাতের মুঠোয় আজ বিশ্ব। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আজ কম্পিউটার চালিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করে মুহূর্তে। ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, ওয়াচঅ্যাপের ছোঁয়া লাগেনি এমন কোনো গ্রাম নেই। একদিন স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কৈশোর থেকেই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হোক সে আশা কি আমরা করতে পারি না?

লেখক : শিশু ও নারী অধিকার কর্মী

Email:[email protected]

সর্বশেষ খবর