শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পাঁচালি

গোলাম মাওলা রনি

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পাঁচালি

বাংলাদেশের রাজনীতিসচেতন অন্যান্য লোকজনের মতো আমিও এ মুহূর্তে নিদারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আশা-নিরাশা ও অস্থিরতার মধ্যে সময় অতিবাহিত করে চলেছি। মূলত, জাতীয় রাজনীতির অনিশ্চয়তা ও গুমোট ভাব এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিভিন্ন সমীকরণ নিয়ে আমার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। রাজনীতির সদর-অন্দরের নানামুখী কৌশল ও অপকৌশলের মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষ যেভাবে তৎপরতা শুরু করেছে তাতে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু চোখে পড়ছে না। সরকার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। অন্যদিকে, দেশের প্রধানতম বিরোধী দল তাদের নতুন ও পুরনো মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্রদের হটিয়ে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নানামুখী কৌশল নিয়ে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা আন্দাজ করতে পারছে না। কারণ কোনো দলই রাজনীতির সাধারণ ব্যাকরণ মানছে না। তারা সবাই সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে যার যার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অতীতের মতো এমনভাবে কর্মকা- শুরু করেছে যা সাধারণ মানুষকে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

সাম্প্রতিককালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্যফ্রন্টের কর্মকান্ডের মধ্যেই আপনি সরকারি ও বিরোধী দলের কিছু গোপন ও প্রকাশ্য তৎপরতার নজির খুঁজে পাবেন। সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে একদিকে যেমন নির্বাচনী যুদ্ধে জয়লাভের নতুন নতুন পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছে তেমনি নিজেদের অজান্তে পরাজয়ের উপাদান ও উপকরণ সৃষ্টি করে চলেছে। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীনদের তাপ, চাপ ও কূটকৌশলে বিপর্যস্ত হয়ে একদিকে যেমন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তেমনি প্রকৃতির নিয়মে রুখে দাঁড়ানো এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত ও অভিনব সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে চলেছে। আমরা সবাই জানি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ক্ষমতা এবং উচ্চাশার কারণে মানুষের বুদ্ধিনাশ ঘটে। বিবেকের দরজা ছোট হতে থাকে এবং কর্মস্পৃহা ও দক্ষতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে, বিপদাপদ ও বালামুসিবতে পড়লে মানুষের ধৈর্য ও সহ্যশক্তি বেড়ে যায়। তাদের বুদ্ধির দরজা খুলে যায়, বিবেকবোধ জাগ্রত আর চিত্ত প্রসারিত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দেশের দুটো শক্তিশালী রাজনৈতিক জোট যখন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে থেকে উল্লিখিত সমীকরণে লড়াই-সংগ্রাম চালাচ্ছে তখন পরিস্থিতি কী হতে পারে তা অতীতকালের বহু রাজনৈতিক ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।

সরকারি দল ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বিগত দিনে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা-কে প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা আরও বিশ্বাস করে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাদের মতে, জনগণের প্রবল আস্থা রয়েছে শেখ হাসিনার প্রতি। তার কোমলতা ও কঠোরতা, তার নেতৃত্ব-গুণ এবং বংশজাত আভিজাত্যের কারণে দেশের জনগণ তাকে এমন একটি স্থানে ধারণ করে যেখানে সমকালীন বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কোনো জায়গা নেই। অধিকন্তু, প্রধানমন্ত্রী তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের টানাপড়েন, উত্থান-পতন ও তিন মেয়াদে মোট ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনটিতে পৌঁছানোর জন্য এবং পরবর্তীতে সেই আসনে টিকে থাকার জন্য যে লড়াই-সংগ্রাম করছেন তাতে তার বিচক্ষণতার স্তর এমন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে যা স্পর্শ করার ক্ষমতা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবৃন্দের নেই। তিনি তার কর্মগুণে নিজ দলের নীলকণ্ঠ এবং তার আদর্শের সৈনিকদের কাছে পরশ পাথরে পরিণত হয়েছেন। ফলে তার ইমেজ ব্যবহার করে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদ ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে দলটির নেতা-কর্মীদের মনমানসিকতা ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, দলীয় সংসদ সদস্য এবং অন্য জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রিবর্গ, সরকারের দলবাজ ও দলদাস আমলাবৃন্দ, দলীয় সুবিধাভোগী লুটেরা ও দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে দেশের বিরোধী দলসমূহের শতসহ অভিযোগ থাকলেও ব্যক্তি শেখ হাসিনার গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব কেউ অস্বীকার করে না। এমনকি তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও বিরোধী দল প্রকাশ্যে বিরূপ মন্তব্য করে না, যদিও অনেকে গোপনে কিংবা ছদ্মনামে সামাজিক মাধ্যমসমূহে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল বর্তমানের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তাদের আক্রমণের তীর সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দিকে নিক্ষেপ না করে তার সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ করে ছোড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইমেজ ও জনপ্রিয়তা কেবল তার দুটো একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থে সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে কাজ করবে। প্রথমটি হলো, প্রধানমন্ত্রী যে সংসদীয় আসনে প্রার্থী হবেন সেখানকার নির্বাচনে বিজয়ী হতে তার ইমেজ সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, তার দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তবে আপন দলের সভানেত্রী, সংসদীয় দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে তিনি আগের চেয়েও অধিক প্রভাব নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। বিরোধী দল মনে করছে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- যেগুলোকে তারা মাইলফলক হিসেবে প্রচার করছে সেগুলো একাদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়নকে স্থানীয় পর্যায়ের ভোটারকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যে দেশপ্রেম, সচেতনতা, উন্নত মানমানসিকতা ও শিক্ষা দরকার তা এখনো বাংলাদেশের আপামর জনগণ অর্জন করতে পারেনি। পশ্চিমা দুনিয়ার ভোটাররা অনেক সময় একটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্য সরকারকে ভোট দেয়; আবার একজন মন্ত্রীর অপকর্মের জন্য পুরো সরকারকে পর্যন্ত ডুবতে হয়। বাংলাদেশে যেহেতু উল্লিখিত অবস্থা নেই সেহেতু পদ্মা সেতু, উড়ালসড়ক, ফ্লাইওভার ইত্যাদি জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়ন নিয়ে তৃণমূলের লোকজন মাথা ঘামাবে না। তারা স্থানীয় সরকারদলীয় লোকজনের আচার-আচরণ, দুর্নীতি ও কুকর্মের ওপর অবশ্যই জাতীয় উন্নয়ন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তি ইমেজকে প্রাধান্য দেবে না। পঞ্চগড়ের মানুষের স্থানীয় সমস্যা আর কুড়িগ্রামের স্থানীয় সমস্যা যেমন এক নয়; তেমনি দক্ষিণবঙ্গের নির্বাচন ও ভোটের হিসাব থেকে সিলেট বিভাগের ভোটের হিসাব আলাদা, কাজেই বিরোধী দলগুলো সংসদীয় আসনকে টার্গেট করে স্থানীয় পর্যায়ে একধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডা ও জাতীয়ভাবে অন্য ধরনের প্রপাগান্ডা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সুকৌশলে এগোচ্ছে। বিরোধী দলের গবেষক দলের মতে, এ দেশের লোকজন সত্য কথা ও নির্মম বাস্তবতার কাহিনী শোনার চেয়ে মিথ্যা গল্পগুজব বেশি পছন্দ করে। তারা সব সময় নতুন ও ব্যতিক্রমী কিছু শোনা বা দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। তারা নেতা হিসেবে কখনো তাদের মতো সাধারণ কোনো মানুষকে পছন্দ করে না। তারা মনে করে নেতাকে হতে হবে সবার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, ক্ষমতাধর এবং সুন্দর স্বাস্থ্যসুরতের অধিকারী। জনগণের এ অদ্ভুত মনমানসিকতার জন্য শত শত বছর ধরে আমাদের রাজনীতিতে যখনই ব্যতিক্রমী কোনো ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে তখন জনগণ শর্তহীনভাবে নিজেদের আনুগত্য, সমর্থন ও ভক্তি-শ্রদ্ধা দিয়ে নেতাদের ভূষিত করেছে। আমাদের এ ভূখ-ের শত বছরের ইতিহাসে কেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, আইয়ুব খান, ফাতিমা জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ইন্দিরা গান্ধী, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া মানুষের কাছে আলাদা আবেগ ও অনুভূতির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তা বিবেচনা করতে গিয়ে গবেষকরা প্রথমেই তাদের শারীরিক গঠন, গায়ের রং ও চলাফেরার স্টাইলকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েছেন। আজকের দিনে আমরা অনেকেই পাকিস্তানের সমালোচনা করি। সামরিক শাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে আইয়ুব খানের সমালোচনা করি। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, বাংলার ইতিহাসের এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ গণজমায়েত হয়েছিল সেদিন যেদিন আইয়ুব খান ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তাকে দেখার পর সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষ খুব খুশি হয়েছিল এবং বলেছিল রাজা-বাদশাহদের এমন সুন্দর না হলে কি চলে! প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল ফাতিমা জিন্নাহর ক্ষেত্রে। লাখ লাখ সাধারণ মানুষ সেবার জড়ো হয়ে তাকে এ জাতির মা হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসনামলে যখন ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তখনো সারা বাংলাদেশে ধন্য ধন্য রব পড়ে গিয়েছিল তার দৈহিক গঠন, ব্যক্তিত্ব ও অভিব্যক্তির কারণে। অন্যদিকে বঙ্গবীর ওসমানীকে যখন দাঁড় করানো হয়েছিল দলীয় প্রার্থীরূপে তখন তা জনমানসে কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। অধিকন্তু অনেককে হতাশ হতে দেখা গেছে। জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে আমার নিজেরও রয়েছে একটি হতাশামূলক অভিজ্ঞতা। তিনি যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরূপে ফরিদপুরের সদরপুরে জনসভা করতে গেলেন তখন সমগ্র জনপদে গুজব রটে গেল, ওসমানী সাহেব আসছেন যার রয়েছে এক হাত লম্বা আকৃ-তির মোচ। গ্রামগঞ্জের সর্বত্র শুরু হয়ে গেল মোচকেন্দ্রিক আলোচনা। এত বড় মোচ কীভাবে হলো সেই মোচে কীভাবে তা দেওয়া হয়। কীভাবে পাকিস্তানি সেনারা মোচ দেখে হার্টফেল করে মারা যেত এমনতর অনেক গল্পগুজবে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের গ্রামের শত শত উৎসুক ছেলে-বুড়ো ও মহিলা জেনারেল ওসমানীকে দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ছোটখাটো আকৃতি ও ছিমছাম গঠনের সঙ্গে কিঞ্চিৎ বড় আকৃতির মোচ দেখে লোকজন যারপরনাই হতাশ হয়ে যার যার বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের জনগণের উল্লিখিত মনমানসিকতাকে সেটারালাইজড করার জন্যই বিএনপি নেতৃত্ব যে কোনো মূল্যে ড. কামালকে রাজি করিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়ার জন্য। তারা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখকে দলে ভিড়িয়েছেন বহু হিসাব-নিকাশ করার পর। তাদের মতে, ড. কামালের মধ্যে কতগুলো অদ্ভুত গুণ রয়েছে। তিনি সাধারণত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তার মেধা ও যোগ্যতাকে বিশেষভাবে কাজে লাগাতে পারেন। অন্যদিকে ক্ষমতার তাঁবেদারি করা, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার বলয়ে মাথা নত করার ইতিহাস তার নেই। আওয়ামী লীগের মহাবিপদে তিনি যে সাহস-শক্তি নিয়ে দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরূপে সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছিলেন তখন বড় কথা বলা সুবিধাভোগীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল, নতুবা মোশতাক-জিয়া সরকারের তাঁবেদারি করে আত্মরক্ষা করেছিল। কেউ কেউ অবশ্য জেলে ছিলেন। পরবর্তীকালে এরশাদ জমানা এবং নব্বই-পরবর্তী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমলে তিনি সর্বদাই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেই নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। আমাদের দেশের গত পঞ্চাশ বছরের সব জাতীয় রাজনৈতিক সংকটকালে সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তি ড. কামালের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্বের সাহায্য নিয়েছেন অকাতরে। বিনিময়ে তিনি কাউকে ছোট করেননি বা খোঁটা দিয়ে কথা বলেননি।

বিএনপি নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেনের উল্লিখিত গুণাবলি পুঁজি করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ভাবমূর্তি, সাংগঠনিক ক্ষমতা, সাহস ও বাগ্মিতাকে যেমন কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছিল তেমনি আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখের বাগ্মিতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও সাহসকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছিল বহুদিন থেকেই। অন্যদিকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি এনজিও, দাতা সংস্থা এবং দেশের ডানপন্থি বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছিল কয়েক বছর ধরে। তারা ডা. বি. চৌধুরীকে নিয়েও ইতিবাচক চেষ্টা করেছিল কিন্তু মাহী বি. চৌধুরীর ব্যাপারে বিএনপির প্রভাবশালী মহলের বিরাগ ও বিএনপির একই মহল সম্পর্কে মাহীর অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারাকে হিসাবের বাইরে রেখেই তারা চূড়ান্তভাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করে। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি নতুন লাগলেও রাজনৈতিক সচেতন লোকজন বেশ ভালো করেই জানে যে, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই বিএনপি নেতৃত্ব ঐক্যফ্রন্টের ধারণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল।

ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা বিষয়টিকে প্রথমে পাত্তাই দিতে চাননি। উপরোক্ত তাদের অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাসাধ্যভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ঠাট্টা মশকরামূলক নানান বাক্যবাণে জর্জরিত করে ঐক্যফ্রন্ট প্রক্রিয়াকে গুরুত্বহীন প্রমাণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে ঐক্যফ্রন্ট নেতৃত্ব সরকারকে নিজেদের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে ঐক্যফ্রন্টকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মোর্চাকে টার্গেট করেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জোটকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্বাচনী ছক কষতে হচ্ছে। অপেক্ষা- কৃত জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, ভোটের বাতাস নিজেদের পক্ষে রাখাসহ বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ সরকারবিরোধী মোর্চা দশ মুখে প্রচার করতে শুরু করেছে যে, ক্ষমতার কৌশলগত দেশি-বিদেশি সূত্রগুলোর সঙ্গে তাদেরও ইতিবাচক সংযোগ ও সবুজ সংকেত রয়েছে। এ অবস্থায় শাসক দলের দুর্বলচিত্তের সুবিধাভোগীরা এমন অস্থিরতা দেখাচ্ছেন তা যদি দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকে তবে ভোটের মাঠ তাদের প্রতিকূলে চলে যাবে।

সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আর মাত্র ৩৮ দিন বাকি আছে। এ সময়ের মধ্যে যাবতীয় রুটিনকর্ম সম্পাদনের পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্টের অগ্রগতি রুখে দিতে না পারলে সার্বিক পরিস্থিতি যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না তার কিছু আলামত ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। গত পাঁচ বছরের চিরচেনা সুর পাল্টে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা নতুন সুরে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। তারা যেভাবে সরকারকে আক্রমণ করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন তা অনেক ক্ষেত্রে হুমকি-ধমকিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে যদি এগোতে থাকে তবে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়বে এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হয়ে রাস্তায় নেমে আসবেন; যা শেষমেশ নির্বাচনী ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলবে। ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের নজিরবিহীনভাবে ধমকিয়ে এসেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপেও বিগত পাঁচ বছরের জড়তা কাটিয়ে অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক সাহস দেখিয়েছেন; যা ক্ষমতাসীনদের অনেকটা ভাবিয়ে তুলেছে। ফলে ঐক্যফ্রন্টের কিছু নেতার বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও তাদের মিত্রজোটের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন-নিবেদন জানাচ্ছেন।

উল্লিখিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার যদি তাদের চিরপরিচিত থেরাপিগুলো নির্বাচনপূর্ব ক্রান্তিকালে প্রয়োগ শুরু করে তবে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারবে না। অন্যদিকে, বিরোধী দল যদি তাদের দাবি আদায়ের জন্য অতীতকালের মতো লড়াই-সংগ্রাম, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি শুরু করে তবে জাতির কপালে কী দুর্ভোগ-দুর্দশা নেমে আসতে পারে সেসবের খতিয়ানও মেলানো যাচ্ছে না। অতীতকালের বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা ও চক্রান্তের জালে আটকে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না যে, জাতীয় জীবনের দম ফাটানো পরবর্তী ৩৮ দিন কীভাবে অতিবাহিত হবে। আমাদের সবার জন্য সবচেয়ে বড় বিপত্তির কারণ হলো আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না এবং আস্থার সংকটে ভুগছি। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে বিশ্বাস করছে না, তারা তাদের পেশিশক্তি ও কৌশলকে জনমতের ওপর বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক পক্ষগুলোও কেউ কাউকে বিশ্বাস তো করছেই না, অধিকন্তু পরস্পরকে যমের মতো ভয় করছে। ক্ষমতাসীনরা মনে করছেন, তারা ক্ষমতা হারালে সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা পড়বে এবং তাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। অন্যদিকে, বিরোধী দলও প্রায়ই একই শঙ্কায় আতঙ্কিত দিন পার করছে। সাধারণ জনজীবন, সরকারি অফিস-আদালত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। ফলে জাতীয় উন্নয়ন অনেকটা থেমে পড়েছে, যা কিনা সব মহলকেই একধরনের অনিশ্চয়তা ও অজানা আশঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর