রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফেলে আসা সেই দিনগুলো

মাকিদ হায়দার

ফেলে আসা সেই দিনগুলো

পঞ্চাশের দশকের অনেক আগে থেকেই আসামের অসমীয়রা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের তাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, বিশেষত দেশ ভাগ হওয়ার অনেক বছর আগেই পূর্ববঙ্গের যেসব বাঙালি মুসলমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রংপুর, সিরাজগঞ্জ থেকে আসামের শিলচর, কাছাড়, করিমগঞ্জসহ অন্যত্র গিয়ে বনজঙ্গল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং বন্যশূকর, হাতি, বাঘের উপদ্রবকে উপেক্ষা করে নিজেদের জীবন তুচ্ছজ্ঞান করে বসতি স্থাপন এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি চালু করেছিলেন। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে তাদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। চরাঞ্চলের চীনবাদাম, বনের কাঠ, রবিশস্যসহ অন্যান্য ব্যবসায় আসামের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণরা যেমন ছিলেন তেমনি পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলার লোকজন গিয়ে কর্মসংস্থান করেছিলেন ব্রিটিশদের মালিকানাধীন চা বাগানে। ইংরেজরা বেশি পছন্দ করতেন যেসব হিন্দু ও মুসলমান মোটামুটি ইংরেজি জানতেন তাদেরই এবং লিখতে পারতেন যারা ইংরেজি ভাষায় চিঠিপত্র তাদেরই সমাদর ছিল বেশি। সঙ্গে অন্যান্য সুবিধাসহ বেতনাদি তারাই বেশি পেতেন। সিরাজগঞ্জ শহরের আবদুল গনি খানাদার, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মোটামুটিভাবে পাস করে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলেন। ইংরেজদের চা বাগানে সম্মানজনক একটি চাকরি পান সহকারী ব্যবস্থাপকের। বছরখানেক পরই তার ইংরেজ ব্যবস্থাপক চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সুবাদে আবদুল গনি খানাদার দেশভাগের পরও থেকে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়িতে। তবে থাকতে পারলেন স্বল্প সময়ের জন্য। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলেও অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার যারা ওই পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও রংপুর থেকে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির ইংরেজ সাহেবদের চা বাগানে চাকরি করতে, তারা সবাই নিশ্চিত করেছিলেন ব্যবস্থাপক আবদুল গনি খানাদার আপনি জলপাইগুড়িতেই থেকে যান। বুদ্ধিমান খানাদার থাকতে চাইলেও তার অনুজ যিনি ছিলেন আসামের শিলিচরে তিনি কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পর নিশুতি রাতে চলে আসেন তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জের শরাতল গ্রামে এবং অগ্রজকেও আসতে হয়েছিল একদিন। পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার অনেক পরিবার দেশভাগের অনেক অনেক বছর আগেই আসামে গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন অনেকেই। ওইসব ছাত্রের ভিতরে ছিলেন আবদুল হামিদ নামের এক ছাত্র, তিনি শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছিলেন ভাসানচরের একটি মাদ্রাসা থেকে। সেই ভাসানচরের মাদ্রাসার ছাত্রই একদিন ফিরে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জে তার পিতৃভূমিতে। তখনই বোধহয় তিনি তার নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন ‘মওলানা’ ও ‘ভাসানী’ শব্দ দ্বয়। তবে যারা পূর্ববঙ্গের পিতৃভূমিতে ফিরে এলেন না, তারা চিরস্থায়ীভাবেই ব্রিটিশশাসিত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তরে রয়ে গেলেন। আসাম, দার্জিলিং, কলকাতা, জলপাইগুড়িতে সুখে-শান্তিতেই ছিলেন তারা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর চার দশক পর্যন্ত। বন কেটে বসতি গড়ার পরে নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমির বন্দোবস্ত। দলিল-দস্তাবেজ। খাজনা দিয়ে নিয়েছিলেন খাজনার রশিদ-পরচার কাগজপত্র, ভালোই চলছিল দিনকাল। একদিন সেই সুখের দিনগুলো ১৯৪০-এর পর থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করল। তবে তার অনেক আগে সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ১৯০৫ সালেই শুরু হয়েছিল এবং পাওয়া গিয়েছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতাদের অসন্তোষের পূর্বাভাস। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘ভারত ছাড়’-এর আন্দোলন।

তখনকার ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর ছিলেন লর্ড কার্জন। তিনি শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েই বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠন করেছিলেন। সেই বিভক্তিতে বিরক্ত হয়ে উষ্মা প্রকাশ করে কংগ্রেস নেতারা যেন হঠাৎ করেই হাতে পেয়ে গেলেন একটি মহাসুযোগ পূর্ববঙ্গ ও আসামকে দুই ভাগে ভাগ করা যাবে না। কংগ্রেস নেতারা এমন সব ভাষ্য ও ভাষণ কলকাতার গড়ের মাঠসহ বিভিন্ন জেলায় জেলায় দিয়ে বেড়াতে শুরু করলেন লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে। সঙ্গে ধর্মঘট, মিটিং-মিছিল এবং অদৃশ্যভাবে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা। লর্ড কার্জন নিজ সম্মান রক্ষার্থে একদিন রাজসিংহাসন দূরে সরিয়ে দিলেন স্বেচ্ছায়। অথচ লর্ড কার্জনের শাসনকাল ছিল ভালো এবং তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন শাসক। লর্ড কার্জন গভর্নরের পদ থেকে সরে যাওয়ার পরও কংগ্রেস নেতারা বাংলা-আসাম ভাগাভাগি নিয়ে অনেক বছর ছিলেন সোচ্চার। কথা একটিই ‘বাংলা মাকে দুই ভাগ করা যাবে না।’

তখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন অপ্রিয় সত্য কথা কংগ্রেসের বিপক্ষে। ‘কংগ্রেস ইংরেজ কর্তৃপক্ষের নিকট যাহা চায়, তাহা কেবলমাত্র বাগ্মিতার দ্বারা চায়, কঠিন দ্বারা চায় না।’

তথ্যমতে, ১৯০৫ সালের পরও আসাম ও পূর্ববঙ্গে হিন্দুরাও আন্দোলন করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছর কয়েক আগ পর্যন্ত। তবে লর্ড কার্জনের পদত্যাগের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের গভর্নর হয়ে এসেছিলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার র‌্যামফিল্ড ফুলার। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য গভর্নর হয়েছিলেন। তিনিও ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।

গভর্নর হয়ে আসার পর তিনি চাননি লর্ড কার্জনের গৃহীত সিদ্ধান্ত বঙ্গভঙ্গের আইন রদ করতে, সেই সময়ের সমগ্র পূর্ববঙ্গে পশ্চিম বাংলায় এমনকি বাংলা ভাষাভাষী আসামেও কংগ্রেস নেতারা হুঙ্কার দিয়ে বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য, যে কথাগুলো কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, সে কথাগুলোই পুনরায় ব্যক্ত করলেন ‘বঙ্গমাতার দেহ দুই ভাগ করা যাবে না।’ কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা থেকে শুরু করে অনেকেই সোচ্চার ছিলেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এবং   তারা আরও সোচ্চার ছিলেন গভর্নর মি. ফুলারের পদত্যাগ দাবিতে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গভর্নর মি. ফুলার একদিন তারই পূর্বসূরির পথ অবলম্বন করে গভর্নরের চেয়ার ছেড়ে দিয়েছিলেন।

তবে চেয়ার ছাড়ার আগের ঘটনা ছিল ভিন্ন রকমের। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের গভর্নর স্যার র‌্যামফিল্ড ফুলার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে একটি ভাষণে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং একই সঙ্গে করেছিলেন খুশি। গভর্নর এক জনসভায় দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার দুটি রানী। বাঙালি মুসলমানেরা আমার সুয়োরানি।’ এ বক্তব্যকে ভিন্ন অর্থে আঁকড়ে ধরে কংগ্রেসের বড় বড় নেতারা মি. ফুলারের বিরুদ্ধে শ্লীল-অশ্লøীল ভাষা এবং বিশ্রী রকমের সমালোচনা করায় ফুলার খুবই মর্মাহত হয়ে গভর্নরের চেয়ার ছেড়ে রক্ষা করেছিলেন তারই পূর্বসূরির মতো তার মানসম্মান।

মি. কার্জন ও ফুলারের নামে ঢাকায় আছে দৃষ্টিনন্দন কার্জন হল এবং ফুলার রোড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তারা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন যেমন ছেড়ে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সপ্তম রাজা এডওয়ার্ড লেডি সিমসনের জন্য। লেডি ছিলেন অতি সাধারণ একজন রজকিনী। যদিও সেটি এডওয়ার্ডের প্রেমজনিত রোগের বহিঃপ্রকাশ। প্রেমিকমাত্রই অন্ধ। প্রেমিকা রজকিনী গোয়ালিনী এমনকি ঘুঁটেকুড়ানি হলেও অসুবিধা নেই। অসুবিধা হলো রাজ পরিবার যখন রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডকে তিরস্কার উপহার দিতে শুরু করল তখনই নিজ মানসম্মান রক্ষার্থে লেডি সিমসনের হাত ধরে একদিন বেরিয়ে গেলেন চিরতরে রাজ পরিবার থেকে। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় মি. কার্জন ও ফুলারের ভিতরে কাজ করেছিল ব্রিটিশ রক্ষণশীল পরিবারের আত্মমর্যাদা। হয়তো বা ওই দুই গভর্নর চিন্তা-ভাবনা করেই ছেড়ে দিয়েছিলেন মোহময়ী চেয়ারটিকে।

ইতিমধ্যে অনেক সময় গড়িয়েছে। ব্রিটিশরাজ বাধ্য হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রদ করতে। তবে তার আগে অখ- বঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন স্যার ওয়েলভেল, তিনিও একদিন তার দুই পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করেছিলেন। হয়তো তিনিও ছিলেন মুসলমানদের প্রতি সহৃদয়। কংগ্রেসসহ অন্য রাজনীতিবিদরাও ইচ্ছামতো ওয়েলভেলকে তুলাধোনা করায় আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন গভর্নর স্যার ওয়েলভেল ছেড়ে দিয়েছিলেন গভর্নরের রাজকীয় চেয়ার। অনেক ইতিহাসবিদের রচনা থেকে জানা যায়, সুবিধাবাদী এবং সুবিধাভোগী গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর কূট বুদ্ধিতে এবং নেহরু পরিবারের পারিবারিক বন্ধু হওয়ার সুবাদে ভারতীয় উপমহাদেশের শেষ গভর্নরের চেয়ারটি নিজ করে নিয়েছিলেন কোনো এক সুপ্রভাতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন। যার হাত দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভাগ হলো এ উপমহাদেশটি। যিনি দেশটিকে খন্ডিত করেছিলেন, তিনি নাকি ছিলেন ইংল্যান্ডের এক অখ্যাত উকিল। সেই উকিল আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন কংগ্রেসের কুচক্রীদের হাতে। ’৪৬-এর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সুযোগ ও সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়ার প্রকাশ্যে এবং নেপথ্যে ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ইতিহাসের ভাষ্যানুসারে ’৪৬-এর দাঙ্গার মূল উসকানিদাতাও ছিল ইংরেজ প্রশাসন ও কংগ্রেস। ইংরেজ প্রশাসন লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বুদ্ধিতে হয়তো মনস্থির করেছিলেন ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের শাসন-শোষণ ফেলে রেখে যাওয়ার আগে হিন্দু ও মুসলিমদের ভিতরে এমনভাবে বিভাজন সৃষ্টি করতে হবে, মুসলমান যেন হিন্দুর মুখ না দেখে, হিন্দু যেন ওই একই কর্ম করে। তবে দেশটিকে দুই ভাগে ভাগ করতে চাননি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মুসলিম লীগ নেতাদের দ্বিমত হওয়ার কারণে যে দুর্যোগ এ উপমহাদেশে নেমে এলো তার ফলে ১০ কোটি হিন্দু-মুসলমান স্বদেশ হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেল অচেনা-অজানা পরিবেশের দেশে। হাজারো দুঃখ-কষ্ট হলেও স্বদেশ-জম্ম ভূমি ছেড়ে দেশান্তরি হওয়ার সময় কোনো কোনো পরিবার তাদের বাড়ির মাটি নিয়ে এসেছিল এবং গিয়েছিল অন্য ভূমিতে।

দুর্ভাগ্যবশত যে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে কংগ্রেসিরা ১৯০৫ সালে উম্মাাতাল হয়েছিলেন, তারা সবাই ছিলেন নিশ্চুপ। তাদের কেউ ’৪৭ সালে দেশভাগের সময় একবারও বলেননি, বঙ্গমাতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যাবে না। গান্ধীজি ও নেহরুর কুপরামর্শেই দেশভাগকারীরা আসাম দিয়ে দিল ভারতকে। ১২০০-১৩০০ মাইল দূরে যে দুটি দেশ পাকিস্তানকে দিয়ে দিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন তা যে কত বড় অন্যায় তিনি করেছিলেন, মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, ‘ভুল আমিই করেছিলাম, অন্যের পরামর্শে।’ পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের একটির নাম পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশ। পূর্ব বাংলার মানুষ দেশভাগের অনেক আগেই স্থায়ী হয়েছিল বৃহত্তর আসামের বিভিন্ন জেলায়। আসামেই ১৯৫০-এ শুরু হয়েছিল পূর্ব বাংলার লোকদের আসাম ছাড়তে হবে। ’৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে বিশাল এক ভূমিকম্প হয়েছিল। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৪। সম্ভবত ভূমিকম্পের বেশ কিছুকাল পরই আসামে দেখা দিয়েছিল বিশাল বন্যা, মহামারী। বন্যায় যেমন অনেক ঘরবাড়ি, সেগুন, শাল, গরু, মহিষসহ বেশকিছু মরা মানুষ ভেসে এসেছিল পূর্ববঙ্গের যমুনা নদী দিয়ে। ভাসমান কাঠ, গরু, মহিষ অনেকেই তুলে নিয়েছিল সিরাজগঞ্জের মোখতারপাড়াসহ যমুনা-তীরবর্তী জনগণ। তবে আসামে ’৫০-এর ভূমিকম্পে পূর্ব বাংলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আজকের প্রেক্ষাপটে কিংবা প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, বিভাগপূর্বকালে এবং দেশভাগের পর ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি আসামেই ৪০ লাখ হিন্দু-মুসলমান গিয়ে সেখানে উদ্বাস্তু হয়ে থিতু হয়, তাহলে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুর সংখ্যা হতে হয় মাত্র ৬০ লাখ। ইন্দিরা সরকার ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে সমগ্র পৃথিবীতে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় এক কোটি শরণার্থী। সেখানে তিনি আসামের নাম বোধ করি উচ্চারণ করেননি। ’৫০ সালে বাঙালি খেদানোর আন্দোলন শুরু করেছিল অসমীয়রা। তারই ধারাবাহিকতায় মধ্যপঞ্চাশে পাবনা শহরের জিলাপাড়ায় আমাদের পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিনের দোতলা বাড়ির নিচে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আসাম থেকে বিতাড়িত স্বামীহারা এক ভদ্রমহিলা তিনটি ছেলে ও একটি মেয়েসহ। বড় ছেলেটির নাম ছিল রাজীব, দ্বিতীয়টির নাম মতিয়ার। মেয়েটির নাম ছিল হেনা। তবে তৃতীয় ছেলে আবুল হোসেন পিতা-মাতাহীন আপন খালার সঙ্গে পাবনায় এসে উঠেছিল আমাদের জিলাপাড়ার বাড়িতে। বাড়িটির গৃহকর্মের জন্য, সহানুভূতিশীল হয়ে আমাদের পিতা-মাতা থাকা-খাওয়া বাদেই বেশকিছু টাকা দিতেন পারিশ্রমিক বাবদ প্রতি মাসেই। যেহেতু রাজীবের ছোট ভাই মতির গলায় ‘গ্যাগ’ হয়েছিল আয়োডিনের অভাবে। রাজীবের মা মিসেস নূরজাহান বেগম অনেকদিন ওষুধ খাওয়ানোর পরও মতিউরকে বাঁচাতে পারেননি। বেশ কয়েক বছর আমাদের শহরের বাড়িতে থাকার পর তিনি এক ছেলে, মেয়ে হেনা ও বোনপুত্র আবুল হোসেনকে নিয়ে উঠেছিলেন গোপালপুর মহল্লার একটি বাড়িতে। বাড়িটি পাবনা জিলা স্কুলের উত্তর দিকে। যে বাড়িতে নূরজাহান বেগমের কর্মসংস্থান হয়েছিল সেটি ছিল ১৯৫৫-৫৬ সালে। ওই গোপালপুর জিলাপাড়া দুই মহল্লার মাঝখানে ছিল পাবনা জিলা স্কুলের হেড মাওলানা কসিমউদ্দিন আহমদের বাড়ি। ইতিমধ্যে রাজীবের জিলা স্কুলের দক্ষিণ দিকের পুকুরের পূর্বদিকে একটি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াকালে রাজীব ও আমাকে ওই একই স্কুল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কসিমউদ্দিন স্যার ভর্তি করেছিলেন ’৫৬ সালে ক্লাস থ্রিতে প্রাইমারি স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা নূরু মিয়া, শিক্ষার জন্য শতাধিক বছর আগে প্রাইমারি স্কুলটি বানিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য। জিলাপাড়ার সেকান্দার বিড়িওয়ালার ছেলে ফেরদৌস, পুকুরের পূর্বদিকের বেগম মহলের আক্কেল আলীর ছেলে বাচ্চুসহ জনাকয়েককে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র দেড় টাকায় এবং মাসিক টিফিন ফি ছিল মাত্র চার আনা, শুধু রাজীবের ভর্তিতে হেড মাওলানা জিলা স্কুলে বিনা বেতনে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তবে আমাদের নয়। রাজীবকে কেউ ডাকতেন মুজিবর নামে। রাজীবের মা ছেলে, মেয়ে ও আবুল হোসেনসহ একদিকে আশ্রিতা হয়েছিলেন হামিদ রোডের টিঅ্যান্ডটি অফিসের পুবদিকের হিরাজ বিশ্বাসের হিরাজ ম্যানশনে গৃহকর্মীর পদে। পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর শহরের বাণী হলসংলগ্ন বাবু মিয়ার ইলেকট্রা হাউসে খ-কালীন চাকরি দিয়েছিল বাবু মিয়ার বড় ছেলে শামসুল। যখন রাজীব সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন বাণী সিনেমা হলের মালিক বিহারি ইউনুস মিয়া তার সিনেমা হলের উর্দু ও বাংলা সিনেমা ঢাকা থেকে নিয়ে গেলে শহরময় মাইকিং করে বেশকিছু পারিশ্রমিক মিলত রাজীবের হাতে। ভাই মতিউর গ্যাগ নিয়ে একদিন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর নূরজাহান বেগম বড় ছেলে রাজীব, মেয়ে হেনা ও বোনপুত্রকে ফেলে শেষ পর্যন্ত চলে যান অজানায়। ইতিমধ্যে ১৯৬৫-তে পাবনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরের বছর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে বেশকিছু টেকনিশিয়ান গিয়েছিল যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের। সৌভাগ্যবান রাজীব একদিন পাবনা ছেড়ে পাকিস্তানের সম্ভবত লয়ালপুরের এয়ারফোর্সের ঘাঁটিতে গিয়ে থিতু হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ১০-১৫ দিন আগে পাবনায় এসেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ইতিপূর্বে বোনকে বিয়ে দিয়েছিল রাজীবের এক মামা। আবুল হোসেন ছিল নিরক্ষর, তবে সে ছিল অসম্ভব সাহসী। পাবনা শহরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কবুল, বেবী ইসলাম, ইকবাল হোসেনের হাত ধরে যোগ দিয়েছিল যুদ্ধে। সেই সময়ে সে ট্রেনিং নিয়েছিল ভারতের দেরাদুনে। যুদ্ধকালে তার গলায় বুলেটবিদ্ধ হওয়ায় তাকে হাঙ্গেরিতে পাঠানো হয়েছিল। ভালো হয়ে যখন দেশে ফিরল তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। আবুল হোসেন শহরে পরিচিতি পেয়েছিল আবুল হাঙ্গেরি এই নামে। সে একদিন খুব কষ্ট করে [মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কণ্ঠস্বর আর ঠিক হয়নি তার] আমাকে বলল, গলায় পাকিস্তানিদের বুলেট ঢুকল একদিন বেঁচে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও এলাম, বাণী সিনেমা হলে ফিরে পেলাম গেটম্যানের চাকরি। কিন্তু পিতা-মাতার আসল দেশ আসামের শিলচরে যদি কোনো দিন গিয়ে আমাদের স্বজনদের খুঁজে পেতামÑ একটি দীর্ঘশ্বাস শেষে ওর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবুল যেদিন অসুস্থাবস্থায় চিরতরে পাড়ি দিল তার জন্য সেদিন না বাজল বিউগল, না মিলল গান স্যালুট। আমার বিশ্বাস, রাজীব ও আবুলদের অনেক স্বজন আসামের শিলচরে এখনো আছেন। যদি থেকে থাকেন তারা কি ভারতে থাকতে পারবেন? ভারতের বর্তমান শাসক বিজেপির রোষানল থেকে হিন্দু-মুসলমান সবাই কি উদ্বাস্তু? সবাই বোধহীন?      লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর