বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কলম

মো. আবদুল মান্নান

মুক্তিযুদ্ধের বছরটিতে পঞ্চম শ্রেণিতেই থেকে যাই আমি। বাড়ি থেকে প্রতিদিন রেলস্টেশন পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ট্রেন দেখতাম। ট্রেনের জানালা বরাবর দুই পাশে রাইফেল-মেশিনগান ইত্যাদি তাক করে রাখত তারা। সাধারণ মানুষ, পথচারী সবাই সুনসান স্তব্ধতায় আতঙ্কগ্রস্ত। তবু জীবিকার সন্ধানে মানুষকে বের হতে হতো। নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদিখানায় যেতে হতো। গ্রাম বাংলার মানুষের হাটে গিয়ে পণ্য বিনিময় করে জীবন ধারণই ছিল প্রধান কাজ। যেমন ধান, চাল বিক্রি করে লবণ বা কেরোসিন নিয়ে আসা। ’৭১ সালে যতদূর মনে পড়ে ধান, চালের দাম খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। তখনো আমাদের ভাটি বাংলার পূর্বপুরুষরা নিজেদের জমিতে উৎপাদিত ধান, পাট বিক্রি করেই সারা বছরের পারিবারিক চাহিদা মেটাতেন। তাদের জীবিকার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ কৃষিজ পণ্য। শতভাগ সততা আর কায়িক শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত শস্যসম্পদই তাদের কাছে আত্মতুষ্টির সবচেয়ে বড় নিয়ামক।

আজও মনে পড়ে সে সময় এক মণ ধানের সমপরিমাণ মূল্যের টাকা মার কাছ থেকে নিয়ে যাই। মাকে বললাম, কিশোরগঞ্জ শহরে গিয়ে একটি ভালো কলম কিনে আনব। মা বললেন, কলমের জন্য কিশোরগঞ্জে যাওয়ার দরকার কী? তোমার বাবা শুনলে রাগ করবেন। তথাপি অনেকটা বায়না ধরে কদিন পর ট্রেনে চড়ে কিশোরগঞ্জ শহরে যাই। ট্রেনে মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিটের পথ। সঙ্গে আরও দু-এক জন ছিলেন। তখন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘পেন হসপিটাল’ নামে একটি ছোট্ট দোকান। তখনকার দিনে যাবতীয় কলম মেরামত করার দোকান সেটি। তারা কলম বিক্রিও করত। পাশেই ‘খেলাঘর’ নামে বেশ বড় একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোর। মনে পড়ছে সেই ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকেই কলমটি কিনি। দাম ১১ টাকা। লাল-কালো রঙের কলম। নাম ‘ইয়থ’। দোয়াত থেকে কলম চুবিয়ে সংযুক্ত ড্রপার দিয়ে কালি নেওয়া যেত। তখনো ফাউন্টেন পেনে পৃথক ড্রপার দিয়ে কালি প্রবেশ করানো হতো। এদিক থেকে সেটি ছিল আধুনিক।

২০ টাকার মতো পুঁজি নিয়ে জীবনে প্রথম মহকুমা শহরে যাই। কলম কিনে অনেক টাকাই অবশিষ্ট থেকে যায়। মনে হয় কিছু খাবার ও দু-একটা খাতা-পত্রও নিয়ে এসেছিলাম। পরদিন সকালে বাবা কলমটি হাতে নিয়ে দেখলেন। বললেন, ‘তোমার কি এত দামি কলম দিয়ে লেখার বয়স হয়েছে? এখন তো শ্লে­ট-পেনসিলে লেখার সময়।’ বাবা খুব বেশি খুশি হতে পারেননি। কারণ, কলমটি আমি স্কুলে নিয়ে গেলেই হয় হারাব না হয় ভেঙে ফেলব। তা ছাড়া সে সময় স্টিলবডির রিফিলযুক্ত ছোট ছোট কলম পাওয়া যেত। দাম ১ টাকা। ভালো লেখা হতো। এমনকি পুনঃ রিফিল করানো যেত। আমরা বলতাম লোহার কলম। শিশুদের জন্য কলমগুলো ভালো ছিল। কোথাও পড়লে বা ইচ্ছা করলেও নষ্ট করা যেত না। মনে পড়ে স্কুলে কলমটি খুব সাবধানে দু-চার দিন নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে কারও হাতে দিইনি। পকেটে ঝুলিয়ে রাখলেও সব সময় চোখে চোখে ছিল কলমটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য! অতি সতর্কতার কারণে মাত্র কদিন পরই কলমটি হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গিয়ে সামান্য ফেটে যায়। যেন বাবার ভাবনাই যথার্থ হলো। তবে এ আঁচড়টি তেমন দৃশ্যমান ছিল না। তথাপি দীর্ঘদিন এটি আমি গোপন রেখেছিলাম। কেননা, বাবা শুনলে ভীষণ খেপে যাবেন। বাবা এমনিতেই রাগী মানুষ ছিলেন। মা বলতেন, ‘এত টাকা দিয়ে যখন কলম নিয়েছ। এখন জোরে জোরে পড়তে হবে। তোমার বাবা শুনলে খুশি থাকবেন।’

ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে সাজসাজ রব। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা দিবালোকে জনতার কাতারে এসে একাত্ম হচ্ছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের দেশাত্মবোধক গান বাতাসে ভেসে আসছে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোাগানে মুখর গ্রামের জনপদ। আমার ক্লাসের সবাই অটোপ্রমোশন নিয়ে হাইস্কুলে উঠে যায়। কিন্তু আমি অটোপ্রমোশন নিইনি। থেকে গেলাম একই শ্রেণিতে। বাবা বললেন, পরীক্ষা পাস করে ওঠাই ভালো। সারা বছর পড়ালেখা না করে ক্লাস ডিঙিয়ে কী হবে? আমি তাই করলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে দুই বছর। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যেন আমাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছে। যদিও বিখ্যাত আদু ভাইয়ের গল্পটি তখনো পড়া হয়নি। প্রাইমারি স্কুল বলছে ওই বড় ঘরে তোকে ‘যেতে নাহি দেব’। অর্থাৎ, একই ক্যাম্পাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটির একেবারে সংলগ্ন উত্তর-দক্ষিণে লম্বা টিনশেডটিতেই ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ক্লাস হতো। আজও গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় গাড়ির গ্লøাস নামিয়ে ওই ভবনটির দিকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকাই। আহা! কি কৈশোর! কি নস্টালজিক শৈশব!

তবে কর্মজীবনে এসে কলম ব্যবহার করতে গিয়ে কাউকে বিব্রত বা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে এমনও দেখেছি। জেলা সফরে গিয়ে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবকিছু খুঁটিনাটি দেখছেন। অফিসকক্ষ, সভাকক্ষ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা, দাফতরিক কাজের মান, নথি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। তার দৃষ্টি এবার অধস্তনদের পোশাকের প্রতি। তিনি দেখলেন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা প্রায় সবাই রুচিসম্মত, মানানসই পোশাক পরিধান করেই দাঁড়িয়েছেন। করমর্দন করে করে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে ধীর পদক্ষেপে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। সবাই একে একে হাতে হাত রেখে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। আকস্মিক বিপত্তি ঘটল একজন অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসকের বেলায়। তার পরিহিত প্যান্ট-শার্ট-টাই বেশ চমৎকার। শুধু পকেটে রাখা কলমটি ছিল খুবই নিম্নমানের দুই টাকার একটি বলপয়েন্ট কলম। বড় কর্মকর্তা নিজেই পকেট থেকে টান দিয়ে কলমটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এমন পোশাকের সঙ্গে এটি যায় না। মনে রাখবেন, কলম সবসময় লেখার জন্য নয়, এটি একটি অলঙ্কার এবং আভিজাত্যের প্রতীক। এ কারণেই দুনিয়ার অনেক মানুষ সোনার কলম ব্যবহার করেন।’

আশ্চর্য! এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭৩ সালে চাতল বাগহাটা হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া অবধি আমার সামান্য ফেটে যাওয়া ‘ইয়থ’ কলমটি সঙ্গেই ছিল। অন্য সবকিছুতে সামান্য পিছিয়ে থাকলেও দামি কলম নিয়ে আমি স্কুলে বেশ অগ্রসরমান ছিলাম। আজ তাই মনে হয়। দীর্ঘ অতিক্রান্ত চাকরি জীবনে বাহারি রঙের অনেক মূল্যের শত শত দেশি-বিদেশি কলমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। যেমন পাইলট, পার্কার, ক্রস, রস্ট্রাম, হিরু, শেফার ইত্যাদি কোম্পানির কলম। আবার কখনো উপহার পাওয়া অসংখ্য মূল্যবান কলম, অগণিত ব্র্যান্ডের দৃষ্টিকাড়া কলম, প্রিয়জনকে উপহার দেওয়া-নেওয়া এসব চলেছে নিত্যদিনের মতো। তবু প্রথম কৈশোরের ছোঁয়ায় একান্ত নিজের পছন্দের অতিউৎসাহে কেনা ‘ইয়থ’ কলমটিকে আজও ভুলে থাকতে পারিনি।

লেখক : গল্পকার ও গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর