শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই?

তসলিমা নাসরিন

মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই?

রোহিঙ্গারা যখন বার্মা থেকে দলে দলে নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাচ্ছে, আমি বলেছিলাম বাংলাদেশ কেন ওদের বাধা দিচ্ছে, সবাইকে আশ্রয় দেওয়া উচিত। কিন্তু আমার ভাই বললো, ‘তুই দেশে থাকিস না, তুই জানিস না, রোহিঙ্গারা কী করে, ওরা ইয়াবা মাদকের ব্যবসা করে, দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই ইয়াবা’। ভাই আরও বললো, ‘ওদের প্রচুর বাচ্চা হয়’। আমি বললাম, ‘তাতে কী? একটা সম্প্রদায়কে যদি তুমি গরিব করে রাখো, অশিক্ষিত করে রাখো, এমন তো হবেই’। ভাই এরপর বললো, ‘ওদের জিহাদি ট্রেনিং দিয়ে জিহাদি বানানো হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামের লোকেরা চায় রোহিঙ্গারা থাকুক বাংলাদেশে, কারণ রোহিঙ্গাদের জিহাদি বানানো সোজা’। এদিকে ভারতে যে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছিল, ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওদের তাড়িয়ে দেবে। ভারতের যে মিডিয়া আমার মত জানতে চেয়েছে রোহিঙ্গাদের কী করা উচিত, সবাইকে বলেছি, রোহিঙ্গাদের থাকতে দেওয়া উচিত ভারতে। বার্মা ওদের নেবে না, বাংলাদেশে পাঠালে ওরা হয়তো জিহাদি হয়ে যাবে। প্রতিবেশী দেশে জিহাদিদের উৎপাত বাড়লে ভারতের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে, সবচেয়ে বড় কথা, ভারত চিরকালই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, ভারতের উদার বাহু কত ভিন্ন ধর্মের কত ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে আলিঙ্গন করেছে, আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এখন রোহিঙ্গাদের মতো অসহায় প্রাণীদের কেন আশ্রয় দেবে না! ১২০ কোটি মানুষের বাস ভারতে। চল্লিশ হাজার নিতান্তই কম সংখ্যক লোক। ভারতে বাস করলে রোহিঙ্গাদের অন্তত জিহাদি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী করবে, তা ভারত সরকারই ভালো জানে। আমার উপদেশ শোনার প্রয়োজন কারোরই নেই। তবে বাংলাদেশ সাড়ে সাত লাখ গৃহহীন, দেশহীন লোককে কী করে যে আশ্রয় দিয়েছে, নিজেদের কত ক্ষতি করে, তা দেখে আমি সত্যি অবাক বনেছি। বার্মার মিলিটারি রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, প্রচুর পুরুষকে খুন করেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, যারা বেঁচে আছে জীবন বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্ধকারে খরস্রোতা নদীতে ডিঙ্গি নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে, যে তীরেই গিয়ে পৌঁছোয়।

পৃথিবীর অনেক দেশই রোহিঙ্গাদের জন্য খরচের টাকা পয়সা দিচ্ছে বাংলাদেশকে, কিন্তু রোহিঙ্গাদের কেউ নিজের দেশে ঠাঁই দিতে চায় না। অদ্ভুত এক জনগোষ্ঠী বটে, চাষবাস করা, নামাজ রোজা করা আর সন্তান উৎপাদন করা ছাড়া বেশি কিছু জানে না। মনে হয় দশ হাজার বছর আগের কোনও জনগোষ্ঠী হঠাৎ আধুনিক পৃথিবীতে এসে উপস্থিত। মাঝখানে যে কত বিপ্ল­ব ঘটে গেছে, তার কিছুর ছোঁয়া তাদের গায়ে লাগেনি। পরিবার ছোট হয়ে গেছে, মেয়েরা ইস্কুল কলেজে যাচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, বাল্যবিবাহ কমে গেছে, নারীর সমানাধিকারের জন্য আন্দোলন হচ্ছে, কারখানা গড়ে উঠেছে, চাষাবাদ ছেড়ে অনেকে কারখানায় কাজ করছে। কী করে আধুনিক শিক্ষা নেবে রোহিঙ্গারা? শুনেছি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশু-কিশোরদের জন্য যত না ইস্কুল খোলা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মাদ্রাসা খোলা হয়েছে। শত শত মাদ্রাসা, তাদের আদৌ আধুনিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয় না। সম্ভবত ধর্ম দিয়ে ডুবিয়ে রাখলে জিহাদি বানানোর পথটা সহজ হয় বলেই এই পরিকল্পনা।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা যুবকরা তাদের ক্যাম্পের আশেপাশের শহরে ডাকাতি করছে, মেয়েদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে, অথবা তারা পতিতা ব্যবসা করতে নেমেছে। বার্মায় কিছু রোহিঙ্গা অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। ওদের জন্য চাষবাস আর সন্তান উৎপাদনের বাইরে জিহাদি হওয়াটাই সম্ভবত এক্সট্রা অরডিনারি কাজ।

খুব স্বাভাবিক যে রোহিঙ্গাদের কেউ চায় না নিজের দেশে ঢুকিয়ে ঝামেলা বাড়াতে। বাংলাদেশ সরকার ওদের জায়গা দিয়েছে, যত না মানবতার জন্য, তার চেয়ে বেশি সম্ভবত মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য। ভিন্ন মতাবলম্বী মুক্তচিন্তকরা এক এক করে নিজের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকার কাউকে নিরাপত্তা দিতে আগ্রহী নয়। এমন দেশে, অবাক কান্ড, বহিরাগত রোহিঙ্গাদের জন্য জনগণের আবেগ উথলে ওঠে, সরকারের আবেগও সেই সাথে উথলে ওঠে, রোহিঙ্গারা মুসলমান বলেই। প্রতিবেশী কোনও দেশ থেকে দলে দলে অমুসলিম লোকেরা বাংলাদেশে ভিড় করলে এভাবে কি সবাইকে আশ্রয় দিত বাংলাদেশ? আমার সন্দেহ হয়। আমার আজকের প্রশ্ন, সৌদি আরব কেন রোহিঙ্গাদের বিদেয় করছে? বাংলাদেশের পাসপোর্টে হজ বা উমরাহ করার ভিসা নিয়ে যে রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে গিয়ে অবৈধভাবে থাকতে শুরু করেছিল, তাদের না তাড়িয়ে বরং ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভিসা বাড়ানোই তো সাচ্চা মুসলমানের কাজ। সারা দুনিয়ার মুসলমানের কাছে সৌদি আরব একটি পবিত্র জায়গা। সৌদি আরব ইসলামের জম্ম ভূমি। নবী বলতেন, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। তবে যে ভাইকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে? সৌদি আরবে বিধর্মী অনেকে বাস করেন, তাঁরা নাগরিক না হতে পারেন, কিন্তু বাস করার অনুমতি পাচ্ছেন। বিধর্মী অনেক শ্রমিকও সৌদি আরবে আছেন। রোহিঙ্গাদের তো শ্রমিক হিসেবেও আশ্রয় দেওয়া যায়! যে শ্রম গরিব দেশের লোকেরা দিচ্ছে সৌদি আরবে, সেই শ্রম রোহিঙ্গারাও দিতে সক্ষম। সৌদি আরব কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি মুসলমানকে হজ করার ভিসা দেবে না। ফিলিস্তিনি মুসলমানকে হজ করা থেকে বঞ্চিত করে কাকে খুশি করতে চাইছে দেশটি?

মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, এ কথা জম্মে র পর থেকে শুনে আসছি। অথচ জীবনভর দেখলাম বাক্যটি কী ভীষণ রকম ভুল। ন’ বছর বয়সে দেখেছি পাঞ্জাবি মুসলমান বাঙালি মুসলমানদের ঘৃণা করে, তাদের গুলি করে হত্যা করে, তাদের ধর্ষণ করে, তাদের টাকা পয়সা সোনাদানা লুঠ করে। এখনও দেখছি পাকিস্তানের সুন্নি মুসলমান শিয়া মুসলমানদের ঘৃণা করে, আহমদিয়া মুসলমানদের মুসলমান বলেই মনে করে না। ইরাকে দেখছি সুন্নি মুসলমান শিয়া মুসলমানদের ঘৃণা করে, শিয়া মুসলমানও সুন্নি মুসলমানদের ঘৃণা করে। দেখছি সৌদি মুসলমান ইয়েমেনি মুসলমানদের ঘৃণা করে। দেখছি ধনী মুসলমান গরিব মুসলমানদের ঘৃণা করে। মুসলমান মুসলমান আর যাই হোক, ভাই ভাই নয়। সৌদি আরব আমেরিকা আর ইজরাইলকে যত আপন মনে করে, তত আপন কোনও মুসলিম দেশকে মনে করে না। ধর্ম নিছক লোক দেখানো। হিসেবটা সবসময়ই ধন দৌলতের। ইয়েমেনের লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে সৌদি আরব, অনাহারে মারা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু। তাতে সৌদি আরবের কিছু যায় আসে না, অন্যান্য মুসলিম দেশেরও কিছু যায় আসে না। আসলে গরিবদের নিয়ে কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই। ঠিক যেমন রোহিঙ্গাদের নিয়ে নেই। তবুও রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য অনেক দেশই দিয়েছে। কিন্তু সাহায্য দিয়ে দিয়ে আর কতকাল বাঁচিয়ে রাখা হবে একটা জনগোষ্ঠীকে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, ওদের শিক্ষা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। পরিবার পরিকল্পনা করার, সৎ উপায়ে উপার্জন করার, বাল্য বিবাহ না করার, অপরাধ না করার, জিহাদি না হওয়ার শিক্ষাটা ওদের জন্য জরুরি। তাদের প্রয়োজন একটি রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্র তাদের নাগরিকত্ব দেবে।

বার্মা রাজি হয়েছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। বাংলাদেশ ফেরত পাঠাতে চাইছে রোহিঙ্গাদের। সাড়ে সাত লাখের মধ্যে কয়েক হাজার পাঠাবে, এমন সময় জাতিসংঘ বলছে, আগে দেখে নিতে হবে বার্মায় রোহিঙ্গাদের জন্য সত্যিকার নিরাপত্তা আদৌ আছে কিনা। এর মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের সর্বোচ্চ যে পুরস্কার দিয়েছিল অং সান সু চিকে, সেটি ফেরত নিয়েছে। এই মহিলার কাছ থেকে মানবাধিকারের জন্য পাওয়া সব পুরস্কার ফেরতই নেওয়া উচিত।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বানানো, ভাই বানানো সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে হয় গণতন্ত্র, যেখানে সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের, সব লিঙ্গের মানুষের অধিকার সমান। যে রাষ্ট্রে মানবাধিকারের এবং মত প্রকাশের অধিকারের মূল্য সবচেয়ে বেশি। আজ যদি এই বিশ্বাসটা সবার থাকতো, তাহলে পাকিস্তানের এই পরিণতি হয় না, বার্মার রোহিঙ্গাদেরও এই হাল হয় না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় রাজনীতিকরা ভালো ভালো কথা শুধু বলার জন্যই বলেন, কাজে লাগাবার জন্য বলেন না। মানুষকে ধোঁকা দেওয়াটা তাদের একটা পেশা। এই দুঃসময় একদিন দূর হবে, এই আমার আশা।

 

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর