সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মিথ্যে গুণগান না-চাই মায়ের হাতের রান্না

হানিফ সংকেত

মিথ্যে গুণগান না-চাই মায়ের হাতের রান্না

পত্রপত্রিকার কলামে সবাই যে ধরনের লেখা পড়ে অভ্যস্ত এবং প্রত্যাশা করেন, আমার লেখাগুলো ঠিক সেরকম নয়-একটু ভিন্নরকম। যেমন আজকের প্রসঙ্গ রান্না এবং খাদ্য। খাদ্যও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে বলেন, খাওয়ার জন্য এই দুনিয়া! আমরা জানি, ‘মানুষ কাজের জন্য বাঁচে এবং বাঁচার জন্য খায়’। আমাদের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার প্রথমটিই হচ্ছে খাদ্য। ঐক্য-অনৈক্য-যুক্ত কিংবা মুক্ত থেকে সরকারি-বেসরকারি যে কোনো দল কিংবা দলে দলে কোন্দল যাই বলি না কেন, সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন খাদ্য। সম্প্রতি রাজনীতিতেও এ খাদ্য এবং খাদ্যের মেন্যু বেশ আলোচিত। সুতরাং খাদ্য বিষয়টি ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

কথায় আছে, ‘কাউকে খাইয়ে যদি করা যায় তৃপ্ত, তবে তার হৃদয়ে পৌঁছাবার পথ হয় সংক্ষিপ্ত’। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘খাদ্যের হাজারো প্রকার থাকলেও খাদক মূলত দুই প্রকারের। ভোজনপটু ও ভোজনবিলাসী। ভোজনবিলাসীরা হরেকরকমের খাবার সামনে থাকলেও বেছে বেছে খায়। আর ভোজনপটু যারা তাদের কোনো বাছ-বিচার নেই। আহার উপযোগী হাতের কাছে যা পায় তাই টপাটপ হজম করে। ভরা পেটেও খাওয়া শুরু করে।’

অনেকে মনে করেন ‘আমরা যাহা খাই তাহাই খাদ্য’, কথাটা ঠিক নয়। দেহের বৃদ্ধি, পুষ্টি এবং তাপশক্তি উৎপাদনে যা সহায়তা করে তাকেই খাদ্য বলা হয়। আর খাবারের উপাদানগুলো মুখরোচক এবং আহার উপযোগী করে তোলার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় সেটাই হচ্ছে রান্না। সুতরাং আপনি যতই খেতে চান বা চান না, তার মূলে কিন্তু রান্না। রান্না করা খাবার অবশ্যই উপাদেয় এবং সুস্বাদু হয়। আর রান্না ছাড়া খাবার স্বাদহীন এবং অস্বাস্থ্যকর। তাই দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেলের কল্যাণে রান্নার অনুষ্ঠান পেয়েছে নানান মাত্রা। আর এ কারণেই এখন রান্না কেবল রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নয়, হাটে-মাঠে-বনে-বাদাড়ে-পাহাড়ে-জঙ্গলে-নদীতে-সাগরে সব জায়গাতেই বিস্তার লাভ করেছে। রন্ধনশিল্পী না হয়েও শুধু উপস্থাপনা গুণে অনেকেই হয়ে গেছেন তারকা। তবে নান্দনিকতা, পুষ্টিগুণ ও খাদ্যমানে টেলিভিশন দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘সিদ্দিকা কবীরস্ রেসিপি’ নামে অনুষ্ঠানটি। মূলত বাংলাদেশে টেলিভিশনে রান্নার অনুষ্ঠানের পথিকৃৎ বলা যায় পুষ্টিবিদ সিদ্দিকা কবীরকে। একসময় তিনি ‘ঘরে-বাইরে’ নামক একটি রান্নার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। যারা রান্না করতে ভালোবাসেন, তারা একবার হলেও সিদ্দিকা কবীরের লেখা রান্না বিষয়ক ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ বইটি পড়েন।

বর্তমানে রান্না বা রন্ধন একটি উৎকৃষ্ট শিল্প। তবে টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে মাঝে মাঝে বেশ খারাপ লাগে, যখন দেখি আপন কৃষ্টি ভুলে কেবল দৃষ্টি ভোলানো সরঞ্জামে, দেশি-বিদেশি খাদ্যের নামে কেউ অহেতুক বনে-বাদাড়ে গিয়ে রাঁধতে বসেন। রান্নায় স্থানভেদে স্বাদের তারতম্য ঘটে না, ঘটে রন্ধনশৈলীর ওপর। একবার এক বাবুর্চির সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কী কী রাঁধতে জানেন? উত্তরে বাবুর্চি বলল-আমি দুরকম রান্নাই পারি। এক. আমার রান্না খেয়ে অতিথি বারবার আপনার বাড়িতে আসবে। দুই. আমার রান্না খেয়ে অতিথিরা জীবনেও আর আপনার বাড়িমুখো হবে না। এখন আপনি বলেন-কোন ধরনের রান্না চান। সে জন্য দেখা যায় বিয়ে একশ কথা নিয়ে হলেও কনে খুঁজতে গিয়ে কথা শেষ হয় একটি কথা দিয়ে। আর সেটা হলো-‘কনের রান্নার হাতটা কেমন?’

আজকাল কিছু কিছু রান্নার অনুষ্ঠান দেখলে আসে কান্না-মনে হয় এরা বোধহয় কোনো কাজ পান না-তাই শুরু করেছেন রান্না। কিছু কিছু রান্নার অনুষ্ঠানে যেসব রান্না শেখায় এবং দেখায় সাধ্য না থাকায় খাদ্য হিসেবে অনেকেই তা পান না, তাই দরিদ্র ঘরের শিশুরা জুড়ে দেয় কান্না, কিন্তু যারা দেখায় তারা তা বুঝতে চান না। যেমন একবার এক গৃহকর্ত্রী তার শিশু সন্তানকে নিয়ে টেলিভিশনে ডুবো তেলে আস্ত ইলিশ ফ্রাই করা দেখছিলেন। ভাজা হয়ে গেলে উপস্থাপিকা মাছটি তুলে একটি বড় ট্রেতে নিয়ে লেটুস পাতা, পুদিনা পাতা, লেবুর পাতা, শসা ও টমেটো দিয়ে সাজিয়ে বললেন, এভাবেই মাছটি পরিবেশন করতে হবে। এসব দেখে শিশুটি তার মাকে বলল-‘আম্মু ইলিশ ভাজা খাব।’

এ কথা শুনে পাশে বসা স্বামী উত্তেজিত হয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘এতক্ষণ তো বসে বসে দেখলে, এখন বাচ্চাটাকে খাওয়াও।’

: ‘এখানে খাওয়ার কথা আসছে কেন? ওরা তো রান্না শেখাচ্ছে।’ স্ত্রী জবাব দেয়।

স্বামী ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘শিখাক কিন্তু ডুবো তেলে রান্না শেখানোর দরকার কী? কয়টা লোকের ডুবো তেলে রান্না করার সামর্থ্য আছে? কম তেলে কম খরচে পুষ্টিগুণ বজায় রেখে কীভাবে রান্না করা যায় সেটা শিখালেই তো পারে। এই যে মাছটি দেখে ছেলেটি কাঁদল, ওকে আমি এখন এই আস্ত ইলিশ খাওয়াব কী করে? আমার কি সে সামর্থ্য আছে?’

: স্ত্রী বললেন, ‘তোমার না থাক অমনকের তো আছে।’

: ‘তাহলে লিখে দিক অনুষ্ঠানটি শুধু পয়সাওয়ালা ও সামর্থ্যবান লোকদের জন্য।’ স্বামীর উত্তর।

সুতরাং রান্নার অনুষ্ঠান করার সময় অনেক বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এর সঙ্গে নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সক্ষমতার বিষয়ও জড়িত রয়েছে। যে কারণে এসব দেখে সবাই সন্তুষ্ট নয়, বরং কেউ রুষ্ট হন, কেউ কষ্ট পান।

রান্না খেয়ে অনেকের কান্নাও আসে রান্নার দোষে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে খেতে হয় এবং মনের ক্ষোভ চেপে রাখতে হয়। খাবারের প্রসঙ্গ এলেই রন্ধনশৈলীর বা পাচকের কথা চলে আসে। ইংরেজিতে এদের বলে শেফ। অনেকে আবার সঠিক শব্দ প্রয়োগ করতে না পেরে বাবুর্চিও বলে থাকেন। তবে পাচক, শেফ, বাবুর্চি যাই বলি না কেন-সবার কাজই হচ্ছে রান্না করা। একসময় শুধু মহিলারা রান্নাবান্নার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এখন পুরুষদেরও কমবেশি রান্না করতে হয়। রান্নাঘরের কর্তৃত্ব মেয়েদের হলেও আমাদের দেশে কোনো নারী বাবুর্চির নাম শোনা যায় না। তবে অমনক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুরুষ রন্ধনশিল্পীরা রন্ধন কাজে নারীদেরও হার মানায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠসব শেফরা হলেন পুরুষ। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত হোটেলগুলোতেও শেফ হলো পুরুষ। যেমন ভারতের বিশ্বসেরা রন্ধনশিল্পী হলেন সঞ্জীব কাপুর। একই সঙ্গে তিনি একজন টেলিভিশন হোস্ট এবং লেখকও। আজকাল আমরা যেসব মাস্টার শেফদের অনুষ্ঠান দেখি, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের বিশ্বসেরা শেফ ট্রটারের। তার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ‘দ্য মাস্টার শেফ’। বিশ্বসেরা ১০ জন রন্ধনশিল্পীর তালিকায় রয়েছেন ফ্রান্সের পল বোকাসে। তাকে বলা হয় ফ্রান্সের রন্ধনশিল্পের ফাদার বা কুকিং আইকন। টিভিতে মাত্র ১৫ মিনিটের রান্নার অনুষ্ঠান করে লোভনীয় খাবার প্রস্তুতে খ্যাতি অর্জন করেছেন জেমি অলিভার। তেমনি ব্রিটেনে কারি কিং নামে খ্যাত মৌলভীবাজারের টমি মিয়া একজন ব্রিটিশ সেলিব্রেটি শেফ। আসলে রান্না হলো বিশেষ ধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের মিশ্রণের ওপর তাপ প্রয়োগ করে গ্রহণযোগ্য ও স্বাদযুক্ত খাদ্য তৈরি করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনমান যেমন পাল্টে যাচ্ছে, তেমনি পাল্টাচ্ছে খাদ্যের ধরন। আর এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যাচ্ছে রান্নার কৌশল। ভালো রান্না বা সুস্বাদু খাবার রান্নার জন্য প্রয়োজন সঠিক অনুমান ক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা।

মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে রান্না দেখা সম্ভব না হলেও বিভিন্ন চ্যানেলের সুবাদে আজকাল বাহারি সব রন্ধনক্রিয়া দেখা যায়। অদ্ভুত অদ্ভুত সব রেসিপি। কিছু জানা কিছু অজানা। এসব অনুষ্ঠানে আবার অতিথিও থাকেন। অধিকাংশই সেলিব্রেটি। যাদের অনেকেই কখনো রান্নাঘরে ঢোকেননি। এদের অনেকেরই প্রিয় রেসিপি আলু ভর্তা এবং ডিম ভাজি। তারপরও তারা এসব অনুষ্ঠানে এসে রান্নাবিষয়ক বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ফলে প্রায়শই তথ্য বিভ্রাট ঘটে। এসব অনুষ্ঠানে সেলিব্রেটিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় সম্ভবত বৈচিত্র্যর জন্য। কিন্তু রান্নার অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য প্রয়োজন রান্নার, শিল্পীর নয়। এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সংগীত শিল্পীর হাতে একটি গিটার থাকবেই। কারণ শিল্পী ধরেই নেয় তাকে দুই লাইন হলেও গাইতে হবে। এত অনুষ্ঠান থাকতে এ রান্নার অনুষ্ঠানে এসে তাকেই বা গাইতে হবে কেন? তবে মডেল তারকা বা নৃত্যশিল্পীরা এসব থেকে রেহাই পান। তাদের নাচতে বা ফ্যাশন শো করতে হয় না। রান্নার অনুষ্ঠানে এসব সেলিব্রেটিদের না এনে বরং অতিথি হিসেবে কোনো পুষ্টিবিজ্ঞানী, কৃষিবিদ বা মৎস্য কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। পুষ্টিবিজ্ঞানী বলবেন খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিয়ে। কৃষিবিদ বলবেন শাকসবজি নিয়ে। আর মৎস্য কর্মকর্তা বলবেন মাছ নিয়ে। কারণ এখনকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই জানে না কোনটা কোন সবজি বা কোনটা কী মাছ, আর সেগুলো দেখতেই বা কেমন। যেমন ঢেঁকি শাক, শর্ষে শাক, মালঞ্চ শাক, হেলেঞ্চা শাক, পালং শাক, বউত্তা শাক, কলই শাক-এমনি অনেক শাকই অনেকে চেনেন না। তেমনি ইলিশ, পাঙ্গাশ, রুই, কাতলা, কই, মাগুর, বোয়াল, আইড়, শোল ছাড়া অনেক মাছই এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা চেনে না। যেমন-মলা, ঢেলা, চেলা, চান্দা, চাপিলা, বাতাসি, রানী, কাচকি, কাজরি, পোয়া, তপসি, বাটা, গুলশা, বাইলা, টাকি, এমনি অনেক মাছের সঙ্গেই অনেকে অপরিচিত।

আমরা বলি, মাছে ভাতে বাঙালি আর কবি ঈশ্বর গুপ্তের কথায়, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’ বলা যায়, এই ভাত-মাছ আমাদের খাবারের ঐতিহ্য। বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো রান্নার বই ‘পাক রাজেশ্বর’ প্রকাশিত হয় উনিশ শতকে। এরপর ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘পাক প্রণালী’। এ দুটি বইতে বিভিন্ন মাছ রান্নার কথা লেখা আছে। কিন্তু আজকালকার ৯০ শতাংশ রান্নার অনুষ্ঠানে মাছের উপস্থিতি বা মাছ-ভাতের কোনো রেসিপি নেই। হররোজ বিদেশি সব উদ্ভট আইটেম নিয়েই সবাই ব্যস্ত। রান্নার অনুষ্ঠানে একটি পর্ব রাখা যায়, যেখানে এসব শাকসবজি ও মাছের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে ছোট মাছের নানান রেসিপি দেখানো যায়। তাতে কোন মাছ কীভাবে রান্না করলে সুস্বাদু হবে বা খেতে ভালো লাগবে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে কিছু রান্নার অনুষ্ঠানে অদ্ভুত সব রেসিপি দেখানো হয়-অ্যাসপারাগাস মলা চর্চরি, চিকেন বিফ ঝুরঝুরি, স্কুইয়ার্ড চিকেন লিভার, মাটন রোগান জোস, বিফ ভিন্দালু, গোল্ডেন হুক, এসপানিয়োলা, চিকেন মোমো, নাসি গোরেং, নুডলসের চপসি। এসব বিদেশি খাবারের অধিকাংশই বড় বড় হোটেলে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু চাইনিজ, কিছু স্প্যানিশ খাবারও আছে। আমাদের দেশের ৮০ ভাগ মানুষ এসব খাদ্যে অভ্যস্ত নন এবং তাদের এসব রান্না শেখারও কোনো আগ্রহ নেই বরং আমাদের মায়েরা যে রান্না করেন সেটাতেই তাদের পরম তৃপ্তি এবং আগ্রহ। তারপরও তারা এসব দেখাচ্ছে এবং শেখাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এসব রেসিপি দেখানোর সময় খাবারের অনেক বাড়তি গুণগানও বর্ণনা করা হয়, যা সত্যি নয়।

আমাদের খাদ্যের ঐতিহ্য অনেক পুরনো কিন্তু নানান বিদেশি খাবারের চক্করে পড়ে সেসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

ই-মেইলের মাধ্যমে পিয়াস নামক একজন দর্শক একবার আমাকে লিখেছিলেন, এদেশের গ্রাম্য গৃহবধূ হতে শুরু করে শহুরে চাকরিজীবী মায়েরা তাদের বহু ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারের সবার জন্য কষ্ট করে নানা ধরনের খাবার তৈরি করেন। যেসব খাবার কেবল সুস্বাদুই নয়, নানা পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যকর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে রেস্টুরেন্টের নানা ধরনের পশ্চিমা খাবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও জাঙ্কফুড নামধারী এসব খাবারের স্বাদের অতিরঞ্জনের কারণে আমাদের স্কুল-কলেজ পড়–য়া কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা এসব অস্বাস্থ্যকর ও তুলনামূলক কম পুষ্টিসম্পন্ন খাবারের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেশের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান একটি অংশ রন্ধনশৈলীর অবস্থাটা কী হবে? এক সময় কি তা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে না?

উত্তর হচ্ছে, না, হারিয়ে ফেলবে না। আমাদের খাদ্যসংস্কৃতি এবং রন্ধনশৈলী চিরকালই বেঁচে থাকবে। রন্ধনশিল্পের ভবিষ্যৎ চিন্তার চেয়ে এ ধরনের জাঙ্কফুডপ্রেমীদের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটাই বেশি চিন্তার বিষয়। মায়ের হাতের রান্নায় শুধু মমতা নয়-স্বাস্থ্য চিন্তাটাও জড়িত থাকে, যা ক্রেতার জন্য বিক্রেতার রান্নায় থাকে না। যে রান্না করা খাবার খেয়ে আপনি, আমি দিনে দিনে বেড়ে উঠেছি। যে রান্না করা খাবার দিয়ে আমাদের গ্রামগঞ্জে মা-বোনেরা মেহমান-অতিথিকে আপ্যায়ন করেন। সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠে রান্না সেরে যে বোনেরা কাজে বেরিয়ে পড়েন। আমার মা-বোনেরা যে রান্না তার মা-বোনদের কাছ থেকে শিখেছেন, সেসব রান্না কোথায়? সবাই যেন বিদেশি খাবার নিয়ে ব্যস্ত। শুধু তাই নয় এসব রান্নার অনুষ্ঠান অর্থবিত্তের জোরে বিদেশে গিয়েও ধারণ করা হচ্ছে। তাতে কি রান্নার মান বাড়ছে?

এসব রান্নার অনুষ্ঠান কি এমন হতে পারে না-যে অনুষ্ঠান দেখে মানুষ খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারে। কীভাবে রান্না করলে খাবার সুস্বাদু হবে। মাড় না ঝরিয়ে কীভাবে ভাত রান্না করা যাবে। কোন মাছের সঙ্গে কোন সবজির ভালো সমন্বয় হবে।

কোন রান্নায় কী পরিমাণ মসলা কিংবা তেল দিতে হবে। কোন ধরনের তেল ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম থাকবে। দেশীয় খাবার নিয়ে এমনি নানা ধরনের তথ্যসমৃদ্ধ রান্নার অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। আর এ প্রস্তাবগুলো আমার না-আমাদের দেশের হাজার হাজার মা-বোনের।

বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা অনেক কিছুই হারাতে বসেছি। শেষ পর্যন্ত রান্নাটাও যদি বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হয়ে যায় তবে শুধু ঐতিহ্যই নয়, আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই যারা রান্নার অনুষ্ঠান করেন তাদের প্রতি অনুরোধ এমন কিছু করুন যাতে বেঁচে থাকে আমার মায়ের হাতের রান্না।

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

সর্বশেষ খবর