শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের ম্যারাথন যাত্রা সফল হোক

এ এইচ খান রতন

গণতন্ত্রের ম্যারাথন যাত্রা সফল হোক

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশে এখন প্রবল নির্বাচনী বাতাস বইছে। বিরোধী জোটের ক্রমবর্ধমান হুঙ্কারে রাজনীতির মাঠে সাধারণ মানুষের মনে যে আশঙ্কা আর উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, জোটগুলো নির্বাচনমুখী হওয়ায় এ আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশে দেশের জনগণ এখন আগের চেয়ে অনেক পরিপক্ব। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রবণতা জনগণের মাঝে এখন আর আগের মতো নেই। শিক্ষা ও আধুনিক জীবনযাপনের স্পর্শে মানুষ এখন নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকার সচেতন। দেশের মানুষ আজ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ সামরিক শাসন জাতিকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কোনো ক্ষেত্রেই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে চলেছে দেশ। সাধারণ মানুষ মনে করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, স্বাধীনতা যুদ্ধে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন এমন অনেক নেতৃবৃন্দ ছিলেন, যারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রত্যয়ে রুখে দাঁড়াতে পারতেন। জাতির দুর্দিনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে চাঁদের আলোর ন্যায় তারা নেতৃত্বের দ্যুতি ছড়াতে পারতেন। কিন্তু, তা না করে রকমারি স্বাদ গ্রহণের আশায় কাঠবিড়ালির মতো তারা এ ডাল থেকে ও ডালে লাফালাফি করেছেন। যাদের নেতৃত্বের ওপর জনগণ আস্থাশীল ছিল জাতীর দুঃসময়ে তারা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই জনগণের কাছে তারা চন্দ্রালোকের পরিবর্তে, এক একটি জোনাকি পোকা মাত্র। ক্ষমতা যাদের পেছনে ঘোরার কথা, ক্ষমতার জন্য তারা আজ নানা ফ্রন্ট নানা ব্যানারে মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাস্যরসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। কে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, কার হাতে প্রথম জাতীয় পতাকা উড়েছিল, কে কত বার ঢাকসুর ভিপি হতে পেরেছিলেন, কে বঙ্গবন্ধুকে পিতাবলে সম্বোধন করে, রাজাকার আর আল-বদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন যে নেত্রী তার মুক্তির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর মতো দুঃসাহস দেখান, জনগণ তাদের খোলসের ভিতরের আসল চেহারা চিনতে পেরেছে। গায়ে বঙ্গবন্ধু কোট পরে মুখে জয় বাংলা বলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে চাচ্ছেন? নিজামী আর মুজাহিদীর গাড়িতে মুক্তিযুদ্ধাদের রক্তে অর্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল, সে দিন কোথায় ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? পতাকাটি নামানোর জন্য কেউ কি প্রতিবাদ করেছিলেন? অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেদিন যারা জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য গণভবনে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের মধ্যে ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ জনগণের কথা ভুলে গিয়ে তার গুলশানের বাড়িটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবদার করেন এবং চিকিৎসক এক নেতা তার বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেন-দরবারের চেষ্টা করেন। অবাক করার বিষয় হলো, তারা নাকি জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য গণভবনে গিয়েছিলেন! গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশে অন্তত আরও দুই-তিনটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল থাকলে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হতো, শক্তিশালী হতো গণতন্ত্র, অথচ কয়েক ডজন দল এমনকি কয়েকটি জোট মিলেও প্রয়োজনীয় একটি দলের অভাব পূরণ হচ্ছে না। এ দায়ভার নিশ্চয়ই দেশের প্লাটফর্মহীন ওইসব রাজনীতিবিদের যারা আজ দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন ঐক্য করতে। তাই স্বভাবতই দেশের জনগণ আপনাদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা করছে। আপনারা দেশের জনগণকে চিরকাল ভাঙা কুলার মতো ব্যবহার করেছেন। নির্বাচন এলে এমপি হতে জনগণের কাছে ছুটে গেছেন, তারপর লা-পাত্তা। ১৯৪৭ সালের আগের হিসাব বাদ দিলে একজন শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তর্জনী নির্দেশ করতে বাংলার মাঠ ঘাট চষে বেরিয়ে এ যোগ্যতা ও মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ২৩ বছর। জন নেত্রীকে আজকের অবস্থানে পৌঁছতে পিতার মতো অবিরাম বাংলার জনগণের দ্বারে দ্বারে সেবার দাবি নিয়ে, প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বার বার হত্যা চেষ্টা হতে বেঁচে গিয়ে সময় লেগেছে প্রায় ৩৮ বছর। বাংলাদেশের আজকের প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী বিরোধী দল জাতীয় সংসদে অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু যাদের শরীরে পোড়া মানুষের গন্ধ আর বীরাঙ্গনাদের আর্তচিৎকার শোনা যায় দেশের জনগণ তাদের জাতীয় সংসদে দেখতে চায় না। ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বহুপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে বিজেপির মতো কট্টর মৌলবাদী দল গুজরাটে দাঙ্গার অভিযোগ মাথায় নিয়েও শুধু গণতন্ত্রের পথে হেঁটে হেঁটে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে আজ ক্ষমতায়। কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও দীর্ঘ দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ প্রাচীন একটি গণতান্ত্রিক রাজনীতিক দল গঠনমূলক গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, হয়তো সফলও হবে। কিন্তু কংগ্রেসের কোনো জনসভায় বিজেপি আর্জেস গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে বলে বিশ্ববাসী শোনেনি। গণতন্ত্রের পথে লড়ে জনগণের মন জয় করে আমআদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল আজ দিল্লির মসনদে। আমাদের দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকতে নয়, বরং পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তেই অবিরাম কাজ করে চলেছেন। কর্মই তার প্রমাণ। তিনিও আশা করেন, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনেই স্বাধীনতা বিরোধীমুক্ত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল গড়ে উঠুক। যারা হবেন দেশপ্রেমিক। যেখান থেকে জনগণের পক্ষে কথা বলার মানুষ তৈরি হবে। গণতন্ত্রের ম্যারাথন যাত্রায় যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতার দাবিদার। 

                লেখক : কলাম লেখক।

সর্বশেষ খবর