সোমবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্গম যাত্রায় ইত্যাদি

হানিফ সংকেত

দুর্গম যাত্রায় ইত্যাদি

আমরা টিভিতে-ছবিতে-বইতে-পোষ্টারে-ক্যালেন্ডারে-কার্ডে-অ্যাডে অনেক চিত্তাকর্ষক ও মনোমুগ্ধকর ছবি দেখি, পাহাড়-নদী-সাগর-ঝরনা-সবুজ বনভূমি-দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ প্রান্তর। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এমনি অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান, রয়েছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ জনগুরুত্বপূর্ণ এবং পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্থান। যা হতে পারে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য দর্শনীয় স্থান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যখনই আমরা এসব জায়গায় যাওয়ার চিন্তা করি তখনই একটি বাধা এসে সামনে দাঁড়ায়, তা হচ্ছে-অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও এসব জায়গায় সপরিবারে যাওয়ার উপায় থাকে না। তবে ভ্রমণপ্রিয় তরুণরা সব বাধা পেরিয়ে এসব স্থানে চলে যায় অজানাকে জানার জন্য। আমাদের দেশে এই তরুণরাই আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন অনেক পর্যটন স্থান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইত্যাদি অনুষ্ঠান ধারণ করতে গিয়ে আমরাও দেখেছি বাংলাদেশে এমন অনেক দুর্গম অঞ্চল রয়েছে যেখানে টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণ তো দূরের কথা, কখনো কোনো টিভি ক্যামেরাও পৌঁছায়নি। ভ্রমণপ্রিয় তরুণদের মাধ্যমে ইউটিউবে দেখলেই বোঝা যায় এসব এলাকা কত দর্শনীয়। কিছু কিছু স্থান বিদেশের চাইতেও সুন্দর। ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের কাছে ‘দূর’ বা ‘কাছে’ বিবেচ্য বিষয় নয়। অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যের স্বার্থে পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন যেখানে প্রয়োজন আমরা সেখানেই গিয়েছি, এখনো যাচ্ছি। অনুষ্ঠানের স্বার্থে আমরা খাগড়াছড়ি, নীলফামারী, রাঙামাটি, খুলনা, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, কক্সবাজার, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা ইপিজেডসহ দেশের অধিকাংশ জেলায় ইত্যাদি ধারণ করেছি। তবে এসব দুর্গম অঞ্চলে যাত্রা নিয়ে আমরা কখনো টেলিভিশনে কোনো আলাদা অনুষ্ঠান নির্মাণ করি না বা কোনো চ্যানেলের নিউজেও প্রচার করি না। যে কারণে ইত্যাদির বিশাল টিম নিয়ে এসব এলাকায় অনুষ্ঠান নির্মাণ করা কতটা কঠিন ও দুঃসাধ্য সেটা অনেকেই জানেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুর্গম হলেও এসব অনুষ্ঠানে কোথাও কোথাও লক্ষাধিক দর্শকের সমাগম হয়। যেমন এবারের অনুষ্ঠানস্থল ছিল সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাট। যেখানে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌকা এবং মোটরসাইকেল। অথচ ইত্যাদি ধারণের সময় এখানেও লক্ষাধিক দর্শক সমাগম হয়েছিল। অনেক দর্শকই আমাদের ই-মেইল, ফেসবুক, ইউটিউবে এ দুর্গম যাত্রার পর্দার পেছনের গল্প শুনতে চেয়েছেন। এ লেখাটি সেই দর্শকদের অনুরোধের ফসল।

আজকাল টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান দেখা যায়। অধিকাংশ অনুষ্ঠানই স্টুডিওভিত্তিক গৎবাঁধা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ষ্টুডিওতে বসে দুই বা তিন ক্যামেরায় দুই-এক ঘণ্টার মধ্যেই এসব অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব। নামের ভিন্নতা থাকলেও অনেক অনুষ্ঠানেরই চেহারা অভিন্ন। তারপরও এসব অভিন্ন চেহারার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নির্মাতাদের আনন্দের কমতি নেই। বেশ ফুর্তির সঙ্গেই কেক কেটে পালন করেন বর্ষপূর্তি। আসলে নির্মাণকাজ যারা করেন তারাই এখন নির্মাতা, নির্মাণ মান যাই হোক না কেন ব্যস্ততার কারণে তাদের অনেকেরই দম ফেলার সময় নেই একদম। তবে আমাদের ক্ষেত্রে একটি এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে লোকেশন নির্বাচন থেকে শুরু করে ওই স্থানের ওপর গবেষণা ও অন্যান্য কাজে অনুষ্ঠান ভেদে এক থেকে তিন মাস লেগে যায়। যখন দেশে কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না তখন থেকেই টিভির অনুষ্ঠানকে স্টুডিওর চার দেয়ালের মধ্য থেকে বাইরে নিয়ে এসেছিলাম আমরাই এবং এখনো সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছি। বৃষ্টি ঝুঁকি না থাকায় আমরা শীতকালেই দূরবর্তী স্থানগুলোতে যেতে চেষ্টা করি। রাতে ধারণ হয় বলে আমাদের প্রচুর লাইট ব্যবহার করতে হয়, সেটও বানাতে হয়। স্বভাবতই বৃষ্টি হলে এগুলোর ক্ষতি হয়। তাছাড়া বিভিন্ন জেলায় গিয়ে আমরা যে কোনো স্থানে বা খোলা মাঠ পেলেই অনুষ্ঠান করি না। আমরা দেখি ওই স্থানটির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্ব কিংবা নৈসর্গিক সৌন্দর্য। তবেই সেই স্থানটিকে আমরা ধারণ স্থান হিসেবে বিবেচনা করি।

অক্টোবর মাসে ইত্যাদির নীলফামারী পর্ব প্রচারের পর আমরা গত নভেম্বরে প্রচারিতব্য ইত্যাদির জন্য নূতন স্থানের সন্ধান করছিলাম। আমাদের পছন্দের তালিকায় অনেকগুলো স্থান ছিল। এর মধ্যে সবচাইতে দূরবর্তী স্থান ছিল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টেকেরঘাট এলাকা। ইউটিউবে জায়গাটি দেখে আমাদের অসম্ভব পছন্দ হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয় বলে ইত্যাদির বিশাল টিম এবং কয়েক ট্রাক শুটিং উপকরণ নিয়ে এই দুর্গম যাত্রা যে বেশ কঠিন হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম। সাধারণত স্থান নির্বাচনের জন্য আমরা প্রথমে অগ্রগামী দল পাঠাই। তারা কয়েকটি স্থান দেখে সেসব স্থানের ভিডিও করে নিয়ে আসে। সেসব ছবি দেখে আমরা প্রাথমিক সিদ্ধান্তটা নেই। তবে এবার আর অগ্রগামী দল নয়, সহকারীদের নিয়ে আমি নিজেই গত ১২ অক্টোবর স্থান নির্বাচনের জন্য রওনা দেই। এ যেন দূরপাল্লার যাত্রা। প্রথমে ঢাকা থেকে সিলেট, এরপর সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে সীমান্তঘেঁষা উপজেলা তাহিরপুর। তাহিরপুর থেকে বিজিবির একটি স্পিডবোটে টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে আমরা যখন টেকেরঘাটে পৌঁছি, তখন বিকাল হয়ে গ্যাছে। আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন বিজিবির স্থানীয় সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল জনাব মাকসুদুল হক। পানিতে টইটম্বুর টাঙ্গুয়ার হাওর। দেখলে মনে হবে আমরা যেন কোনো মহাসমুদ্র দিয়ে যাচ্ছি। এপার-ওপার দেখা যায় না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। একটানা এক ঘণ্টা স্পিডবোট চলার পর আমরা দেখা পেলাম মেঘালয়ের পাহাড় আর টেকেরঘাটের উঁচু-নিচু টিলার সারি।

টেকেরঘাটে পৌঁছামাত্রই ৮-১০টি মোটরসাইকেলসহ সীমান্তরক্ষী ক’জন বিজিবি সদস্য আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর তাদের মোটরসাইকেলে চড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকেশনে পৌঁছে গেলাম। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা, একদিকে উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো সবুজ টিলার সারি, অন্যদিকে লেক ও পাহাড়ের সমন্বয়। স্থানটিকে দেখলে মনে হয় প্রকৃতি যেন উদার হস্তে সাজিয়েছে এই টেকেরঘাটকে। স্থান নির্বাচন শেষে আবারও স্পিডবোটে উঠলাম। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, কারণ রাতে হাওরে কোনো নৌকা বা স্পিডবোট চলে না। কারণ দিক নির্ণয় করা কঠিন হয়। যেতে কম সময় লাগলেও ফিরতে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো লেগে গেল। আর তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জ আসতে আসতে বেজে গেল রাত ৯টা। রাতে দেখা হলো জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদের সঙ্গে। জানলাম তিনি নিয়মিত ইত্যাদি দেখেন, তাই ইত্যাদির প্রতি তার একটা আলাদা ভালোবাসা আছে। তিনি এবং পুলিশ সুপার মো. বরকতউল্লাহ খান আমাদের সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।

পরদিন ঢাকা ফিরেই সেট, লাইট ও সাউন্ডের কলাকুশলীদের সঙ্গে বসলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দুর্গম অঞ্চলে তাদের মালামালের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে কেউই যেতে ইচ্ছুক নন। আমি সবাইকে বোঝালাম। সবকিছুর দায়দায়িত্ব আমার কাঁধে নিলাম। আমার প্রচ- ইচ্ছার কাছে সবাই হার মানলো। সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম নভেম্বরের ১৯ তারিখে ধারণ হবে। সব প্রস্তুতি শেষে নভেম্বরের শুরুতেই আমাদের টিমের একটা অগ্রগামী দল পাঠালাম টেকেরঘাটে, বিশেষ করে বিদ্যুতের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে বেশ ক’দিন সময় লাগে। কারণ এলাকায় বিদ্যুৎ থাকলেও আমাদের অনুষ্ঠান ধারণ স্থানের কাছে কোনো বিদ্যুতের খুঁটি নেই, ট্রান্সফরমারও নেই। তাই আলাদা কয়েকটি খুঁটি বসিয়ে ট্রান্সফরমার এনে সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কিন্তু স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সময়মতো ইত্যাদির জন্য কাজটি করে দিয়েছেন। এরপর আমাদের পুরো টিমের যাতায়াত ব্যবস্থা, কোন ঘাটে জিনিসপত্র নামবে, কোত্থেকে উঠবে ইত্যাদি আনুষঙ্গিক কাজ সেরে অগ্রগামী দল ফিরে আসে। তারপর আমরা ১৬ তারিখে আরেকটি দল পাঠাই সেটের জিনিসপত্র নিয়ে। সেটের মাল বহনকারী একটি ট্রাক বড় একটি দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায়। যা গত ৩০ নভেম্বর-২০১৮ তারিখে প্রচারিত ইত্যাদিতে অনেকেই দেখেছেন। আর ১৭ তারিখ বিকালে আমি একটি ইউনিট নিয়ে সুনামগঞ্জ পৌঁছি। আমার সঙ্গে ছিল দেশের খ্যাতিমান ক্যামেরাম্যান বন্ধুবর আনোয়ার হোসেন বুলু ও দু’জন ক্রু। ৩০ বছর ধরে বুলু ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত আছেন। যে কারণে আমাদের মধ্যে একটি চমৎকার সমঝোতা রয়েছে। সুনামগঞ্জ আমাদের কবি ও মরমি সাধকদের সাধন সংগীতের এক বিশাল ভা-ার। দেওয়ান হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দুর্বীন শাহ, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ এবং শাহ আবদুল করিমসহ আরও বহু লোক সাধকদের অমর সংগীতে মুখরিত এই সুনামগঞ্জ। বিজিবির রেস্ট হাউসে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা প্রথমেই হাছন রাজার বাড়িতে গেলাম। সেখানে হাছন রাজার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি জাদুঘর করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌরসভা এলাকার তেঘরিয়ায় সুরমা নদীর কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত সেই জাদুঘরটি। সংগীতপিপাসু পর্যটকদের জন্য এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত জামা, খড়ম, তরবারি, ঢাল, ঢোল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতা ও গানের পান্ডুলিপি আজও দর্শনার্থীদের আবেগে আপ্লুত করে। এই মরমি কবির রচিত গানে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাছন রাজাকে চিঠির মাধ্যমে অভিনন্দন ও প্রশংসা করেছিলেন। শহরের গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে হাছন রাজাকে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি এবং বাড়ি দেখার জন্যও প্রতি বছর এখানে বহু দর্শনার্থীর সমাগম হয়। সময় স্বল্পতার কারণে আর একটি ইউনিট পাঠিয়ে দেই রাধারমণ দত্ত, দুর্বীন শাহ ও শাহ আবদুল করিমের বাড়ির চিত্র ধারণ করতে।

সুনামগঞ্জ শহর থেকে ১২ কি.মি. দূরে একদম সীমান্ত ঘেঁষে মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নারায়ণতলা যে শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনবদ্য তা নয়, ঐতিহাসিক দিক থেকেও এ স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, নারায়ণতলার ডলুরায় ৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এবং তাদের স্মৃতিরক্ষার্থে এখানে নির্মিত হয়েছে ডলুরা স্মৃতিসৌধ। সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে আছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি। তিন দিকে মেঘালয় পর্বতমালা ঘিরে থাকা বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এক কথায় অসাধারণ। এসব স্থানও ধারণ করা হয়। নভেম্বর মাসেই প্রথমবারের মতো সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়েছে এবং এখানে লাউড়েরগড় রাজ্যের রাজধানীর সন্ধান পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে সভ্যতা হাজার বছর আগের। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে আমরা প্রথম খনন কাজটি ধারণ করে নভেম্বর মাসে প্রচারিত ইত্যাদিতে দেখিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরেছি।

১৮ তারিখ সকালে টিমের বাকি সবাই ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে। তাহিরপুর এসে পৌঁছলে আমরা সবাই মিলে বড় বড় নৌকায় সাড়ে ৩ ঘণ্টায় টাঙ্গুয়ার হাওর ও পাতলাই নদী পেরিয়ে মেঘালয় সীমান্তবর্তী টেকেরঘাট গিয়ে পৌঁছি বিকাল ৪টায়। যারা সরাসরি ঢাকা থেকে এসেছে তারা কিছুটা ভ্রমণক্লান্ত। একসঙ্গে এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা কারোরই নেই। টেকেরঘাটে গিয়ে সবাই যার যার মতো বিশ্রামে চলে গেল। পরদিন সকালে আমি, বন্ধুবর আনোয়ার হোসেন বুলু ও চারজনের একটি টিম নিয়ে বর্ডার গার্ডের সৈনিকদের মোটরসাইকেলে করে বেরিয়ে পড়লাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি টেকেরঘাটের অসাধারণ সব দৃষ্টিনন্দন স্থান ধারণ করতে। যেহেতু এখানে চার চাকার কোনো যানবাহন নেই, তাই মোটরসাইকেলই প্রধান বাহন। উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর হচ্ছে ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা একটি উপজেলা। তাহিরপুর উপজেলা থেকে অন্তত ১৮ কিলোমিটার উত্তরে টাঙ্গুয়ার হাওরের কাছে ভারত সীমান্তবর্তী অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান টেকেরঘাট। টেকেরঘাটে ছবির মতো সুন্দর যে টিলার সারি দেখা যায় তা সৃষ্টি হয়েছে মূলত কোয়ারি থেকে চুনাপাথর তুলতে গিয়ে মাটি সরানোর কারণে। ওই মাটির স্তূপই এক সময় এই সবুজ টিলায় রূপান্তরিত হয়েছে।

টেকেরঘাটের কিছু দৃশ্য ধারণ শেষে একটি স্পিডবোট নিয়ে আমরা ছুটলাম হাওরের উদ্দেশে। অক্টোবরে প্রথমবার যখন আসি তখন হাওরে পানি ছিল ভরা। এখন শীতকাল বলে শুকিয়ে গ্যাছে। ফলে আশপাশের কৃষিজমি ও গ্রামগুলো জেগে উঠেছে। এ সময় স্থানীয় কৃষকরা এখানে রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওরে। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন।

টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশি জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত অতিথি পাখির আবাসও এই হাওর। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। আশপাশের পানি খুবই স্বচ্ছ হওয়ায় ওপর থেকে হাওরের তলা পর্যন্ত দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট-বড় প্রায় ৪৬টি দ্বীপের মতো ভাসমান গ্রাম বা দ্বীপ গ্রাম রয়েছে।

জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে শনির হাওর অবস্থিত। শনির হাওরকে বলা হয় তাহিরপুর উপজেলার বোরো ধানের ভা-ার বা ধানের খনি।

টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে আমরা শহীদ সিরাজ লেকে আসি। উল্লেখ্য, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য শহীদ সিরাজুল ইসলামকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার নামানুসারেই এই লেকের নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজ লেক। তবে কারও কারও কাছে এই লেকটি নীলাদ্রি লেক নামেই বেশি পরিচিত। লেকের চমৎকার নীল পানি, এর পাশেই ছোট-বড় টিলা আর পাহাড়ের সমন্বয় লেকটিকে করেছে অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী। স্বতন্ত্র এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক পর্যটকই একে বাংলার সুইজারল্যান্ড হিসেবে অভিহিত করেন।

এরপর গেলাম বারেক টিলায়। জেলা শহর সুনামগঞ্জ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নান্দনিক সৌন্দর্যে ঘেরা বারেক টিলা। বারেক টিলার সবুজ বনায়ন ও চারপাশে নদী, পাহাড় ও হাওরের মনোরম দৃশ্যে মন হারিয়ে যায় ভ্রমণপ্রেমীদের। বৈচিত্র্যময় মনোহর রূপের কারণে ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন পাহাড়ি নদী যাদুকাটাকে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন নদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্ষায় যাদুকাটা নদীর পানিতে ভাসতে আর হেমন্তে যাদুকাটার বালুচরে হাঁটতে প্রকৃতি প্রেমিক অনেক পর্যটকই ভিড় জমায় এখানে।

টেকেরঘাটে এলে ভ্রমণপিপাসুদের ভ্রমণ তালিকায় থাকে একটি অপরূপ দৃষ্টিনন্দন বাগান, যার নাম শিমুল বাগান। যাদুকাটা নদীর তীরে অবস্থিত মনিগাঁও গ্রাম। আর এই গ্রামেই ২০০২ সালে স্থানীয় বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন তার ৩২১০ শতক জমিতে এই বাগানের কাজ শুরু করেন এবং ৩ হাজার শিমুলের চারা রোপণ করেন। জয়নাল আবেদীন এখন বেঁচে নেই, কিন্তু তার পরম যত্নে বেড়ে ওঠা গাছগুলো বেঁচে আছে, ফুলও ফুটছে। প্রতি বছর ফাগুন মাসে বাগানে এই শিমুল ফুল ফোটে। এই টকটকে লাল ফুলগুলোই হয়তো তাকে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। শীত এলেই স্কুল-কলেজে দেওয়া হয় শীতের ছুটি।  ভ্রমণপ্রিয় মানুষের ভ্রমণে যোগ হয় বাড়তি মাত্রা, জাগে আলাদা অনুভূতি।  যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা দূর হলে আর বিদেশ নয়, ভ্রমণপ্রিয় মানুষের ভ্রমণ তালিকায় প্রথম পছন্দের স্থান হতে পারে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই টেকেরঘাট।

 লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর