সোমবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রবিউল আউয়াল মাসের তাৎপর্য

মুফতি মুহাম্মদ মুহিববুল্লাহিল বাকী
পেশ ইমাম ও ভারপ্রাপ্ত খতিব বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, ঢাকা।

রবিউল আউয়াল মাসের আগমনে ইমানের জগতে বসন্ত শুরু হয়। রবিউন শব্দের অর্থ বসন্ত। মাঝে মধ্যে মনে হয় রসুল (সা.)-এর আগমন এ মাসে হবে সে জন্য বোধহয় আল্লাহতায়ালা যারা মাসের নামগুলো নির্ধারণ করেছেন তাদের অন্তরে এ মাসের নাম রবিউন রাখার জন্য পূর্ব থেকেই প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছিলেন। রবিউল আউয়াল মাস ঘুরে আসার সময় হলেই বিভিন্ন কবিতার চরণ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। তেমনি চরণের মধ্যে একটি চরণ হলো মক্কায় নবী এলো মা আমেনার ঘরে, হাসিলে হাজার মানিক কাঁদিলে মুক্তা ঝরে। ইসলামের ইতিহাসে রবিউল আউয়াল হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। যেহেতু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে এ মাসেই আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দুনিয়ার বুকে আগমন ঘটেছে। ফলে এ মাস যখন আসে মুসলমানদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে রসুল প্রেমের জোয়ারের ঢেউ নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। রসুল প্রেমে অন্তর নতুনভাবে আন্দোলিত হয়। বছরের চাকা ঘুরেই রবিউল আউয়াল মাস প্রতি বছর আমাদের কাছে আসে। কিন্তু কী শিক্ষা আমাদের জন্য নিয়ে আসে। আমাদের কী করণীয়? রসুলেপাক (সা.)-এর দুনিয়াতে আসার মুহূর্তে যেসব অলৌকিকত্ব ঘটেছিল তা আমাদের বলে দেয় রসুল (সা.)-এর আগমনের উদ্দেশ্য কী? সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আমাদের করণীয় কী? ঐতিহাসিক মতামত অনুযায়ী দেখা যায় যেদিন মা আমেনার ঘরে সুবহে সাদেকের সময় আল্ল­াহর রসুলের আগমন ঘটবে কয়েকজন মহিলা তার ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন। তারা হঠাৎ করে দেখলেন আকাশ থেকে সরাসরি যেন এক আলো পুরো ঘরকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে। আলোয় ঝলমল করে উঠল পুরো ঘর। মহিলারা অবাক হলো দুনিয়াতে প্রতিদিন কত শিশুর, কত সন্তানের আগমন ঘটছে, এমন তো আর কোনো দিন দেখা যায়নি। তারা হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাল, তাদের কাছে মনে হলো আকাশের তারাগুলো যেন ঝুঁকে পড়ছে আর ঘরটা যেন আলোর বন্যায় ভাসছে।

অন্যদিকে আল্ল­াহর নবী যেদিন দুনিয়ার বুকে আসেন পারস্যের সাম্রাজ্য যা বিশাল এক সাম্রাজ্য, একটি পরাশক্তি, তাদের সম্রাট থাকার যে বিশাল প্রাচীন প্রাসাদ হঠাৎ করে নড়েচড়ে উঠল এবং ১২টি পাথর সে প্রাসাদ থেকে খসে পড়ল। তারা অবাক হলো। দৈবক্রমে এ ঘটনা ঘটেছে এরকম ব্যাখ্যার সুযোগটাও বন্ধ হয়ে গেল যখন পারস্যের সম্রাট সেই রাতেই স্বপ্ন দেখেন আরব মরুভূমি থেকে কিছু উট এবং সামনে একটি ঘোড়া ধেয়ে আসছে, শক্তিশালী একটি ঘোড়া আরবের কিছু উটকে টেনে মরুভূমি থেকে নিয়ে আসছে, ফোরাত নদী পার হয়ে পারস্যের বিভিন্ন সাম্রাজ্যে তারা ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের সাম্রাজ্য বেদখল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড নিভে গেছে। সব দৈবক্রমে বা কাল্পনিক স্বপ্ন বলে মনকে মানানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারক ও খ্রিস্টান ধর্মের বড় পাদ্রিদের ডাকা হলো। তখন তারা বললেন, শেষ নবী হিসেবে একজন নবী আসার সময়ই এ ধরনের নিদর্শন প্রকাশ হবে বলে আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। তা হলে কি সেই নবীর আগমন ঘটেছে? সে নবীর নেতৃত্বে পুরো মানব জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে। তাঁর পয়গাম সারা বিশ্বে পৌঁছে যাবে। আল্ল­াহতায়ালা বলেন সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত। আর মিথ্যা অপসৃত হতে বাধ্য। সূরা বনি-ইসরাইল। মক্কার পাশেই ইহুদির এক বড় আলেম বসবাস করতেন। তিনি বললেন, আমার মনে হচ্ছে আজ আরব জগতে কোনো একজন বিশেষ শিশুর জম্ম  হয়েছে। লোকজন জিজ্ঞেস করল আপনি কী করে বুঝলেন আজকে আরবের মধ্যে এক বিশেষ শিশুর জম্ম  হয়েছে। ইহুদি বললেন, আমি রাতের বেলায় তারাগুলোকে ঝুঁকে পড়তে এবং আকাশ থেকে আরবের ওপর আলোর বিচ্ছুরণ হতে দেখেছি। খবর নিয়ে দেখা গেল, সেই রাতে আবদুল মুত্তালিবের ঘরে এক শিশুর জম্ম  হয়েছে। সবাই মনে করছে শিশুটি অন্য দশ শিশুর মতো। ইহুদি আস্তে করে শিশুটির দুই ঘাড়ের মাঝখানে পিঠে নজর দিলেন। পিঠে দেখতে পেলেন মোহরে নবুয়াত ‘এক ধরনের বিশেষ চিহ্ন’। শেষ নবীর আলামত হিসেবে পূর্ববর্তী কিতাবে চিহ্নটির উল্লেখ রয়েছে। ইহুদি দেখেই বেহুঁশ হয়ে গেলেন। হুঁশ ফিরে এলে লোকেরা তার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন বেহুঁশ হয়েছি খুশি এবং দুঃখে। খুশি এ জন্য যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন, জাহেলিয়াত প্লাবিত বর্বরতাপূর্ণ এই পৃথিবীর বুকে আলোর মশাল নিয়ে শেষ নবীর আগমন ঘটেছে। আল্ল­াহতায়ালা বলেন আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আলো তথা মুহাম্মদ (সা.) ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। সূরা মায়েদা। দুঃখ এ জন্য যে ইহুদি, খ্রিস্টানদের সব নবী ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর, তথা বনি ইসরাইল গোত্রের। আমরা প্রত্যাশায় ছিলাম যে, সর্বশেষ নবীর আগমন ঘটবে ইসরাইল গোত্রে। এখন তার আগমন হয়েছে ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর থেকে। সেই দুঃখে বেহুঁশ হয়েছি। যদিও সে ইহুদি সংকীর্ণতার কারণে একচ্ছত্র আনন্দ প্রকাশ করতে অক্ষম ছিল। আল্লাহতায়ালা সে নবীর আগমনে নিরঙ্কুশ আনন্দ প্রকাশ করার লক্ষ্যে বলেন হে নবী বলে দিন তারা যেন আল্লাহর দান তথা কোরআন ও আল্ল­াহর রহমত তথা আপনার জন্য আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের জন্য সঞ্চয়ের মধ্যে উত্তম সঞ্চয়। সূরা ইউনুস-৫৮নং আয়াত। মহানবীর আগমনে একজন মুসলমান সবসময় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আনন্দিত থাকবে, আনন্দ প্রকাশ করবে এটা তার ওপর ফরজ। তবে যুগে যুগে প্রতি বছর যখনই আল্লাহর নবীর আগমনের এ মাস আসে তখন আল্লাহর নবীপ্রেমিকদের মাঝে আনন্দ প্রকাশ, নতুন উদ্দীপনা শুরু হয় এবং আনন্দ প্রকাশের ধরন ও কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন রূপে রূপান্তরিত হয়। আনন্দ প্রকাশের বাহ্যিক রূপ হলো মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সভা-সমিতি।  আর তার আধ্যাত্মিক রূপ হলো রসুলেপাক (সা.)-এর মেসেজ, পয়গামকে ধারণ করা এবং পয়গামকে বাস্তবায়ন করার জন্য জান-মাল দিয়ে  প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

সর্বশেষ খবর